আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব: ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা
আইন উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের জন্য কয়েকটা ধাপ আছে। আমাদের নতুন কমিশন লাগবে। এরপর নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। নির্বাচন কমিশন গঠনের পর প্রথম কাজ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ। ফ্যাসিস্ট সরকারের ভুয়া নির্বাচনের পর জিল্লুর ভাই অনেকগুলো কাগজ দিয়েছিল। তারা ভোটার তালিকার নামে কি যে অরাজকতা করেছিল বলে বোঝাতে পারবো না। কিছু দিনের মধ্যেই সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। ভোটার তালিকার পরই নির্বাচন হবে।
আফিস নজরুল প্রশ্নের জবাবে বলেন, সকল উপদেষ্টার যে ক্ষমতা, আমরাও একই ক্ষমতা। ইউনূস স্যার (প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস) আমাকে অনেক দিন ধরে চেনেন। স্যারের যখন মামলাগুলো চলছিল তখন আমি কোর্টেও যেতাম। প্রথমে খুব ঘন ঘন দেখা হতো। এজন্য মানুষের ধারণা আমি ক্ষমতাবান উপদেষ্টা। অনেকেই বলেন- উপদেষ্টা পরিষদ ঠিক করার ক্ষেত্রেও আমার ভূমিকা আছে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। প্রথম যে ছয়জন উপদেষ্টা হবেন এটা আমি জানতামই না। বাকিদের বিষয়ে জানতাম কারণ ছাত্ররা আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। এ কারণে মানুষের মনে অনেক আশা তৈরি হয়, যেটা ঠিক না। বর্তমানে স্যারের সঙ্গে সবথেকে বেশি আলোচনা হয় ছাত্র নেতাদের সঙ্গে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্দিপ্রত্যর্পণ চুক্তি আছে। ২০১৩ সালের ২৮শে জানুয়ারি সাক্ষরিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো ভাবতেও পারেন নাই এই চুক্তির আওতায় তাকে ফেরত চাওয়া হবে। এই চুক্তি যদি ভারত সঠিকভাবে পালন করে অবশ্যই শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়া উচিত। এই চুক্তির আওতায় কারও বিরুদ্ধে যদি প্রসেডিং শুরু হয় তাকে আরেক দেশ চাইতে পারে। এখানে অবশ্য বলা আছে, পলিটিক্যাল অফেন্স হলে চাওয়া যাবে না। কিন্তু এটাও বলা আছে, মার্ডারারকে পলিটিক্যাল অফেন্স ধরা হবে না। এখানে এই প্রভিশনস আছে, বাংলাদেশ ভারতকে বলতে পারে যাতে ওখানে ওনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এতো বড় একটা খুন সংঘটিত হয়েছে। সবার সামনে খুন হয়েছে। ছাত্রলীগের নেত্রীওতো শেখ হাসিনা ছিলেন। ওনাদের মন্ত্রী আরাফাত (বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত) বলেছিলেন, ওনাদের এতো গুলি আছে যে গুলি করলে পাঁচ বছরেও শেষ হবে না। ক্রাশ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে গুলি, পেটানো, হত্যা করেছে। এগুলোর পর যদি ভারত ইন্টারপিটিশন দেয় তাহলে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে অত্যন্ত কড়াভাবে প্রতিবাদ করা হবে। একটা হত্যা হলে বন্দি নিয়ে আসতে পারে আর এখানে এক হাজারের বেশি খুন হয়েছে তারপরও আনা যাবে না- এটা তাহলে তো ঠিক হবে না। যদি ভারত কাউন্টার দেয় আমরাও আর্গুমেন্ট করতে প্রস্তুত আছি। এই চুক্তি যদি অনেস্টলি ইন্টারপ্রেট করে তাহলে অবশ্যই ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে বাধ্য।
সাংবাদিকদের বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি সেদিন বলি নাই যে, সাংবাদিকদের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হবে। এই বিষয়টি নিয়ে আমি তো বলার কেউ না। এখানে প্রসিকিউটর সাহেব আছেন তিনি বলতে পারবেন। একটা বিষয় বলতে পারি সুবিচার হবে। সাংবাদিকদের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হবে কি না এটা সম্পূর্ণ প্রসিকিউশনের বিষয়।
ঢালাও মামলার বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, বিগত সরকারের আমলে গায়েবি মামলা ও এখনকার ঢালাও মামলার পার্থক্য আছে। বিগত সরকারের আমলে গায়েবি মামলা করা হতো সরকারের উদ্যোগে। অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদী ছিল পুলিশ। এখন ঢালাও মামলা করছেন বিগত সরকারের আমলের নির্যাতিতরা। অধিকাংশই তৎকালীন আমলের বিরোধী দলের নেতা। এই সমস্ত মামলা দায়েরের বিষয়ে সরকারের কোনো হাত নেই। আমরা কয়েকজন উপদেষ্টা বসে একটা পরিকল্পনা করেছিলাম যে, মামলার পর পুলিশকে তদন্তের ভার দেয়া যায় কি না। তখন আমাদের আশঙ্কা তৈরি হলো, পুলিশ এই সুযোগে আবার বাণিজ্য করবে। পুলিশকে বলা আছে, এফআইআর করার সঙ্গে গ্রেপ্তার না এবং ক্রেডিবল কোনো তথ্য না মিললে গ্রেপ্তার না। এখন পুলিশের মোরাল পর্যন্ত নাই। আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশকে হত্যাকারী বাহিনী বানিয়েছে। আমরা অনেক সময় সাধারণ কাজ করতে পারি না। এত পরিমাণ ভিজিটর আসে দেখা করতে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আমরা যে প্রতিটি মামলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবো সেই সময়টা পাচ্ছি না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্র লীগকে নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। বিশ্বের কোন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্যাতন বাহিনী বানিয়ে রেখেছে? ওরা যাতে অমানুষে পরিণত হয় এজন্য রাতের বেলা ছেড়ে দেয়া হতো বাইরে। প্লান্ড ওয়েতে শেখ হাসিনা সরকার একটা নিপীড়নের যন্ত্র বানিয়ে রেখেছিল। সন্ত্রাসের কারণে অনেক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেইসব দলের সঙ্গে যদি ছাত্রলীগের পার্থক্য দেখেন তাহলে ছাত্রলীগের ১০ বার নিষিদ্ধ হওয়ার কথা। তবে অন্তর্বর্তী সরকার আগ বাড়িয়ে কিছু করবে না। তবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবি একটা জনপ্রিয় দাবিতে পরিণত হচ্ছে। এখন জনগণ যদি এটা চায় ছাত্ররা যদি চায়, যদি জনপ্রত্যাশা তৈরি হয় তাহলে অবশ্যই জনপ্রত্যাশার বাস্তবায়ন করাও এই সরকারের দায়িত্ব।
নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তিনি। বলেন, এতটাই বেড়েছে যে, সবার মনপীড়ার কারণ। কিছুদিন আগে পলাশীর মোড়ে গিয়েছিলাম। যার কাছ থেকে প্রায়ই তরকারি নিতাম সে দোকানদার বললেন, বিক্রি কমে গেছে। ধরেন ডিমের বিষয়টি, বন্যার কারণে ডিমের সাপ্লাই কমে গেছে। বাজারে একটা চক্র কাজ করে। গত সরকারের আমলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতো সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট ধরতে গিয়েই এই অবস্থা হয়। ধরেন একটা লোক ৮০ শতাংশ ডাল আনে। আমি তাকে গ্রেপ্তার করতে পারি। গ্রেপ্তারের পর তার মানি ফ্লোরগুলো বন্ধ হয়ে গেল ৮০ শতাংশের জায়গা সে আনবে ৪০ শতাংশ ডাল। তিনি বলেন, বন্যার প্রকোপ কমে যাচ্ছে, শীতকাল আসছে আশা করি সামনে পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি উন্নত হতে শুরু করেছে।
আদালত পাড়ায় বিচারকদের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে। এই বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, একজন সিনিয়র বিচারক বলেছিলেন, উনি একজন শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ। একজন বিচারক ভাষণ দিয়ে বলেছিলেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো সরকারকে আনা যাবে না। প্রধান বিচারপতি ছাত্রলীগ থেকে ফুলের তোড়া নিয়েছেন। দেশে এতো গুম, বিচার-বর্হিভূত খুন হলো, তিনটা ভুয়া নির্বাচন হলো, লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পদ পাচার হলো, সাবেক চিফ জাস্টিসকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হলো, একজন মেয়র আবার তা গর্ব করে বললেন। উচ্চ আদালতে কোনটার বিচার হয়েছে? ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থায় অনেক বিচারক নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলেন। অভিজিৎ (ব্লগার ও লেখক) হত্যার পর ওনার স্ত্রী বললেন বিচার চাই না। বিচার যে হয় সেটা মানুষ ভুলেই গেছিল। উচ্চ আদালতে একজন বিচারক যেভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করেছেন, উন্মাদের মতো আচরণ করতেন তাকে আবার প্রমোশন দেয়া হয়েছে। এই বিচার বিভাগের সর্বনাশ করেছেন শেখ হাসিনা। আমাদের ছাত্ররা গিয়ে সংযত আচরণ করেছে। তারা কোনো ভাঙচুর করে নাই। আওয়ামী লীগের আইনজীবীদের কথা চিন্তা করেন, তারা এজলাসে গিয়ে ভাঙচুর করেছে, চিফ জাস্টিসের এজলাসে লাথি মেরেছে। লাথি যে মেরেছে তাকে আবার আওয়ামী লীগ সরকার জাজ বানিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমি যখন এসব অন্যায়ের প্রতিবাদে বিবৃতি সংগ্রহ করছিলাম তখন বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে কথা বলার কারও সাহস ছিল না। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলা যেত কিন্তু বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে কথা বলা যেত না। আমি টকশোতে একটা কথা বলেছি এই কারণে কেন আমাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না- এজন্য স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে রুল জারি করেছে। বিচার বিভাগের কাজ হলো- মানবধিকার রক্ষা করা কিন্তু তারা উল্টো কাজ করেছে। এই পরিস্থিতি কে তৈরি করেছে, এখন বাংলাদেশে যতো সর্বনাশ হচ্ছে সবই ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের বাই-প্রোডাক্ট বা অনিবার্য রিফলেকশন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ এলো- এতিমের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। উনি এটা শুনে আশ্চর্য হয়ে বললেন- আমি এতিমের টাকা আত্মসাৎ করেছি। এটা লেখা হলো যে- উনি স্বীকার করেছেন। ওনারা কী বিচারক ছিলেন? ড. ইউনূস আদালতে একটা প্রতিকার চাইতে গিয়েছিলেন, বিচারক ইমব্যারেস্ট, আদালত সেটা শুনবেই না।
৭০ দিন হলো উপদেষ্টা হয়েছেন, আপনি কী কোনো ভুল করেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, হয়তো অনেক কিছুই ভুল হয়েছে। আমার যোগ্যতা কম, অভিজ্ঞতা তো একেবারেই নেই। কিন্তু জেনে-বুঝে কোনো অন্যায় করিনি। আমার অনেক ভুল অযোগ্যতা থাকতে পারে কিন্তু অসৎ কাজ করিনি। আমার নীতিগত ভুল থাকতে পারে, ব্যক্তিগত স্বার্থে কোনো অন্যায় করিনি।
আসিফ নজরুল বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট পুরোটাই বাতিলকরণের প্রক্রিয়ায় আছি। নারী ও শিশুদের রক্ষার জন্য আমরা হয়তো বিশেষ আইন করবো কিন্তু ডিজিটাল সিকিউরিটি ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ইনশাআল্লাহ্ থাকবে না। বিশেষ ক্ষমতা আইনের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা আওয়ামী লীগ-বিএনপি সকলেই বলেছে কিন্তু কেউ বাতিল করে নাই। এটা বাতিল হবে কি না এটার বিষয়ে আমি গ্যারান্টি দিতে পারছি না।
ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিষয়ে তিনি বলেন, সাকিবের মতো খেলোয়াড় বাংলাদেশের ইতিহাসে আসে নাই। সাকিব ইতিহাসের সবথেকে জনপ্রিয় হয়ে থাকতে পারতেন। এটাতো শুধু রাজনীতি নয়. আমি বিশ্বাস করতে পারছি না মানুষ মরছে, যখন ঘরে ঘরে ক্ষোভ, কান্না তখন সাকিব পোস্ট দিয়েছে- ইনজয়িং মাই লাইফ। এটা সম্ভব একটা মানুষের পক্ষে। জুয়া, বেটিং, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ এটার জন্যও শেখ হাসিনা দায়ী। তিনি এমন একটা রাষ্ট্র গড়েছিলেন তাকে সন্তুষ্ট রাখতে পারলে আর কোনো বিচার হবে না। তার বিরুদ্ধে যখন মানুষ ক্ষোভ দেখায় তখন আমার একটুও অযৌক্তিক লাগে না।
তিনি বলেন, এয়ারপোর্টে পুলিশ, কাস্টমসের লোকজন প্রবাসীদের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করতো। তাদের পাঠানো টাকাতেই আমরা স্বপ্ন দেখি। দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই আমরা একটা প্রবাসী লাউঞ্জ বানাচ্ছি। এয়ারপোর্টে পা দেয়া মাত্র তাকে স্কট করা হবে। প্লেনে ওঠা পর্যন্ত সঙ্গে থাকবে। তারা ভিআইপি সুবিধা পাবেন।
আগামী দিনের বাংলাদেশের স্বপ্ন্নের বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকে অনেক সংস্কারের কথা বলেন। আমি উপদেষ্টা হওয়ার আগেও বলতাম- প্রথম কাজ ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন। নির্বাচন সঠিকভাবে হলে পাঁচ বছর পর ক্ষমতা হারাতে হবে এই কারণেই অন্যায় কম করবে।
No comments