মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে: গ্রহণযোগ্য বিচারের জন্য আইসিটি আইনের সংশোধন প্রয়োজন by সাজেদুল হক

জুলাই ‘গণহত্যার’ বিচার কোন আইনে? এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। এসব ঘটনায় সারা দেশে বেশ কিছু মামলাও দায়ের হয়েছে। গ্রেপ্তারও করা হয়েছে  কয়েকজনকে। তবে এসব মামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এরইমধ্যে জানিয়েছেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে (আইসিটি) এসব ঘটনার বিচার হবে। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বিস্তারিত কিছু এখনো জানানো হয়নি। তবে আইনবিদরা বলছেন, ১৯৭৩ সালের আইনটি নিয়ে দেশ-বিদেশে বিতর্ক রয়েছে। অতীতে এ আইন সংশোধনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান আইনজীবীরা কিছু পরামর্শও দিয়েছিলেন। তাই গ্রহণযোগ্য বিচারের জন্য এ আইনে কিছু সংশোধন প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাধিক মামলা পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির।

ফৌজদারি মামলায় বিশেষজ্ঞ এ আইনজীবী মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আইনে এসব অপরাধের বিচার সম্ভব। শুধুমাত্র কিছু হত্যা মামলা দিয়ে এসব জঘন্য ঘটনার ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। এসব অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে বিচারই যথাযথ। কারণ এ আইনে নির্দেশদাতা, সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি যাদের তাদের বিচারের আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে। তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে আইনে কিছু সংশোধন আনতে হবে। কী ধরনের সংশোধন করতে হবে সে ব্যাপারে একাধিক পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, বিদেশি আইনজীবী আনার সুযোগ দিতে হবে। বিচার কার্যক্রম লাইভ সম্প্রচার করতে হবে। যাতে সারা দুনিয়া দেখতে পায় কী ধরনের বিচার হচ্ছে।

শিশির মনির বলেন, আমাদের ফৌজদারি আইনের মূল আইন হচ্ছে দণ্ডবিধি। দণ্ডবিধিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো কনসেপ্ট নেই। বাকি আইনগুলোতেও এ ধরনের অপরাধের বিচারের ব্যবস্থা নেই। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে যেসব অপরাধের বিচারের বিধান রয়েছে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধ। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালগুলোর রায়ে একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধ হতে হলে অপরাধ ব্যাপক বিস্তৃত এবং পদ্ধতিগতভাবে হয়েছে এটা দেখাতে হবে। এরপর যদি দেখানো যায় এখানে মার্ডার হয়েছে কিংবা টর্চার হয়েছে, কিংবা এখানে অপহরণ হয়েছে, ডিজাইন করে হয়েছে, একটা ঘটনা নয় শত শত ঘটনা হয়েছে, শত শত হত্যা হয়েছে, রাষ্ট্রের বাহিনী করেছে, রাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, কোন দলের লোক করেছে তাহলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী সেটা মানবতাবিরোধী অপরাধ। বাংলাদেশে যেটা হয়েছে পুলিশ গুলি করেছে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে, বিভিন্ন রিপোর্টে আমরা দেখছি যারা নিহত হয়েছেন তারা গুলিতে নিহত হয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে গুম, খুন সংঘটিত হয়েছে এসবকে আমি মানবতাবিরোধী অপরাধ মনে করি। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের ৩ ধারার ২ এর ১ উপধারায় এসব অপরাধের বিচার করা সম্ভব। এ আইনে বলা আছে, আইন কার্যকর হওয়ার আগের এবং পরের অপরাধের বিচার করা যাবে। সে হিসেবেও জুলাই এবং আগস্টে সংঘটিত অপরাধের বিচার এ আইনে করা সম্ভব।

এ আইনের আওতায় কারা কারা আসবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যিনি সরাসরি গুলি করেননি, নির্দেশ দিয়েছেন কিংবা দূর থেকে বসে মনিটরিং করেছেন কিংবা কমান্ড দিয়েছেন তাকেও এ আইনের অধীনে আনা যাবে। ফিল্ডে যদি কেউ অংশ নেন তার সাজার কথা আইনে আছে। পাশাপাশি যিনি আদেশ দিয়েছেন, সুপিরিয়র অফিসার ছিলেন, সুপিরিয়র অফিসারের পদে থেকে অর্ডার দিয়েছেন, অথবা পারমিট করেছেন কিংবা মৌন সম্মতি দিয়েছেন তারাও এ আইনের অধীনে সংজ্ঞার মধ্যে পড়বেন। ফিল্ড লেভেলে যে পুলিশ সদস্য গুলি করেছেন তাকে আদেশ দিলো কে? এটা যদি লিংক খোঁজা হয় তাহলে যেতে যেতে ডিএমপি কমিশনার, তার উপরে আইজিপি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তখন কমান্ড, কন্ট্রোল, সুপিরিয়র অফিসার, সুপিরিয়র কমান্ড এগুলো হবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবেই সঠিক বিচার হবে। এটা না করে যদি একেক জায়গায় একেকটা মামলা হয় তাহলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের বিচার হবে না। শুধু খুনের বিচার হবে।

সরকার প্রধানকে কি এ আইনের অধীনে বিচারের আওতায় আনা যাবে- এ প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, হাইয়েস্ট কমান্ডের সোর্স কি? একজন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের কমান্ড দেয়ার কতোগুলো মেকানিজম আছে। তার এ মেকানিজমগুলো কোর্টে যদি এভিডেন্স আকারে আসে তাহলে সর্বোচ্চ কমান্ডে যিনি ছিলেন তাকেও বিচারের আওতায় আনা যাবে, তিনিও অপরাধে দায়ী থাকবেন। আন্তর্জাতিকভাবে এমনও ডিসিশন আছে যে, তিনি করতে বলেননি কিন্তু তার অধীনস্থদের বিরত রাখেননি। এই যে বিরত রাখেননি সেটিও অপরাধ।

তবে আইনটি বর্তমানে যেভাবে আছে সেভাবে বিচার হলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, বর্তমানে আইনটি যেভাবে আছে এভাবে বিচার করা হলে যার বিচারই করা হোক না কেন সেটি দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বে। কারণ এ আইনের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক গলদ রয়েছে। এ গলদগুলো সংশোধন প্রয়োজন। আপনি যারই বিচার করেন না কেন আসামির যে অধিকার সে অধিকার তাকে দিতে হবে। আসামির অধিকার নিশ্চিত না করে আপনি হাত-পা  বেঁধে কারও বিচার করলে সে বিচার গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা দেশেও গ্রহণযোগ্য হবে না, বিদেশেও গ্রহণযোগ্য হবে না।

তিনি বলেন, এ আইনে একটি বিধান আছে যে, সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে না। সাক্ষ্য আইন যদি প্রযোজ্য না হয় তাহলে সাক্ষ্য-প্রমাণ কীভাবে হবে, জেরা কী করে হবে, যে সাক্ষীকে রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করবে তাকে ক্রস এক্সামিনেশন কী করে হবে। সাক্ষ্য আইনকে বাদ দিয়ে কেউ যদি নিজেদের মতো করে সাক্ষ্যের রুলস করে বিচার করে, যেটা আগে করা হয়েছে সেটা তো গ্রহণযোগ্য হবে না। যেমন এ আইনে বলা আছে, একজন ব্যক্তি যদি পুলিশের কাছে একটি স্টেটমেন্ট দেয়, পরে যদি কোর্টে হাজির না হয়, তারপরও তার সেই জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে। এটা পৃথিবীর কোন স্ট্যান্ডার্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রহণযোগ্য ম্যাকানিজম হলো যেটা সে পুলিশের কাছে বলবে তাই আদালতে এসে বলবে, তাকে ক্রস এক্সামিনেশন করা হবে, তারপরই কেবল তা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হবে। কিন্তু অতীতে কী হয়েছে, মাওলানা সাঈদীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, সাক্ষীরা পুলিশের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছে কিন্তু আদালতে আসেনি তা আদালত জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে এটা হাস্যকর বিচার হয়ে গেছে। কারণ সাক্ষী তো আসেনি, তাকে তো ক্রসচেক করা যায়নি। সুতরাং এ বিধান পরিবর্তন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের কিছু রুলস অফ এভিডেন্সেস আছে। এ রুলস অফ এভিডেন্সের যতগুলো সুযোগ আছে তার সবগুলো এখানে প্রযোজ্য করে দেয়া উচিত। যাতে স্বাধীনভাবে একজন ব্যক্তির এভিডেন্স উপস্থাপনের সবধরনের সুযোগ থাকে। এখানে আরেকটা বিধান আছে পত্রিকার রিপোর্ট, ফটোগ্রাফস, ম্যাগাজিন, ফিল্ম এভিডেন্স হবে। কিন্তু এটি এভিডেন্সের সর্বজনীন বিধান নয়। আন্তর্জাতিকভাবে বর্তমানে ডিজিটাল এভিডেন্সের বিধান চালু হয়েছে যেটায় বলা হচ্ছে ভিডিওর সোর্স প্রকাশ করতে হবে, কনটেন্ট সম্পর্কে ক্রস এক্সামিনেশন করতে হবে, বিশেষজ্ঞ মতামত নিতে হবে।

বিদেশি আইনজীবী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশি আইনজীবী আনতে গেলে এখন বার কাউন্সিলের অনুমতি নিতে হয়। এটি উচিত নয়। কেউ যদি বিদেশি আইনজীবী আনতে চান তাকে তার সুযোগ দিতে হবে। অতীতে আমরা দেখেছি বিদেশি আইনজীবী আনার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাদের অনুমোদন দেয়া হয়নি। এটা সারা দুনিয়াতেই সমালোচনা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রসঙ্গে শিশির মনির বলেন, আমাদের অন্য আইনে ডেথ পেনাল্টি আছে। সুতরাং এ আইনেও ডেথ পেনাল্টি থাকতে পারে।
তিনি বলেন, এসব সংশোধন আনার পর যথাযথ তদন্তে সক্ষম তদন্ত সংস্থা নিয়োগ দিতে হবে। যোগ্য আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে। যারা আইনের যথাযথ আলোচনা করতে পারেন। একইসঙ্গে এই বিচারের লাইভ সম্প্রচার করা উচিত। যেন সারা পৃথিবীর মানুষ এ বিচার দেখতে পায়। অতীতে আমরা এ ব্যাপারে বলেছি কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করা হয়নি। আইসিসিতে যে বিচার হয় আমরা দেখছি লাইভ সম্প্রচার করা হয়।

শিশির মনির বলেন, সব জড়তার ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকারের বিচার হলে মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ হয়েছে তার প্রতি জাস্টিস হবে। সবাই দেখেছেন হাজার হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে, হাজার হাজার লোক আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। এই অপরাধের বিচার কি সাধারণ আদালতে সম্ভব? সম্ভব নয়। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট এখন যেভাবে আছে সেভাবে সম্ভব? সম্ভব নয়। এ আইনের মান ঠিক করে যদি বিচার করা হয় তাহলে এ বিচার দেশে এবং বিদেশে শত বছর দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।  কিন্তু তাড়াহুড়া করে আইন সংশোধন না করে যদি বিচার শুরু হয় বা চলে একসময় তা নিয়ে মারাত্মক সমালোচনা হবে। তিনি বলেন, অপরাধী যেন পার না পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে আসামির অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। এটাই আইন ও ধর্মের কথা।

No comments

Powered by Blogger.