বিত্তবানের ভোগসংকোচন আর ঋণগ্রস্তের ভোগবিলাস by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

আমার এক বন্ধুবর চলমান ক্ষুদ্র-বৃহৎ নানা ঘটনার মাধ্যমে আমাদের ও সমাজের বৈষম্য আর অসুস্থ উন্নয়ন প্রতিকূল সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে আমার সঙ্গে দূরালাপনিতে দীর্ঘক্ষণ ধরে মাঝেমধ্যেই হূদয়গ্রাহী আলাপ করেন। একসময় লিখতেনও ভালো। সম্ভবত লেখার অকার্যকারিতা ব্যাখ্যা উপলব্ধি করে লেখা ছেড়ে দিয়েছেন, তবে নিজের চিন্তা, অনুভূতি, চলমান ঘটনার ব্যাখ্যা নিয়ে আলাপ করা এখনো ছাড়েননি। তাঁর আলাপ-আলোচনা থেকে পাওয়া তথ্য নিয়েই এই লেখা।
ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আর রাষ্ট্রদূতদের একটি সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এটা বলতেও ভোলেননি, যেহেতু ব্রিটেনের বর্তমান অর্থনীতি ভালো নয়, নিশ্চয়ই আপনারা ফার্স্ট ক্লাস কিংবা বিজনেস ক্লাসে নয়, ইকোনমি ক্লাসেই যাতায়াত করবেন। দেশের নাজুক অর্থনীতির সমাজপালেরা কীভাবে সামাল দেবেন, কীভাবে ব্যয়সংকোচন করবেন, সাধারণ মানুষকে মিতব্যয়ী হতে শেখাবেন, তা নিয়ে নিশ্চয়ই বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমরা সাধারণত সভা-সমিতির বক্তব্য, উপদেশ, নির্দেশ, আদেশ সভায়ই রেখে আসি, যা উন্নত দেশের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের লোকজনও পালনে সচেষ্ট থাকে।
এরপর কোনো একটি ব্রিটিশ সংস্থার সভায় জানানো হলো, তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ বিধায় তাঁরা শুধু গরম পানি সরবরাহ করবেন, চা খাওয়ার জন্য টি-ব্যাগ প্রত্যেককে নিয়ে আসতে হবে। ফার্স্ট ক্লাস থেকে ইকোনমি ক্লাসে যাতায়াতের পরামর্শ সর্বপর্যায়ে ব্যয়সংকোচনে কীভাবে কার্যকরভাবে অনুশীলন করা হয়, এর চেয়ে তার অভিনব উদাহরণ আর কী হতে পারে? আরও জানা গেল যে ওই সংস্থাটির মাধ্যমে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড সাহায্য পেয়ে থাকে। শুধু তা-ই নয়, সাহায্যকারী এই সংস্থাটির প্রধান নির্বাহীর ব্যবহারের জন্য সার্বক্ষণিক কোনো গাড়িও নেই।
পক্ষান্তরে আমরা নানা দেশ থেকে ঋণ আর সাহায্য নিয়ে বছরের পর বছর ঋণের বোঝা ভারী করছি। অনাগত শিশুরা জন্মই নেবে হাজার হাজার টাকার বোঝা নিয়ে, যা সে কখনো ভোগ করেনি। এই ঋণ ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে কি না, তাও জানা নেই। তবে দারিদ্র্য বিমোচনের নামে যে টাকা আনা হয়, এর একটি বিশাল অংশ ব্যয় হয় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিতে, বিদেশভ্রমণে এবং অনুৎপাদনশীল খাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য অপরিবর্তিত রেখে কিংবা অধিকতর দারিদ্র্যে ঠেলে দিয়ে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের তালিকায় একাধিক ভারতীয়র নাম থাকলেও ভারতের রাস্তায় বাংলাদেশের মতো এত দামি গাড়ি নজরে পড়ে না।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের জাতীয় সংসদের স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জিকে গাড়ি বরাদ্দ করতে হিমশিম খেতে হয় সরকারকে। কোনো দামি গাড়িই তিনি ব্যবহার করবেন না, এমনকি ১৩ লাখ রুপি দামি গাড়িও। যদিও প্রায় একই সময়ে পত্রিকান্তরে প্রকাশ সাত গুণ ছোট বাংলাদেশ, বহুগুণ ছোট অর্থনীতির দেশের স্পিকারদের জন্য ৫০ কোটি টাকার গাড়ি কেনা হলো। একদিন সংসদ অধিবেশনে আমাদের মাননীয় সাংসদেরা বললেনও, জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা ১৯৮৮ সাল থেকে এ সুবিধা পেয়ে আসছেন, তা চালিয়ে যেতে অসুবিধা কী? ব্রিটেনে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ, তাঁরা ইকোনমি ক্লাসে আকাশভ্রমণ করবেন, সভায় টি-ব্যাগ দিতে পারবেন না, কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তো ভালো, যদিও তাঁদের চেয়ে বছরে ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড সাহায্য নিয়ে থাকি।
আমাদের সাংসদেরা যাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের গড় উপার্জন বিশ্বের গড়ের হয়তো বা এক-দশমাংশ। দরিদ্র জনগণের প্রতিনিধিরা ত্যাগে অসাধারণ হতে পারেন, তাই বলে ভোগে অসাধারণ হবেন কেন? তাহলে কীভাবে তাঁরা এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে দেশ গড়ার কাজে লাগাবেন। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা অনুভব করার জন্য, উপলব্ধি করার জন্য তাদের কাছে আসতে হবে, তাদের দুঃখের সাথি হতে হবে। যিনি বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন না, তাঁর টাকা থাকলে ইচ্ছামতো ভোগ করলেও বলার কিছু নেই, কিন্তু জনগণের প্রতিনিধি এমন অবিবেচনার কাজ থেকে বিরত থাকবেন, তা সবাই প্রত্যাশা করেন। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি প্রায় ৮০ বছর বয়সে তাঁর হাঁটুর অস্ত্রোপচারের জন্য ভারতীয় মাটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। এ ঘটনায় নিশ্চয়ই ভারতীয় ধনকুবেরেরাও দেশের মাটিতে এমনকি জটিল চিকিৎসসেবা গ্রহণে উৎসাহিত হয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, দেশের চিকিৎসাসেবার মানও নিশ্চয়ই উন্নত হয়েছে।
অতিসম্প্রতি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সফল হওয়ায় দেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের এমডিজি পুরস্কার গ্রহণ করে আমাদের কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত করেছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীর সংখ্যা নাকি ছিল ১০৩। ভারত আমাদের চেয়ে সাত গুণ বড় দেশ, তার অর্থনীতি নিশ্চয়ই আরও অনেক বড়। তাদের প্রতিনিধিদলের আকার কত বড় ছিল কিংবা পাকিস্তানের, মালয়েশিয়ার, কোরিয়ার? ব্রিটেনের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ বলে রাষ্ট্রদূতেরা ইকোনমি ক্লাসে যাতায়াত করেছেন, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কি তার চেয়েও ভালো?
বিগত চারটি নির্বাচনের ফলাফল হলো, জনগণ সরকারি দলকে প্রত্যাখ্যান করেছে (বিরোধী দলকে গ্রহণ করেছে বলাটা নিশ্চয়ই অতিরিক্ত বলা হয়ে যাবে)। দরিদ্র দেশ, অনেক চাহিদা, সম্পদ অপ্রতুল, সব চাহিদা মেটানো যাবে না। সুতরাং সরকারি দলের পুনর্নির্বাচন মোটেও সহজ নয়। বর্তমান সরকার দিনবদলের অঙ্গীকার করেছে। এই অঙ্গীকার সামনে রেখে ব্যয়সংকোচনে নেতাদের অগ্রে থেকে নেতৃত্ব দান করতে হবে। পত্রপত্রিকান্তরে প্রকাশ, নানা স্থানে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকারি দলের ব্যানারে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির সমস্যা। সাংসদেরা কিছু সুবিধা ভোগ করলে তাঁর জয়ের পেছনে যারা শ্রম দিয়েছে, তাদেরও তো কিছু প্রত্যাশা জাগ্রত হয়। এমনটি যদি মনে হয়, দুর্বল অর্থনীতির দেশের পক্ষে এ চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়, তাহলে এমন প্রত্যাশা যাতে না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে—জনপ্রতিনিধিদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা থেকে বিরত থাকতে হবে।
একবার হংকংয়ের এক সদাশয় অধ্যাপক আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ব্যস্ত নগর, প্রত্যেক মানুষ শুধু কাজের পেছনে দৌড়াচ্ছে। চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের অতিথি ভবন থেকে লক্ষ করলাম, তিন মিনিট অন্তর একটি করে ট্রেন আসছে। হংকংয়ে আবার কেসিআর, এমটিআর এসব নামে একাধিক সাবওয়ে রেল সার্ভিস চালু আছে। আমাকে একজন অধ্যাপক বললেন, একটি সাবওয়ের কিছুটা অংশ সরাসরি না হয়ে একটি আয়তক্ষেত্রের অপর তিন বাহু বরাবর হয়েছে, কারণ লাইনটি সরাসরি করতে হলে পাথরের পাহাড় ভেদ করে টানেল তৈরি করতে হয়। পরে অর্থনীতিবিদেরা হিসাব করে বের করেছেন, প্রতি যাত্রায় ৩০ সেকেন্ড করে বেশি সময়, দিনে প্রতি যাত্রী কবার যাতায়াত করে গুণ ৩৬৫ গুণ প্রতিদিনের যাত্রীসংখ্যা গুণ বছরের সংখ্যা। এভাবে দেখানো হলে প্রতি ভ্রমণে ৩০ সেকেন্ড সময় হারানোর মাধ্যমে হংকং কী বিশাল ক্ষতি বহন করছে। সরকার টানেল করতে বাধ্য হলো। জনগণও বুঝল, তাদের ৩০ সেকেন্ড সময় দেশের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে কিন্তু সদাশয় সরকার প্রতি মুহূর্তেই বোঝাচ্ছে, সাধারণ জনগণের সময়ের কোনো দাম নেই। যেকোনো উপলক্ষেই যানজট সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী অনেকবারই উচ্চারণ করেছেন, বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নই তাঁর লক্ষ্য। সুতরাং দিনবদলের অঙ্গীকার সামনে রেখে বর্তমান সরকারকে নানা সমস্যার মধ্যে রাজধানীতে যানজটেরও একটি কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। এ ছাড়া অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যাতায়াতজনিত কারণে যানজটের বাড়তি দুর্ভোগ কারও জন্য কাম্য হতে পারে না। উন্নত দেশগুলোর নেতাদের যাতায়াত কিন্তু কখনো জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করে না। আমাদের দুর্বল অর্থনীতির দেশের নেতারা আমাদের চাহিদা মেটাতে পারবেন না, এটা সহজেই অনুমেয়। তবে তাঁদের যাতায়াতকে নিষ্কণ্টক করতে মানুষ অসীম যানজটের স্বীকার হবে, তা-ও কাম্য নয়।
সাধারণ মানুষকে শেখাতে হবে, তার সময় দেশের জন্য কত মূল্যবান, যা হংকংয়ের জনগণকে দেখানো হয়েছে। আমাদের দেশের অর্থনীতি যদি দুর্বল হয়, তাহলে আমাদের নেতাদের ব্যয়সংকোচন অনুশীলন করে সাধারণ মানুষকেও ব্যয়সংকোচনে উৎসাহিত করতে হবে। ব্রিটিশরা যদি ব্যয়সংকোচনের জন্য সভায় চা সরবরাহ বাদ দিতে পারে, তাহলে ঋণগ্রস্ত দেশ হিসেবে আমাদের অনেক কিছুই করার আছে। সুখের বিষয়, আমাদের বর্তমান নেতৃত্বেও এমন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রয়েছে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.