কারসাজি চক্রে শেয়ারবাজার পতন থামছে না

বিগত সময়ে শেয়ার কারসাজি ও অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং সত্যিকারের পুঁজিবাজার গড়তে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান হিসেবে খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আশা করা হয়েছিল পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু কোনোভাবেই দরপতন থামছে না। গত ১৪ই আগস্ট দরপতন শুরু হওয়ার পর থেকে দুই মাসে বাজার মূলধন কমেছে ৪০ হাজার ৬৬০ কোটি টাকার বেশি। পুঁজি হারিয়ে আতঙ্কে রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে সম্প্রতি বিনিয়োগকারী নাম দিয়ে কিছু ব্যক্তি বিএসইসি’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। সংস্থার অফিস গেটে তালা দিয়ে কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করেছে। এর নেপথ্যে শেয়ারবাজারে কারসাজির দায়ে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিরাসহ তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্টদের ইন্ধন রয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদের ব্যানারে ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিএসইসি’র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি’ বিষয়ে অবহিত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে (এফআইডি) বিএসইসি যে চিঠি দিয়েছে, তাতে এমন কারণ জানানো হয়েছে। কমিশন বলেছে, যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সংস্কার কার্যক্রমের বিরোধী, যারা চায় না কারসাজির হোতাদের শাস্তি হোক এবং যারা ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, তারাই পুঁজিবাজারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। চিঠিতে কমিশন জানিয়েছে, দৃশ্যত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের কার্যক্রম দুরভিসন্ধিমূলক। ‘এজিএম পার্টি’সহ পুঁজিবাজারে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তি যারা চলমান সংস্কার কার্যক্রম ও কারসাজির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিরোধী, তারা এ ধরনের বিক্ষোভে মদত জোগাচ্ছে বলে বিএসইসি’র নিজস্ব অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। বিএসইসি মনে করে, সংঘটিত আন্দোলন কর্মসূচির ঘটনায় উপস্থিত অনেকেই পুঁজিবাজারের প্রকৃত বিনিয়োগকারী নন।

সূত্রমতে, শেখ হাসিনার সরকারের আমলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঢিলেঢালা নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অভাবে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের কষ্টার্জিত টাকা পুঁজিবাজারে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত শেয়ার ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। ভালো শেয়ার কেনার পরও কমপক্ষে ৪টি স্টক ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের টাকা আত্মসাৎ করায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রায় ৭০টি ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগকারীদের টাকা আংশিক আত্মসাৎ করেছে। সবচেয়ে নিরাপদ মিউচুয়াল ফান্ডও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কারণ বেশ কয়েকটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান নজিরবিহীনভাবে মিউচুয়াল ফান্ডের টাকার অপব্যবহার করেছে। যদিও তারা এসব বিনিয়োগ সুরক্ষা ও ভালোভাবে পরিচালনার জন্যই নিযুক্ত হয়েছিল। বিশ্লেষকরা এ অবস্থার পেছনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজরদারির অভাব ও নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে কারসাজির বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করেছেন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেশ কয়েকটি শেয়ারের মূল্য কারসাজি করায় ২০২২ সালে বিএসইসি মাত্র ২১ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল। যেখানে শেয়ার জালিয়াতকারীদের ২৫৩ কোটি টাকা হাতিয়েছিল। ২০২৩ সালে শেয়ারের দাম কারচুপির দায়ে দুই কোটি টাকা জরিমানা হলেও কারচুপিকারীদের মুনাফা হয়েছিল ১৫ কোটি টাকা। গত ১৫ বছর ধরে একই পরিস্থিতি দেখা যায়। শেয়ারের কারসাজিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পৃক্ততা বছরের পর বছর ধরে বেড়েছে। এটি পুঁজিবাজারের জন্য অশনিসংকেত। ২০২১ সালের আগে দুই-একটি প্রতিষ্ঠান শেয়ারের দাম কারসাজিতে জড়িত ছিল বলে প্রমাণিত হলেও ২০২২ সালে তা ১৫টি প্রতিষ্ঠান ছাড়িয়ে যায়। ২০২৩ সালে ছয় প্রতিষ্ঠান কারসাজির সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণিত হয়। যেমন, ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনের (ইউএফএস) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মিউচুয়াল ফান্ড থেকে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পেয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রাথমিক উচ্ছ্বাসে পুঁজিবাজারে দেখা দেয় উত্থান। চার কর্মদিবসে প্রায় ৮০০ পয়েন্ট সূচক বৃদ্ধির পাশাপাশি ৬ থেকে ১৪ই আগস্ট বাড়ে বাজার মূলধন। ১৪ই অগাস্ট বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৭ লাখ ১১ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা। তবে পরদিন থেকে শুরু হয় টানা দরপতন। এই দরপতনে শেয়ার দর হারিয়ে বাজার মূলধন দাঁড়ালো ৬ লাখ ৭১ হাজার ২১০ কোটি টাকা, যা ঠিক দুই মাস আগের তুলনায় ৪০ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা কম। এরমধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি অতীতে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিষয়ে তদন্ত কমিটি, শেয়ারদর বৃদ্ধির ঘটনায় কারসাজির অভিযোগে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা, ঘোষিত লভ্যাংশ বিতরণ না করাসহ নানা কারণে ২৮টি কোম্পানিকে জেড শ্রেণিতে পাঠায়। এসব ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং টানা দরপতন ঘটছে। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে সংস্কার নিয়ে রোডম্যাপ তৈরিতে অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ বিষয়ে ৫ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

গত দেড় মাসে কমিশনের কার্যক্রম: বিগত দিনের অনিয়ম অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন। একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে রেকর্ড জরিমানা। তিন অডিট প্রতিষ্ঠানকে বিএসইসি’র প্যানেল থেকে বাদ। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির নতুন শেয়ার ইস্যুর প্রস্তাব বাতিল। যেসব কোম্পানি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘোষিত লভ্যাংশ দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। একাধিক ব্রোকারেজ হাউজের মালিক ও শীর্ষ ব্যক্তিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে এবং কিছু পরিচালক ও এমডি’র বিও হিসাব জব্দ করা হয়েছে। বিএসইসি বলেছে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে একটি সুষ্ঠু বাজার গড়তে এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবু কিছু অযৌক্তিক দাবিকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে কিছু ব্যক্তি।

১৯শে আগস্ট বিএইসি’র চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। এরপর থেকেই শেয়ারবাজারে টানা দরপতন হতে দেখা গেছে। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯শে আগস্ট লেনদেন শেষে ডিএসই’র মূলধন ছিল ৬ লাখ ৯৫ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। যা গত ৯ই অক্টোবরে ৬ লাখ ৭৪ হাজার ৪১৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বিএসইসি চেয়ারম্যান যোগদানের পর দেশের প্রধান শেয়ারবাজারে মূলধন কমেছে ২১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। তার মানে কারসাজি চক্র শেয়ারবাজার নিয়ে খেলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, দেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও সংস্কারে প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি একটি সমৃদ্ধ ও সফল পুঁজিবাজার গড়তে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র সঙ্গে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, অসঙ্গতিপূর্ণ এবং ব্যবসায় বাধা প্রদানকারী বিদ্যমান আইন কানুন ও নিয়মনীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে কমিশন আশ্বাস দিয়েছেন। আমরাও আশাবাদী।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.