বাংলাদেশে আন্দোলনের সমর্থনে রেমিট্যান্স বর্জন নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা :নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদন
দেশে যুবকদের মধ্যে বেকরত্ব আকাশচুম্বী। এমন অবস্থায় সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে কোটা সংস্কারের আহ্বান জানান শিক্ষার্থীরা ও অন্য প্রতিবাদকারীরা। গত মাসে সেই দাবিকে সামনে রেখে প্রতিবাদ বিক্ষোভ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এরপর কমপক্ষে ২০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেখা দেয় ভয়ঙ্কর অস্থিরতা। তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করে সরকার। এর জন্য দেশে ও বিদেশে তীব্র নিন্দা জানানো হচ্ছে। ওদিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে হাজারো মানুষকে। বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে এ বছর বিতর্কিত নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে পুনঃনির্বাচিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। তারা সহিংসতার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে তাদেরকে এবং তাদের ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। উল্লেখ্য, তীব্র প্রতিবাদের পর ২০১৮ সালে চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। কিন্তু জুনে তা পুনর্বহালের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কোটা কমিয়ে আনতে যখন প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সরকার রাজি হয়, তখন কারফিউ চলতে থাকে এবং জনগণের মধ্যে ক্ষোভ উচ্চ পর্যায়ে রয়ে যায়।
বুধবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বলেছে, অস্থিরতায় ঢাকা যেভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে তার কড়া সমালোচনা করে তারা। এরপরই বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন সহযোগিতামুলক চুক্তির আলোচনা স্থগিত করে তারা। দুই বছর আগে বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রায় ৪৯০০ কোটি থেকে কমে দাঁড়ায় ১৮০০ কোটি ডলারে। এমন অবস্থায় বৈদেশিক রিজার্ভ সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বাংলাদেশ। গত বছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৪০০ কোটি ডলার। তারা যে অর্থ পাঠান তাতে সরকারি ট্যাক্স থেকে এই আয় আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডজাঙ্কট ইন্সট্রাক্সটর অব বিজনেস অ্যানালাইটিসের শাফকাত রাব্বি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য তেল বিক্রি করে যেমন আয় হয়, বাংলাদেশের জন্য রেমিট্যান্সও তেমন। রেমিট্যান্স কমে গেলে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে হতাশাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
এই বর্জন আন্দোলনের আরেকজন নেতা টোকিও ভিত্তিক তৈরি পোশাকের মার্চেন্ডাইজার সাদ্দাম হোসেন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের প্রতি তিনি আহ্বান জানাচ্ছেন অস্থায়ীভিত্তিতে অর্থনৈতিক সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও দেশে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের কাছে অর্থ পাঠানো বন্ধ রাখতে। তিনি বলেন, আমি এটা করছি আমার মাতৃভূমির জন্য। শিক্ষার্থীদের হত্যা করে এই স্বৈরাচার সরকার সকল বৈধতা হারিয়েছে।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বন্ধ রাখাকে দেশদ্রোহিতা এবং দীর্ঘ মেয়াদে অবাস্তব বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, দেশে অবস্থানরত আত্মীয়রা এই অর্থের ওপর নির্ভরশীল। বৈধ চ্যানেল পরিহার করার আহ্বানের মাধ্যমে তারা অবৈধ উপায়কে উৎসাহিত করছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি রেমিট্যান্স এড়াতে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের উল্লেখ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই প্রচারণার ফলে সরকারের শীর্ষ স্থানীয় মন্ত্রীরা দেশে অর্থ পাঠাতে প্রবাসীদের অনুরোধ করছেন। কোনো কোনো ব্যাংক রেমিট্যান্স আসা বৃদ্ধির জন্য ডলারের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা এরই মধ্যে সতর্কতা দিয়েছেন যে, সাম্প্রতিক প্রতিবাদ বিক্ষোভ, কারফিউ এবং সরকারের নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ায় প্রায় ১০০০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ একটি বিনিয়োগের স্থান এমন মর্যাদা হুমকিতে পড়েছে।
বর্তমানে এটা পরিষ্কার নয় যে, কি পরিমাণ প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্স বর্জন আহ্বানে অংশ নিচ্ছেন এবং কি পরিমাণ রেমিট্যান্স কমতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, ১৯শে জুলাই থেকে ২৪শে জুলাই পর্যন্ত মাত্র ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা একদিনের রেমিট্যান্সের সমান। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাহ উল হক বলেন, বিক্ষোভের সময় ৫ দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে দ্রুত রেমিট্যান্সের এই পতন হয়ে থাকতে পারে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান বলেন, রেমিট্যান্স বর্জনের ফলে এই অবস্থা কিনা তা এখনই বলা যাবে না। কিন্তু যারা রেমিট্যান্স পাঠান তাদের ভগ্নাংশও যদি দেশে অর্থ পাঠানো থেকে বিরত থাকেন, তার মানে হবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় কম আসবে। এর ফলে দেশীয় মুদ্রা টাকার ওপর নিম্নমুখী চাপ বাড়বে। যদি রেমিট্যান্স অর্ধেক কমে যায় তাহলে বাংলাদেশ অস্বচ্ছল হয়ে পড়বে। স্থানীয় মুদ্রা ‘ক্র্যাশ’ করবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শিক্ষাবিদ রাব্বি।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট জাভেদ আখতার সতর্কতা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া সবে আসছে। বিক্ষোভ অব্যাহত থাকলে পুরো ক্ষতি আরও বড় হতে পারে। তবে সরকার আন্দোলন রুখে দিলে রেমিট্যান্স বর্জন হিতে বিপরীত হতে পারে। ঢাকা ভিত্তিক অর্থনীতিবিদ রুবাইয়াত সারওয়ার বলেন, বর্তমান অবস্থা জটিল। তীব্র চাপ রয়েছে। এটাকে সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘাত বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
No comments