শ্রীলঙ্কার নির্বাচন-উত্তর রাজনীতি by ফারুক চৌধুরী

যেকোনো যুদ্ধের পর যুদ্ধপূর্ব অবস্থায় ফিরে যাওয়া যায় না কখনো। তার প্রমাণ আমরা পাই পৃথিবীর যেকোনো স্থানে ঘটা যুদ্ধোত্তর অবস্থা থেকে। একটি সশস্ত্র সংঘাত নতুন একটি অবস্থার সৃষ্টি করে, যা নতুন আঙ্গিকে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। শ্রীলঙ্কায় এলটিটিইর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটল গত বছরের মে মাসে, তা এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। যেমন ছিল না আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।
শ্রীলঙ্কায় তামিলবিরোধী অভিযানের সাফল্যজনক সমাপ্তি ঘটেছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সমাজে সিনহালা-তামিল দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না। এই দ্বন্দ্ব এখন কীভাবে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করবে, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে আশা তো এই রইবে যে তা যেন সহিংস আকার ধারণ না করে।
শ্রীলঙ্কা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ, মাথাপিছু আয়সমেত অন্যান্য অনেক খাতেই দেশটি আমাদের অঞ্চলের অন্য অনেক দেশ থেকেই এগিয়ে আছে। দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ আর ভয়াবহ সুনামি শ্রীলঙ্কাকে আঘাত হেনেছে সত্যি, কিন্তু পর্যুদস্ত করতে পারেনি। এমনকি গণতন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রেও শ্রীলঙ্কার অবস্থান প্রশংসনীয়ই রয়েছে বছর বছর ধরে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে শ্রীলঙ্কার প্রাদেশিক এবং সাধারণ নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল—এবং এক কথায় এই বলা যায় যে সেই সময়ে চলমান গৃহযুদ্ধ সত্ত্বেও, যুদ্ধবহির্ভূত অঞ্চলে একটি মুক্ত, অবাধ ও উচ্চমানের নির্বাচন দেশটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল; যেখানে সেই দেশের নির্বাচন কমিশন একটি নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী ভূমিকা নির্ভয়ে পালন করেছিল।
কিন্তু গৃহযুদ্ধের অবসানে গত ২৬ জানুয়ারি যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনটি হলো তা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বিশেষ নজরের দাবি রাখে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই বছর আগেই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত করলেন। তা অসাংবিধানিক না হলেও, ছিল রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, বিজয়ের দাবিদার তো তিনিই—অতএব ঝটপট নির্বাচন—‘শুভস্য শীঘ্রং’। কিন্তু তখন শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অঙ্গনে বিবর্তনটি ঘটল, তা অনেকের চোখেই ছিল অনভিপ্রেত। তা হলো শ্রীলঙ্কার বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে, যুদ্ধে শ্রীলঙ্কার সশস্ত্র বাহিনীর অধ্যক্ষ জেনারেল শরত ফনসেকাকে দাঁড় করাল এবং জেনারেল ফনসেকাও প্রথামত উর্দি ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় এবং সাগ্রহে নির্বাচন যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। বাংলাদেশসমেত দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা বিরল নয়—কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে তার রাজনৈতিক নেতা, প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে, সেনাধ্যক্ষ জেনারেল শরত ফনসেকাকে না দাঁড় করালেই তা গণতন্ত্র এবং যুদ্ধোত্তর শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জন্য মঙ্গলতর হতো। নির্বাচনে অনিয়ম ঘটল বেশ, কিন্তু শতকরা ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে (ফনসেকা পেলেন ৪০ শতাংশ) নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপক্ষে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আরও ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হলেন।
প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষকে উদ্দেশ করে বলা যায়, ‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না!’
ফনসেকা নির্বাচনে অনিয়মের কথা তুলে ধরলেন, আর তিনি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে পারেন, এ কারণে অথবা অজুহাতে জেনারেল ফনসেকাকে বন্দী করা হলো। তিনজন মেজর জেনারেল আর চারজন ব্রিগেডিয়ার-সমেত প্রায় এক ডজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো। সামরিক বাহিনীর অবকাঠামোয় অনেক পরিবর্তন আনা হলো। প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে হয়তো বা প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত পদক্ষেপই গ্রহণ করলেন।
আগের কথায় ফিরে আসি। যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি কখনো যুদ্ধপূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে পারে না। যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সামরিক বাহিনীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হলো। সামরিক বাহিনীতে রাজনৈতিকীকরণ ঘটল। প্রতিরক্ষা খাতে যে দেশে; স্বাধীনতার পর পর বাজেটের শতকরা দুই ভাগ ব্যয় হতো সেখানে সেই খাতে খরচ দাঁড়াল বাজেটের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি—শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কৃষি খাতকে ছাড়িয়ে সেনাবাহিনীর আকার উন্নীত হলো তিন লাখে। সমাজে উর্দিভীতি প্রবেশ করল—উর্দি-বন্দনা শুরু হলো। ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’ এই আপ্তবাক্যের সত্যাসত্যটি সিনহালা-তামিল দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক সমাধান আনয়নে বিফল রাজনীতিবিদেরা বেমালুম ভুলে গেলেন। সেই ভুলেরই মাশুল শ্রীলঙ্কাকে এখন দিতে হচ্ছে।
এখন এই সামরিক দৈত্যকে আবার বোতলবন্দী করা প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে আর সেই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত সমস্যাটিকে যেভাবে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে তা রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয় নয় বলেই অনেকে ভাবছেন। যুদ্ধ শেষ হলেও একটি নতুন অশান্তি শ্রীলঙ্কার সমাজকে আক্রান্ত করেছে, যা দেশটির আশু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত করতে পারে। শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্রের সুদৃঢ়করণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান। শ্রীলঙ্কার সমস্যার ‘বল’টি এখন সেই দেশের রাজনীতিবিদদেরই ‘কোর্টে’।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.