আইন কানুন- ভরণপোষণ একটি আইনি অধিকার by মাসূমা তাসনীম

বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে একজন নারী ও পুরুষের পারস্পরিক আস্থা, নির্ভরতা, ভালোবাসা ও জীবনসঙ্গী হিসেবে উভয়ে উভয়ের প্রতি মানবিক, নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের যে মধুর সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তা আমৃত্যু বহাল থাকুক এটাই সবার কাম্য। এ কারণে হিন্দু বিবাহকে পবিত্র স্বর্গীয় (Sacrament) বন্ধন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। ‘যদিদং হূদয়ং তব, তদিদং হূদং মম’ এটাই হিন্দু বিবাহের অন্যতম মূলমন্ত্র। দুটি হূদয় এক হূদয়ে রূপান্তরিত হয়ে অভিন্ন হূদয়ে অভিন্ন সত্তায় বিলীন হয়ে অপূর্ব ও প্রেমময়ী আবেগে একজন আরেকজনের সঙ্গে সারা জীবনের জন্য এক অটুট বন্ধন গড়ে তোলে।
মুসলিম বিবাহ কেবল ধর্মীয় বিষয় নয়, এটা ধর্মীয় ও সামাজিক চুক্তির সমন্বয়। ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নিষ্পন্নের লক্ষ্যে সামাজিক চুক্তি হিসেবে সুনির্দিষ্ট শর্তে বা চুক্তিতে মুসলিম বিবাহ সম্পন্ন হয় । এ কারণে একটি মুসলিম বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাবিনে (বিবাহ রেজিস্ট্রির প্রমাণপত্র) উল্লিখিত শর্তের আলোকে দেনমোহর, খোরপোষ বা ভরণপোষণ, তালাক, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রিত ও নিষ্পন্ন হয়ে থাকে।
হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টানসহ প্রায় সব ধর্মবিশ্বাসীর মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈধ বিবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল হলো স্বামী কর্তৃক স্ত্রী ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের ভরণপোষণ প্রদান করা।
একজন নারী বৈবাহিক সম্পর্কের স্বাভাবিক দায়দায়িত্ব পালনে তথা ইচ্ছাকৃতভাবে স্বামীর সঙ্গে একত্রে বসবাসে অসম্মত না হলে এবং যদি আইনসংগত কারণ ছাড়া স্বামী স্ত্রীকে অবহেলা করে বা নিজ গৃহ থেকে তাড়িয়ে দেয় বা স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে অথবা স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে স্ত্রী গৃহত্যাগে বাধ্য হয়ে অন্যত্র বসবাস করে; এরূপ নানা কারণে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে নিজ ও নাবালক সন্তানের জন্য ভরণপোষণের দাবিতে মামলা দায়ের করতে পারেন।
আভিধানিক অর্থে ভরণপোষণ বলতে বোঝায়, ‘প্রতিপালন করা’। অন্য অর্থে ভরণপোষণ বলতে বোঝায় বেতন বা মাহিনা। ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের অশ্বিনী কুমার সিনহা বনাম রাশনি সিনহা (পাটনা এল জে আর, পৃষ্ঠা-২৯৫-১৯৯৭ ইং) মামলার রায়ে ভরণপোষণ বলতে খাদ্য, বস্ত্র, আবাস, চিকিৎসা, শিক্ষা ও অন্যান্য খরচকে বোঝানো হয়েছে।
ভরণপোষণ হচ্ছে খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি, সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী স্ত্রীর সম্ভাব্য (বৈধ) খরচ। এ খরচের পরিমাণ স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা ও চলমান দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান অনুযায়ী নিরূপিত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে স্বামীর আর্থিক সংগতির বিষয়টিও বিবেচিত হবে। স্বামী সম্পদশালী হলে অব্যশই পর্যাপ্ত পরিমাণে এমনকি স্ত্রীর ভৃত্যের খরচ বহন করবেন। স্বামী ধনী হলে স্ত্রী গরিব হওয়া সত্ত্বেও মধ্যম পন্থায় এবং যদি উভয়ই গরিব হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের সামর্থ্যের ভিত্তিতেই ভরণপোষণের পরিমাণ নির্ধারিত হবে।
হিন্দু স্ত্রী বা কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে স্বামী বা বাবার মৃত্যুর পর সরাসরি সম্পত্তি পাওয়ার বিধান না থাকায় তাদের ভরণপোষণের বিষয়টি স্বামী বা বাবার ত্যক্ত সম্পত্তি থেকে প্রদান-সংক্রান্তে সর্বপ্রথম ১৯৪৬ সালের ‘হিন্দু স্ত্রীর ভরণপোষণ আইন’ এবং ১৯৫৬ সালের ‘হিন্দু দত্তক গ্রহণ ও ভরণপোষণ’ আইন প্রবর্তন করা হয়। পরবর্তী সময়েও ভারতে এ বিষয়ে যুগোপযোগী আইন প্রবর্তন করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়ে কোনো আইন করা হয়নি।
আমাদের দেশ সব ধর্মবিশ্বাসীর জন্য স্বামী বা বাবার কাছ থেকে ভরণপোষণ-বিষয়ক ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৪৮৮, ৪৮৯ এবং ৪৯০ ধারায় ভরণপোষণ-সংক্রান্ত বিস্তারিত বিধিবিধান কার্যকর ছিল। ওই আইনে এ দেশের সব ধর্মবিশ্বাসী নারী ও শিশুর ভরণপোষণ-সংক্রান্ত সমুদয় বিধিবিধান বিলোপ হওয়ায় বর্তমানে ফৌজদারি কার্যবিধির ওই বিধান আর বলবৎ নেই।
ভরণপোষণ-সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান বিলোপক্রমে ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ (Family Court Ordinance-1985) প্রবর্তিত হওয়ায় মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের এতদসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে সীমাহীন শূন্যতা দেখা দেয়। ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ৫ ধারায় (১) বিবাহ বিচ্ছেদ, (২) দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, (৩) মোহরানা, (৪) অভিভাবকত্ব এবং (৫) ভরণপোষণ-সংক্রান্ত বিষয়ে বিচারের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় সহকারী জজ তথা পারিবারিক আদালতের ওপর এবং একই সঙ্গে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৪৮৮ ধারার আওতায় ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারক্ষমতা রহিত করা হয়। এমতাবস্থায় ভরণপোষণ-সংক্রান্ত হিন্দুসহ অন্য ধর্মবিশ্বাসী নারীদের বিচারে কোন মূলনীতি অনুসৃত হবে, এ বিষয়ে পারিবারিক আদালত দ্বিধাদ্বন্দ্বের সম্মুখীন হন। এ পর্যায়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ নির্মল কান্তি দাস বনাম শ্রীমতী বিভা রানী মামলার (৪৭ ডিএলআর ৫১৪) সিদ্ধান্তে বলেন যে, হিন্দু নারীদের এই আইনের আওতায় প্রতিকার চাইতে কোনো বাধা নেই ।
উপরিউক্ত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে ধর্মবিশ্বাসীদের ভরণপোষণের দাবিতে আনীত মামলা পারিবারিক আদালতে নিষ্পত্তি হলেও সংশ্লিষ্ট হিন্দু বা অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের এতদসংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধিবিধান হালনাগাদ না থাকার কারণে তাদের ভরণপোষণ-বিষয়ক মামলা নিষ্পত্তিতে কিছুটা হলেও জটিলতা ও শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১১১ ধারার বাধ্যবাধকতার কারণে ও ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের আওতায় ভরণপোষণ-সংক্রান্ত বিরোধগুলো (মুসলিম ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীদের) বিচার নিজ স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতায় নিষ্পত্তি করে থাকেন।
জনকল্যাণকর একটি রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব জনজীবনের দুর্ভোগ নিরসনকল্পে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের উদ্দেশে (সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের আলোকে) সংসদ কর্তৃক জরুরি ভিত্তিতে অন্য ধর্মবিশ্বাসী নারীদের জন্য এতদসংক্রান্ত যাবতীয় বিধিবিধান প্রণয়ন ও প্রবর্তন করা। একই সঙ্গে স্বল্পতম সময়ে কম খরচে অসহায় স্বামী পরিত্যক্ত, নির্যাতিত নারীদের বিচারপ্রাপ্তির পথ সুগম হবে। অন্যথায় নারী নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত হবে এবং গণতন্ত্রের অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত হবে, যা আমাদের কারোরই কাম্য হতে পারে না।
=============================
আইন কানুন- অর্থঋণ আদালত আইনে অনেক গলদ by এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম  আইন কানুন- গাড়ি আটক হলে মালিকের করণীয় by মো. রাশেদ খান  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'আমাদের রাজনীতিতে বখাটেপনা' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  স্মরণ- 'আমরা তো কাঁদছিই' by নেয়ামতউল্যাহ  চিত্রকলা- এক পরিবারের বৃক্ষ ও শেকড় সুত্র প্রথম আলো  গল্পসল্প- 'ঢাকা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে' by উম্মে মুসলিমা  কৃষি আলোচনা- 'বরেন্দ্রভূমির কৃষকের বীজবিদ্রোহ' by পাভেল পার্থ  খবর- ৩০ নভেম্বরের হরতালের আগেই মারমুখী পুলিশ  খবর- চট্টগ্রামে ভাঙ্গা ভাঙ্গির রাজনীতি  ফিচার খবর - নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা’র বিরুদ্ধে রাজপথে আনসার-ভিডিপি!  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'প্রটোকল কার' : গরিবের ঘোড়ারোগ' by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন ডা. মিলন' by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী  রাজনৈতিক আলোচনা- 'প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী দলের সহাবস্থান' by ড. তারেক শামসুর রেহমান  আলোচনা- 'উপকূলের মাটির মানুষের কান্না' by জয়নুল আবেদীন  আগামী দিনের লক্ষ্য নির্ধারণে দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলন  দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়ার স্বপ্নের নতুন পথ  প্রকৃতি- বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়ছে কমেনি কার্বন নিঃসরণ by ইফতেখার মাহমুদ  প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস 'সামাজিক ব্যবসা অনেক ক্ষেত্রেই বেশিকার্যকর'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ মাসূমা তাসনীম
আইনের শিক্ষার্থী


এই আলোচনা'টি পড়াহয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.