সরজমিন ফেনী: ত্রাণের অপেক্ষায় by মারুফ কিবরিয়া

লিজু আক্তার। ফেনীর পরশুরাম উপজেলার চিথুলিয়ায় বাড়ি। সাতদিন আগে গভীর রাতে ভয়াবহ পানির স্রোতে ঘরবাড়ি সবই হারান। উজান থেকে আসা ঢলে সব হারিয়ে সাঁতরে আশ্রয় নেন চিথুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। গত সাতদিন এখানেই বাস করছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে লিজু বললেন, ‘বাড়িত কিছুই নাই। আঁর বা‌ড়ির টি‌নের চালও নাই। বেক হা‌নি‌তে ভা‌সি গে‌ছে।’

চ‌ল্লি‌শোর্ধ্ব এই নারী গত বুধবার রাতে আচমকা পানির তো‌ড়ে সর্বস্ব হা‌রি‌য়ে চলে আসেন আশ্রয়কেন্দ্রে। ভয়াবহ সেই রা‌তের স্মৃ‌তি ম‌নে পড়লেই অ‌ঝো‌রে কাঁ‌দেন তি‌নি। লিজু আরও জ‌ানান, এক বা‌ড়িতে তারা ১৫ সদ‌স্যের প‌রিবার। তারা সবাই একস‌ঙ্গে বা‌ড়ি ছা‌ড়েন। শুধু লিজু আক্তার নয়, চিথু‌লিয়া গ্রা‌মের এমন শতা‌ধিক মানুষ সেই রা‌তে স্কুলে স্থা‌পিত আশ্রয়‌কে‌ন্দ্রে এসে ও‌ঠেন।

চিথু‌লিয়ার রিকশাচালক সুমন মিয়া। তি‌নিও দুই ছেলে তিন মে‌য়ে নি‌য়ে আশ্রয়‌কে‌ন্দ্রে আসেন। বুধবার রাতের বা‌নের স্রো‌তে বা‌ড়ি ছা‌ড়েন। জী‌বিকার একমাত্র সম্বল রিকশাটাও হা‌রি‌য়ে ফে‌লেন সুমন মিয়া। তি‌নি ব‌লেন, সংসার চল‌তো রিকশা চালি‌য়ে। এখন সেটাও নাই। কীভা‌বে চলবো বুঝ‌তে পার‌ছি না। আবার কবে রিকশা পা‌বো। ক‌বে বউ বাচ্চার পেটে ভাত দি‌বে‌া।
চিথু‌লিয়া সরকা‌রি প্রাথ‌মিক বিদ‌্যালয় আশ্রয়কে‌ন্দ্রে সাত দিন ধরে অবস্থান কর‌ছেন হোস‌নে আরা বেগম না‌মের আরেক না‌রী। দুই বছ‌রের শিশু‌কে ঘা‌ড়ে তু‌লে বৃহস্পতিবার ভোরে দুই কি‌লো‌মিটার পথ সাঁ‌তরে আসেন তি‌নি।

হোস‌নে আরা ব‌লেন, আমা‌দের এদি‌কে পা‌নি আসে প্রতি বছর। কিন্তু ঘর ত‌লি‌য়ে যায় না কখনো। এবার যেটা হইছে আমার দাদার বাবাও দে‌খে‌নি। এই বন্যায় সব চ‌লে গে‌ছে। কিছুই নাই আমার। কো‌নো ম‌তে বাচ্চাটা নি‌য়ে বের হইছি।
পশুরাম উপ‌জেলার আরেক আশ্রয়‌কেন্দ্র পশুরাম মডেল সরকারি উচ্চ বিদ‌্যালয়। বন‌্যার শুরুর দি‌কে এখা‌নে অন্তত ৪শ’ মানুষ আশ্রয় নেন। পা‌নি কমায় এখন অ‌নে‌কে ফি‌রে গে‌ছেন। ত‌বে যা‌দের বা‌ড়িঘ‌রে এখনো পা‌নি আছে তারা আশ্রয়‌কে‌ন্দ্রেই অবস্থান করছেন।
সেখা‌নে গত ছয়‌ দিন ধ‌রে আছেন রিকশাচালক হানিফ। তি‌নি ব‌লেন, এখা‌নে ম‌নে হ‌চ্ছে জে‌লের মধ্যে আছি। বা‌ড়িতে তো সব ভা‌সি‌য়ে নি‌ছে। আমার ঘ‌রের টিনগু‌লো কই আছে জা‌নি না। এখন টিন পাবো কই?

আরেক নারী শরীফা খাতুন ব‌লেন, আমার মে‌য়েটার বয়স সাত বছর। ভোররা‌তে ঘু‌মের ম‌ধ্যেই ঘ‌রে গলা সমান পা‌নি। মে‌য়েটা তো ডু‌বেই গে‌ছিলো। প‌রে খুঁজে বের ক‌রে সব ফে‌লে চ‌লে আস‌ছি। এত ভয় কখনো পাইনি।
বন্যার পানির তীব্র স্রোতের বিপরীতে তিনদিন টিকে থাকার লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে পরশুরামের সাতকুচিয়া গ্রামের ষা‌টোর্ধ্ব নারী আসমা বেগম। চোখে মুখে তার এখনো আতঙ্ক।
তিনি জানান, প্রচণ্ড ক্ষুধার জ্বালায় মাছের খাবারের ড্রামে করে ভাসতে ভাসতে তারা ওঠেন পরশুরাম পাইলট হাইস্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে যাওয়ার পর খাবার পান।

শুক‌নো খাবা‌রে কাটছে দিন:
আশ্রয়‌কে‌ন্দ্রে আসা মানুষগু‌লো গত সাত দিন ধ‌রেই কাটা‌চ্ছেন দু‌র্বিষহ জীবন। শুক‌নো খাবা‌র ছাড়া ভাতের দেখা পা‌চ্ছেন না। কেউ ব‌্যক্তি উদ্যো‌গে রান্না করা খিচু‌ড়ি দি‌লে ত‌বেই এক‌বেলা খে‌তে পার‌ছেন।
পশুরা‌মের চিথু‌লিয়ার আশ্রয়‌কে‌ন্দ্রে আশ্রয় নেয়া বন্যাক‌বলিত‌রা জানান, সবাই চিঁড়া-মু‌ড়ি দি‌য়ে যায়। কেউ চাল-ডাল দি‌লে রান্না ক‌রে খে‌তে পার‌তেন।

সীমা রানী না‌মের এক নারী জানান, আমা‌দের এখানে শুধু চিঁড়া-মু‌ড়ি আসে। প্রতি‌দিন প্রতি বেলায় এসব খাওয়া যায়? য‌দি চাল-ডাল দি‌তো তাহ‌লে রান্নার ব‌্যবস্থা করতাম। বা‌ড়ি‌তে পা‌নি কতো‌দি‌নে কমবে কে জা‌নে!
আলাউদ্দিন না‌সিম চৌধুরী ক‌লে‌জে আশ্রয় নেয়া শাকেরা বেগম ব‌লেন, চিঁড়া-গুড় দি‌য়ে তিন বেলা খাওয়া কষ্ট। আল্লাহ খাওয়াইতে‌ছে খাইতে‌ছি। বাড়িতে তো ঘরটা আবার ক‌বে তুল‌বো কে তু‌লে দিবো জা‌নি না। সব অন্ধকার লা‌গে।
একই আশ্রয়‌কে‌ন্দ্রের সাইফু‌ল ইসলাম ব‌লেন, এই জেল থে‌কে ক‌বে মু‌ক্তি পাবো জা‌নি না। বা‌ড়ির পা‌নি এখনো কোমর সমান। শুকনা খাবার আর কতো ভালো লা‌গে।

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার পুরনো মুন্সির হাটের উত্তর শ্রীপুরে পাটোয়ারী টাওয়ারে আশ্রয় নিয়েছেন নারী-শিশুসহ আড়াইশরও বেশি মানুষ। তাদের অনেকে জানান, যারা খাবার দি‌চ্ছেন বে‌শির ভাগই শুক‌নো। চাল-ডালসহ মু‌দি পণ‌্য দি‌লে নি‌জে‌রা রান্নার ব‌্যবস্থা কর‌তে পার‌তেন।

পথে প‌থে খাবার পে‌তে হাত তুল‌ছেন শত মানুষ:
ফেনীর ফুলগাজীর আনন্দপুর থে‌কে পশুরাম সদর পর্যন্ত পু‌রো সড়ক‌টি প্রায় ২০ কি‌লো‌মি‌টার। এই সড়কের উপর শত শত মানুষ দাঁ‌ড়ি‌য়ে থা‌কেন খাবারের জন‌্য। নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ সবাই ত্রা‌ণের গা‌ড়ি দেখ‌লেই থামা‌চ্ছেন। স্বেচ্ছা‌সেবীরা গাড়ি থামিয়ে বিতরণ কর‌ছেন খাবার। ত‌বে অ‌নেক গা‌ড়িই থামে না। তারা জানায় নি‌র্দিষ্ট আশ্রয়কে‌ন্দ্রে গে‌লে মিল‌বে খাবার।

No comments

Powered by Blogger.