পদ্মাপাড়ে আহাজারি- কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চডুবি, ৪১ লাশ উদ্ধার by রিপন আনসারী

একের পর এক ভেসে উঠছে মৃতদেহ। কখনও শিশুর নিথর দেহ আবার কখনও নারী-পুরুষের লাশ। লাশ নিয়ে স্বজনদের আহাজারি। শোকের মাতম। এ ছিল গতকালের পাটুরিয়া ঘাটের দৃশ্য। লঞ্চডুবির ঘটনায় রাত আড়াইটায় রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ৪৩ জনের মৃতদেহ। এর মধ্যে ১৩ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে স্বজনদের কাছে। আরও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় মালবাহী কার্গো জাহাজের ধাক্কায় দেড় শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় এমভি মোস্তফা। পাটুরিয়া ঘাট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার অদূরে ১৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায় লঞ্চটি। বিআইডব্লিউটিসির উদ্ধারকারী আইটি জাহাজ দিয়ে কোন রকম লঞ্চটিকে বেঁধে রাখা হয়। রাতে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ঘটনাস্থলে পৌঁছে ডুবন্ত লঞ্চ উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে। এর আগে দুপুরের পর ঢাকা থেকে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার তৎপরতা চালালেও উদ্ধারকারী জাহাজ ছাড়া লঞ্চটি উদ্ধার সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করেন। মর্মান্তিক লঞ্চডুবির ঘটনায় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গভীর শোক জানিয়েছেন। লঞ্চডুবির ঘটনায় প্রথমে স্মৃতি নামের ৬ মাস বয়সী এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ঢাকা থেকে রওনা হয়ে পাটুরিয়া লঞ্চে উঠে শিশু কন্যা, স্ত্রী ও শাশুড়িকে নিয়ে গাড়িচালক ফারুক আহমেদ যাচ্ছিলেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের আদর্শ গ্রামে। কোনক্রমে ফারুক বেঁচে উঠলেও স্ত্রী ও শাশুড়ি এখনও নিখোঁজ। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার শাওড়াকান্দি গ্রামের সোহরাব হোসেন গাজীপুর থেকে স্ত্রী রীনা বেগম ও ১ বছরের ছেলে জুনাইদকে নিয়ে যাচ্ছিলেন বাড়ি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সোহরাব বলেন, আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন কারে নিয়া বাঁচুম বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।
লঞ্চে থাকা যাত্রী রুমা খাতুনের স্বজন আবুল কাশেম জানান, রুমার ৭ বছরের ছেলে উৎসব ও দু’মাস বয়সের এক শিশু নিয়ে মানিকগঞ্জ স্বামীর কর্মস্থল থেকে রাজবাড়ী জেলার ভবানীপুর কর্মস্থলে ফিরছিলেন। এক বছর আগে রাজবাড়ীর ব্রাহ্মণদিয়া গ্রামের সাগর বিয়ে করেন রাবেয়া আক্তারকে। বিয়ের পর তারা নবীনগর থাকতেন। গতকাল নবীনগর থেকে বাড়ি ফেরার পথে লঞ্চডুবির ঘটনায় ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা রাবেয়া নিখোঁজ রয়েছেন। মানিকগঞ্জে কর্মরত ডিবি পুলিশের  সদস্য নুর হোসেনের স্ত্রী ও ৬ বছরের ছেলে ও আড়াই মাসের মেয়েকে নিয়ে রাজবাড়ী যাওয়ার পথে তিন জন নিখোঁজ রয়েছেন। এরকম প্রায় ১০০ যাত্রীর কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। লঞ্চডুবির ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নুরুর রহমানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি। এ তদন্ত কমিটিকে আগামী ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে। অন্যটি সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের  কমিটি। এ কমিটিকে ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে নার্গিস-১ কার্গোর তিন জনকে পুলিশ আটক করেছে। এরা হলেন, কার্গোর তিন লস্কর শাহীনুর রহমান (২১), শহীদুল ইসলাম (২৪) ও জহিরুল ইসলাম (২১)।
লঞ্চের যাত্রী ব্র্যাক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, তাদের বহনকারী লঞ্চটিতে প্রায় শতাধিক যাত্রী ছিল। এদিকে পাটুরিয়া লঞ্চঘাটের সুপারভাইজার জুয়েল রানা জানান, নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চে কমফোর্ট লাইনের গাড়ির প্রায় ৪০ জন যাত্রী এবং আরও অন্তত ৬০ জন যাত্রী ছিল।
নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, বিআইডাব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ড. সামসুজোহা খন্দকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এছাড়া মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক রাশেদা ফেরদৌস, পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা, রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে উপস্থিত রয়েছেন। মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা জানান, লঞ্চটি প্রায় শতাধিক যাত্রী নিয়ে পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া অভিমুখে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে মাঝ পদ্মায় কাজিরহাটগামী মালবাহী জাহাজ এমভি নার্গিস-১ এর সঙ্গে ধাক্কা লেগে লঞ্চটি ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া লঞ্চের উদ্ধার অভিযানে আসা মানিকগঞ্জের ঘিওরের ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ম্যানেজার জিহাদ হোসেন জানান, নদীতে প্রায় ১৮ ফিট পানি রয়েছে। ঢাকা থেকে একটি ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কাজ শুরু করে।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ম্যাজিস্ট্রেট সেতাবুল ইসলাম পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় অবস্থান করে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেন। এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে নিহতদের পরিবারকে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দেয়ার কথা জানান মন্ত্রী শাজাহান খান।

No comments

Powered by Blogger.