বিস্কিটের টিন খুলে শফিক রেহমান আমাকে বললেন: লন্ডন থেকে এসেছে, তোমার ভালো লাগবে by শায়ের খান
ফোন দেই যায় যায় দিন অফিসে। সালাম দিয়ে শফিক রেহমান'কে সরাসরি বলি - ' আপনি যে লিখলেন আমার ' হাবার স্বপ্ন ' বোরিং , কোথায় ও কেন বোরিং প্লিজ বলবেন ? ' তিনি বিব্রত হলেন । সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর তাঁর মাথায় ছিলো না । হোল্ড অন । আমি যেই শফিক রেহমানকে এই কথাটা বলছি , তখন তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতের নেপোলিয়ন বোনাপার্ট আর আমি মিডিয়ায় পিচ্চি এক ওয়েস্টার্ন কাউবয় । আমার সাহসে বিব্রত হলেও খুশি হলেন শফিক রেহমান । অফিসে আসতে বললেন ।
আমি গেলাম অনেক পরে । ২০০১ সালে । হাতে একটা লেখা নিয়ে । শফিক রেহমান ছাপলেন । আমাদের সম্পর্ক হয়ে গেলো চমৎকার । বেইলি রোডের সাপ্তাহিক যায় যায় দিন পত্রিকা অফিস হয়ে গেলো আমার প্রায়ই আড্ডা মারা আর লেখার জায়গা ।
এই অফিসে শফিক ভাইয়ের অধীনস্থ তিনজন জেনারেল ছিলো । এরা একটা রুমে পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করতো । সজীব ওনাসিস , সায়ন্থ সাখাওয়াত ( এনাকে অনেকেই এখন টক শো'র সুবাদে চেনে ) ও মাহমুদুজ্জামান । আমি শফিক ভাইয়ের সাথে কাজ সেরে এদের রুমে একটু আড্ডা মেরে যেতাম । আমি মনে মনে এদের ডাকতাম থ্রি স্টুজেস । এতোদিন তারা এটা জানতো না , আজ জানলো । এদের মধ্যে সজীব ওনাসিস হচ্ছে শফিক রেহমানের রক সলিড ভক্ত । সজীব ওনাসিসের বাবা হচ্ছেন বিখ্যাত গীতিকার ফজল - এ - খোদা । উনার লেখা কালজয়ী গান হচ্ছে - ' সালাম সালাম হাজার সালাম , লাখো শহীদ স্মরণে -। '
এক বিকেলের এক মজার কথা । একটা লেখা নিয়ে শফিক ভাইয়ের অফিস রুমে ঢুকলাম । তিনি আমাকে চোখ দিয়ে মাপলেন । ভূমিকা না করেই পরাজয়ের সুরে বললেন, 'তুমি তো আমাকে হারিয়ে দিলে । ' ভাবলাম আমার গত সংখ্যার লেখাটা বেশ প্রশংসিত হয়েছে । সম্ভবত উনার 'দিনের পর দিন'কে হারিয়েছি । ভুল ভাঙলো পরের লাইনে । বললেন -' শায়ের , আমি এতোদিন ভাবতাম আমিই সবচেয়ে কালারফুল । তুমি আমাকে আজ হারিয়ে দিলে । ' আমি সেদিন হ্যাজার্ড ব্র্যান্ডের এক সিঁদুরি লাল টকটকে শার্ট পরেছিলাম । হাওয়াই মিঠাই শার্টে শফিক রেহমানের চোখেমুখে স্পষ্ট পরাজয়ের ছাপ দেখেছিলাম । লাল উনার প্রিয় ।
বাংলা লেখায় শফিক রেহমানের নিজস্ব একটা স্টাইল আছে । যেমন ক্রিয়া'কে লিখেন কৃয়া , সুশীল'কে সুশিল , প্রি-কে পৃ , শ্রী-কে শৃ । এই বানান আমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিলো ।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মিডিয়ায় আমার ঘনিষ্ঠ মানুষদের অনেকেই আমার উপর কড়া নজর রাখতে শুরু করে । আমি বিএনপিপন্থী বা রাজাকার টাইপ কি না এসব । পাখির ছবির লোগো-ওয়ালা টিভি চ্যানেলের কমিশনিং এডিটর 'লীগ আদর্শের' ভদ্রলোক তো আমাকে মোটামুটি ধমকের সুরেই জিজ্ঞেস করলো , আমি শফিক রেহমানের মতো বানানে লিখি কেনো ? এই চ্যানেলে আমার কোনো অনুষ্ঠান যায়নি । ইন ফ্যাক্ট ২০০৮ সালের পর কোনো টিভি চ্যানেলেই আমার নাটক প্রচার হয়নি ।
একটা নামকরা টিভি চ্যানেলে নাকি ওয়ান ইলেভেনের সময় মিটিং করে কিছু মিডিয়া দুর্বৃত্ত বলেছিলো - আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তারা আমাকে দেখে নেবে । যাদুর মতো ওদের কথায় কাজ হয়েছিলো । আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন চ্যানেলে প্রি-প্ল্যানড অপদস্ত ও হয়রানি করা হয় আমাকে । সুসংগঠিতভাবে মিডিয়ায় আমার সম্পর্কে ' নেগেটিভ ন্যারেটিভ ' তৈরি করা হয় । ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন বা চরিত্র হনন করার চেষ্টা করা হয় একাধিকবার । হানি ট্র্যাপে বিফল হয়ে মানি ট্র্যাপ করা হয়েছিলো । একটা টিভি চ্যানেল আমাকে অপহরণ করে আটকে রেখেছিলো ।
স্বৈরাচারের প্রোপ্যাগান্ডা মেশিনের প্রধান দু'টোর একটা সেই চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে নাকি জনতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছে । শুনেছি সেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক এখন তার ' গম মন্ত্রী ' মালিকসহ পলাতক আছে । সম্প্রতি ছাত্র জনতার সফল অভ্যুত্থানের পর উত্তেজিত জনতা জ্বালিয়ে দেয় সেই লাল রঙের লোগোর চ্যানেল ।
শফিক রেহমান যখন সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক যায় যায় দিন প্রকাশ করেন , সেটা ছিলো একটা ইতিহাস । এ নিয়ে গুঞ্জন ছিলো - কি নিয়ে যেন আসছেন শফিক রেহমান । আমাকে তিনি তা বললেন । বললেন - ' শোনো শায়ের , আমি এমন এক জিনিস বানাচ্ছি যেখানে আমার কট্টর বিরোধীরাও আসবে । আবার আমাকে ওরা রাজাকার বলে গালি দেবে । আবার আসবে । আসতে ওদের হবেই । '
এখনকার তরুণ তরুণীরা যারা ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিস্কার করে উদাহরণ তৈরি করছো , শুনে রাখো - আজ থেকে ২ দশক আগে তেজগাঁও শিল্প এলাকার এক গাঁজা - ফেনসিডিল - পকেটমারের রাস্তাকে শফিক রেহমান ঝকঝকে পরিস্কার করে নাম দিয়েছিলেন - লাভ রোড । ভালোবাসার রাস্তা । আর সেই রাস্তায়ই ছিলো দৈনিক যায় যায় দিনের অফিস । আরো শুনে রাখো - এখন তোমরা যে ভ্যালেন্টাইন'স ডে বা ভালোবাসা দিবস পালন করো , বাংলাদেশে এটা এনেছেন এই লিভিং লেজেন্ড শফিক রেহমান ।
দেখি এক এলাহী অফিস দৈনিক যায় যায় দিনের । লাইব্রেরি থেকে থিয়েটার সবই আছে । কনফারেন্স রুম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের নামে , ক্যাফে'র নাম চে' ( গুয়েভারা ) ক্যাফে , থিয়েটার হল আলফ্রেড হিচককের নামে । গ্রাউন্ড ফ্লোর অলমোস্ট পুরোটাই কাঁচের । দুষ্টুমি করে বললাম -' হাসিনার পোংটা পোলাপান ইট মারলে ভেঙে যাবেনা ? ' বললেন -' এটা বুলেট প্রুফ । হাসিনার পোলাপান গ্রেনেড মারলেও কিছু হবেনা । '
লিখতে শুরু করলাম দৈনিক যায় যায় দিনে ।
পরের সন্ধ্যায় শফিক ভাইকে ফোন দিলাম । অনেক আবেগঘন হয়ে বললেন তাঁর ৫০ বছরের লালিত স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আনন্দের কথা ।
তথাকথিত ওয়ান ইলেভেন হওয়ার আগে আগে শফিক রেহমান তাঁর ' বিশেষ প্রতিপক্ষ ' অফিস কর্মচারীদের ট্র্যাপে পড়েছিলেন । ব্রিটিশ নাগরিক তিনি লন্ডন যাওয়ার উদ্দেশ্যে জিয়া এয়ারপোর্টে ( এখনকার হজরত শাহজালাল ) গেলে এমিরেটসের এক অফিসারের ইশারায় উনাকে আটকে দেয়া হয় । যেতে দেয়া হয়নি । ফিরে আসেন শফিক রেহমান । আর তাঁর ' বিশেষ প্রতিপক্ষ ' কর্মচারীরা মিছিল করে করে বলে , তিনি নাকি তাদের বেতন না দিয়ে পালাচ্ছিলেন । সব্বোনাশ । বলে কি ?
আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো শুনে যে কে বা কারা তাঁকে নাকি হত্যার পরিকল্পনা করেছিলো । তাই অফিসের ভার মিস তালেয়া রেহমানের ( উনার স্ত্রী ) হাতে দিয়ে নীরবে তিনি জীবনের নিরাপত্তায় দেশ ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন । সব শুনে বললাম -' আপনি চিন্তা করবেন না । আমি আপনার পাশে আছি। '
২০০৮ সালের নির্বাচনে শফিক রেহমান তাঁর ইস্কাটনের পৈতৃক বাড়িটা বিএনপি তথা বেগম খালেদা জিয়া'র অস্থায়ী অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন । এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলো -' এটা কি আরেক হাওয়া ভবন ? ' শফিক রেহমান উচ্চস্বরে বলেছিলেন -' হাওয়া ভবনও না বাতাস ভবনও না , এটা আমার বাবার ভবন । '
২০১২ সালের দিকে হবে । হাসিনা বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে । তখন শফিক রেহমানের যায় যায় দিন ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে । ' মৌচাকে ঢিল ' নামে একটা ম্যাগাজিন বের করেন । বাসার নিচতলায়ই এর অফিস । টিভির খবরে দেখলাম শফিক রেহমানের এই বাসায় সরকারি গুন্ডারা ককটেল হামলা করেছে । সন্ধ্যায় একাই তাঁর বাসায় গেলাম । ভূতুড়ে আলো আঁধার আর থমথমে পরিবেশ । বাসার গেইটে নক করতেই খুব ভয়ে ভয়ে সিকিউরিটি গার্ড উঁকি দিলো । পরিচয় দিয়ে খুলতে বললাম । খুললো । ঘুরে ঘুরে এফবিআই তদন্তকারীদের মতো দেখে বললাম - ' ডেঞ্জারাস কিছুনা । শব্দ করে ভয় দেখাতে এসেছিলো । '
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস স্যার যখন নোবেল প্রাইজ পান , তখন শফিক রেহমান সরাসরি ইউনূস স্যারের পাশে গিয়ে দাঁড়ান । শফিক ভাইয়ের সুখী বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এমন ছিলো , যেন উনিই নোবেল জিতেছেন । হ্যালো ইউনূস স্যার , আপনার মনে আছে তো , আপনাদের জেনারেশনের জাহাঙ্গীর ভাই ছাড়া ( মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর - আপনার প্রয়াত ছোটো ভাই ) শফিক রেহমানই একমাত্র সাংবাদিক যে আপনার গর্বে গর্বিত হয়ে বিদ্যুৎ গতিতে আপনার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ? নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে । এদেশে শফিক রেহমানই একমাত্র টিভি উপস্থাপক যিনি সাধারণ ক্যামেরা ফ্রেমের এক নন-ফিকশন ইনফোটেইনমেন্ট ' লাল গোলাপ 'কে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করে তুলেছিলেন । জিনিয়াস এই শফিক রেহমানকেই একটি টিভি চ্যানেলের পরিচয়ের ছদ্মাবরণে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। আপনি কি একজন বাংলাদেশি ? আপনি কি নিজেকে কখনো প্রশ্ন করেছেন , একজন সিনিয়র সিটিজেন ও জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমানকে কেনো মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হয় এবং কেনো তিনি দেশান্তরী হন ? আপনি সেই প্রশ্ন তুলবেন না , কারণ আপনাকে পাশের দেশের স্ক্রিপ্টে তাদের এদেশীয় দালালরা ব্রেইনে ঢুকিয়েছে যে , হলিউডের গ্রেগরি পেক হচ্ছে হিরো আলম আর দুর্বৃত্ত শাসক রাজনীতিবিদের রক্ষিতাদের ভাইরাল ভিডিও হচ্ছে ক্ল্যাসিক মুভি ।
জিনিয়াস শফিক রেহমানকে নিয়ে এতো কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই , তিনি দীর্ঘ নির্বাসনের পরে লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছেন । আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম যে উনাকে অন্যায়ভাবে নির্যাতনকারীর পতন তিনি দেখে যান কিনা । হ্যাঁ , উনি দেখলেন ।
প্রিয় শফিক রেহমান , আপনাকে আপনার ভূমিতে স্বাগত । আপনি বেশ টায়ার্ড । আপনার ককটেল বম্ব খাওয়া ইস্কাটন গার্ডেনের বাসায় বসে রিল্যাক্স করে একটা ককটেল ড্রিংক্স নিন । সেটা যদি টনিক ওয়াটার দিয়ে একেবারে ট্রান্সপারেন্ট কিছু হয় , তবে এলাচ লেবুর স্লাইস আর আইস কিউব মাস্ট । চিয়ার্স ।
লেখক - নাট্যকার - ফিল্মমেকার
No comments