রাজধানীতে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা অলিগলিতে by অমিতোষ পাল

একটি বহুতল ভবনের নকশার অনুমোদন দেওয়ার জন্য যেসব নিয়ম অনুসরণের বিধান ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় রয়েছে, সেসব অমান্য করে একের পর এক বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। যে স্থানে ছয়তলা ভবনের অনুমোদন দেওয়া যায়, রাজউক সেখানে ১৮ তলা ভবনেরও অনুমোদন দিচ্ছে। রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ভবন মালিককে সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে তারা ফুলে-ফেঁপে উঠছেন। যে কারণে রাজধানীতে অপরিকল্পিত নগরায়নে তৈরি হচ্ছে তীব্র যানজট আর বাড়ছে নগরবাসীর ভোগান্তি। দিন দিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকা। রাজউকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, একটি ভবনের নকশার অনুমোদন দিতে হলে অনেক বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। রাস্তা প্রশস্ত কম হলে সেখানে বেশি তলার নকশার অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরু রাস্তার পাশে ১৫ থেকে ২০ তলা ভবনের নকশায় অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে রাজউক। অথচ ইমারত বিধিমালা-১৯৯৬ অনুসারে ১৬ থেকে ১৮ তলা উচ্চতার ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ওই ভবনের সামনে কমপক্ষে ৬০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা থাকার বিধান রয়েছে। কিন্তু ১৫-২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার পাশেও এ ধরনের বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদন করেছে রাজউক। এমনকি এসব ক্ষেত্রে ফার (ফ্লোর এরিয়া র‌্যাসিও) অনুযায়ী ভূমি মালিকের যে পরিমাণ জায়গা ছাড়ার নিয়ম, সেটাও ভূমি মালিকরা ছাড়েননি। রাজউকের অসাধু কর্মকর্তারা ভূমি মালিকদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এ সুযোগ করে দিচ্ছেন। সেসব বহুতল ভবন তৈরির পর ওইসব এলাকায় তৈরি হচ্ছে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা।সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুরানা পল্টন মৌজার এসএ ৯৪, ৯৫ ও ৯৬ দাগের ৬১ শতাংশ জমির ওপর রাজউক নয়তলা ভবনের অনুমোদন দিতে পারে। কিন্তু সেখানে ১৮ তলা ভবনের অনুমোদন দিয়েছে। ভবনটির পাশে রাস্তার প্রশস্ততা মাত্র ৯ মিটার। রাস্তার জন্য ওই ভবন মালিককে কোনো জায়গাও ছাড়তে হয়নি। অতিরিক্ত নয় তলা নির্মাণের সুযোগ দিয়ে ভূমি মালিককে ২৩ কোটি ৮৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে রাজউকের চেয়ারম্যান কার্যালয় থেকে তৈরি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে অভিমত, এ ক্ষেত্রে ইমারত বিধিমালা অমান্য করার পাশাপাশি রাস্তায় সৃষ্ট যানজটের কারণে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে।২৯, সিদ্ধেশ্বরী রোডের সিএস ৭৭৩, ৭৯৭, ৮০৫, ৮০৬ ও ৯৭৪ নম্বর দাগের মোট তিন বিঘা ১০ শতাংশ জমির পাশে মাত্র ৪ দশমিক ৮৬ মিটার প্রশস্ত রাস্তা রয়েছে। রাস্তার প্রকৃতি অনুযায়ী ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করে ওই জমিতে ছয় তলা ভবনের নকশার অনুমোদন দিতে পারে রাজউক। কিন্তু সেখানে ১৬ তলা ভবনের নকশা অনুমোদন করা হয়েছে। জমির মালিক মো. ইলিয়াসের দাখিল করা নকশাটি ২০০৫ সালের ২০ এপ্রিল রাজউকের বোর্ড সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এ অনুমোদনের ফলে ভূমি মালিক ৮৯ কোটি ৯২ লাখ ৫০ হাজার টাকার সমপরিমাণ অর্থের সুবিধা পেয়েছেন।
৯৮, বড় মগবাজার এলাকায় ৮ কাঠা জমির ওপর রাজউক ১৮ তলা ভবনের অনুমোদন দিয়েছে। রাস্তার প্রশস্ততা ২৫ ফুট। সেখানে ছয় তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিতে পারে রাজউক। কিন্তু দেওয়া হয়েছে একটি বেজমেন্টসহ ১৮ তলার বহুতল ভবনের অনুমোদন। এর পাশেই ৯৮/১, বড় মগবাজার এলাকায় প্রায় সাড়ে ৮ কাঠা জমিতেও দেওয়া হয়েছে ছয় তলার জায়গায় বেজমেন্টসহ ১৬ তলা ভবনের নকশার অনুমোদন। সরেজমিন দেখা গেছে, এ ভবনটি তৈরি করেছে ইস্টার্ন হাউজিং নামে একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান। সেটার নাম দেওয়া হয়েছে ইস্টার্ন রমনা ভিউ। জমির মালিক ফ্ল্যাটগুলো বিভিন্ন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। একই অবস্থা ৯৮, বড় মগবাজারের জমির ক্ষেত্রেও। সেটিও তৈরি করেছে ইস্টার্ন হাউজিং। সেটার নাম দেওয়া হয়েছে ইস্টার্ন রোকেয়া টাওয়ার। এ ভবনের ফ্ল্যাটগুলোও সাধারণের মধ্যে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
রাজউকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে রাজউকের ইমারত পরিদর্শক, অথরাইজড অফিসার ও পরিচালকের (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ভূমিকা বেশি থাকে। তাদের সরেজমিন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের পারস্পরিক যোগসাজশে এমন অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। এভাবে ভবন মালিক বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে ১৪৩ কোটি ১৯ লাখ ৭০ হাজার টাকার সমপরিমাণ আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।রাজউকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, রাজউক যেসব নকশা অনুমোদন করে, সেগুলোর অনেকটার ক্ষেত্রেই এমন কাহিনী আছে। ২০০৬ সালে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার বিভিন্ন ধারা সংশোধন করা হলেও এর তেমন বাস্তবায়ন হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.