যে ১০টি কারণে সংখ্যা ৫০ বিশ্ব বিখ্যাত যে ১টি কারণে সংখ্যা ৫০ বাংলাদেশে কুখ্যাত by শফিক রেহমান

প্রাচীনকালে নাম্বার বা সংখ্যা এবং নাম্বার সিস্টেম বা সংখ্যা গণনার প্রয়োজন মানুষের হয়েছিল, দিন এবং তাদের পোষা জীব জানোয়ার, যেমন ভেড়া প্রভৃতির হিসাব রাখার জন্য। তখন হাড়, কাঠ বা শক্ত জাতীয় কোনো কিছুর ওপর দাগ কেটে মানুষ গণনা করতো। এটাকে বলা হয় ট্যালি (Tally) সিস্টেম এবং এটা এখনো ব্যবহৃত হয়। সংখ্যা দিয়ে গণনার সিস্টেম প্রথম ব্যবহৃত হয় মধ্যপ্রাচ্যে মেসোপটেমিয়াতে খৃস্টপূর্ব ৩৪০০-এ। সেই সিস্টেম ছিল ৬০ (ষাট) সংখ্যা ভিত্তিক। আধুনিক ১০ (দশ) সংখ্যা ভিত্তিক সিস্টেম প্রচলিত হয় ইজিপ্টে খৃস্টপূর্ব ৩১০০-এ।
তারপর প্রায় (৩১০০+২০১৫ = ৫১১৫) পাচ হাজার বছর জুড়ে মানুষ ১০ সংখ্যা ভিত্তিক নাম্বারিং সিস্টেমে জ্ঞান চর্চা করেছে ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটিয়েছে। এই ভিত্তিতে মানুষ ইতিহাস লিখেছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে খেলাধুলার রেকর্ড রেখেছে। এসবই রেকর্ড করা হয়েছে জিরো বা শূন্য থেকে মিলিয়ন, বিলিয়ন, টৃলিয়ন সংখ্যার হিসাবে। তবে আজকের এই লেখাটি শুধু ৫০ সংখ্যাটিকে নিয়ে।
প্রথমে জেনে নিন, যে ১০টি কারণে ৫০ সংখ্যাটি বিশ্ব বিখ্যাত হয়েছে।

সারা এপৃল মাস জুড়ে ইজিপ্টে খামসিন ঝড় বয়ে যেতে পারে। এই গরম ঝড়ের নামটি এসেছে আরবি ভাষার ৫০ শব্দটি থেকে।

পূর্ব লন্ডনে বাণিজ্যিক কেন্দ্রের একটি ভবন, ক্যানারি হোয়ার্ফ (Canary Wharf) ইওরোপের উচ্চতম বিলডিং যেখানে মানুষ থাকে। এই ভবনের ওপরাংশ দেখতে পিরামিডের মতো।

লেজেন্ডারি ইটালিয়ান রোমান্টিক জিয়াকোমো ক্যাসানোভা (১৭২৫ - ১৭৯৮) নারী জয় করতে প্রয়োজনীয় যৌনক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে পুরুষদের উপদেশ দিয়েছিলেন ব্রেকফাস্টে পঞ্চাশটি ঝিনুক (অয়েস্টার) খেতে। তবে ক্যাসানোভা জাতীয় প্রেমিকদের কামদৃষ্টি এড়াতে আমেরিকার প্রায় ৫০% নারীদের শালীনভাবে পায়ের ওপর পা রেখে অর্থাৎ ক্রস লেগেড (Cross legged) ভংগিতে বসেন।

১৯৫৯-এ হাওয়াই যোগ দেওয়ার পরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মোট অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা হয় পঞ্চাশ।

জনপ্রিয় আমেরিকান পপ মিউজিক গায়ক পল সাইমন-এর একটি বিশ্বখ্যাত গানের নাম ‘আপনার প্রেমিককে ছেড়ে দেওয়ার পঞ্চাশটি উপায়’ (Fifty Ways to Leave Your Lover)।
আরেক জনপ্রিয় আমেরিকান গায়ক ফিফটি সেন্ট (50 Cent)-কে মনে করা হয় বর্তমানে তিনি সবচেয়ে ধনী র‌্যাপ সিংগার।

স্পোর্টসের ক্ষেত্রে, কৃকেটে ৫০ রান করাকে বড় কৃতিত্ব রূপে গণ্য করা হয়। চলমান বিশ্ব কৃকেট কাপ ২০১৫-তে অস্ট্রেলিয়ায় আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে মুশফিক এবং সাকিব, দুজনই ৫০-এর বেশি অর্থাৎ হাফ-সেঞ্চুরি করে প্রশংসিত হয়েছেন (কংগ্রাচুলেশন্স মুশফিক-সাকিব। কিপ অন ব্যাটিং)।

কানাডার একটি জনপ্রিয় বিয়ারের ব্র্যান্ড নাম ল্যাবাট ফিফটি (Labatt 50)। প্রতিবেশী দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন, ‘পঞ্চাশ বছর বয়সের আগে কোনো পুরুষের উচিত নয় মদ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা তারপর তার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলে সে যদি বাড়াবাড়ি না করে তাহলে সে একটা চরম বোকা।’ (A man shouldn't fool with booze until he's fifty; then he is a damn fool if he doesn't.)

দুটি বিকল্পের মধ্যে পারফেক্ট ব্যালান্স বোঝাতে ফিফটি-ফিফটি শব্দ দু’টি ব্যবহার করা হয়।
ফিফটি/ফিফটি (Fifty/Fifty) নামে ১৯৯১-এ মুক্তিপ্রাপ্ত আমেরিকান মুভি জনপ্রিয় হয়েছিল।

পঞ্চাশ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে অন্তত আরো তিনটি হলিউড মুভির নামে। ফিফটি ডেড মেন ওয়াকিং (Fifty Dead Men Walking, ২০০৮), ফিফটি ফার্স্ট ডেটস (50 First Dates, ২০০৪) এবং ফেব্রুয়ারি ২০১৫-তে মুক্তিপ্রাপ্ত বক্স অফিস সুপারহিট মুভির নাম ফিফটি শেইডস অফ গ্রে (Fifty Shades of Grey)। এর আগে নারী লেখক ই.এল জেমস-এর এই নামের হট সেক্সি উপন্যাস বিশ্ব জুড়ে ১০ কোটির বেশি কপি বিক্রি হয়। এই মুভির ডিভিডি এখন ঢাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
১০
বিয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তিকে বলা হয় গোলডেন এনিভার্সারি। কেউ কেউ তখন এই বিয়েটাকে গোলডেন ওয়েডিং-ও বলেন। সাধারণত এই দিনে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে সোনার তৈরি কোনো গিফট দেন।
যে ১টি কারণে সংখ্যা ৫০ বাংলাদেশে হয়েছে কুখ্যাত
প্রায় পাচ হাজার বছর জুড়ে অসাধারণ সুন্দর ও শোভন সব কর্মকাণ্ডে, যেমন, বিভিন্ন অর্জন, গৌরব ও সাফল্যে, কালচার, মুভি, বই ও স্পোর্টসে, পানীয়, প্রেম ও বিয়েতে পঞ্চাশ সংখ্যাটি বিশ্ব বিখ্যাত হলেও ২০১৫-তে বাংলাদেশে এই সংখ্যাটি হয়েছে কুখ্যাত।
এর কারণ?
ম্যাডাম খালেদা জিয়া অন্তত ৫০ রাজনৈতিক নারী-পুরুষ সহকর্মীসহ ৫০ দিন অবরুদ্ধ হয়ে আছেন গুলশানে প্রায় ৫০০০ বর্গফুট বিশিষ্ট একটি দোতলা বাড়িতে। ভবিষ্যতে বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি অসাধারণ চরম মানবতাবিরোধী দুষ্কর্ম রূপে চিহ্নিত হবে। যেমনটি এখন হয়েছে অতীতে সাউথ আফৃকাতে শাদাদের শাসন আমলে রোডেন আইল্যান্ডে কালোদের নেতা নেলসন ম্যানডেলার ২৭ বছর বন্দি থাকার ঘটনাটি।
কিন্তু বর্তমানে অবরুদ্ধ ওই ৫০-ঊর্ধ্ব সংখ্যক ব্যক্তি কিভাবে তাদের দুঃসহ ৫০ দিন পার করেছেন সে বিষয়ে বাংলাদেশের পাঠকরা খুব কমই জানতে পেরেছেন।
এর কারণ?
আওয়ামী সরকারের অলিখিত এবং অঘোষিত সেন্সরশিপের ভয় মিডিয়াকে পূর্ণ গ্রাস করেছে।
বাংলাদেশে একদলীয় শাসন দূরীকরণ এবং বহুদলীয় শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ সর্বদলীয় সাধারণ নির্বাচনের দাবিতে ম্যাডাম খালেদা জিয়া যে আন্দোলন শুরু করেছেন তারই ধারাবাহিকতায় ৩ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে তিনি ও তার সহকর্মী সহযোদ্ধারা গুলশানের ৮৬ নাম্বার রোডের ৬ নাম্বার বাড়িতে অবরুদ্ধ থাকার হাফ সেঞ্চুরি বা ৫০ দিন পূর্ণ করেছেন রাত ৮.২৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫-তে। আর তার ফলে ২০১৫-র ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত মাঝ রাতে খালেদা জিয়া যেতে পারেননি শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে।
দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠা সবার কর্তব্য
এই বাড়িতে খালেদা জিয়া তার অফিস কখন থেকে শুরু করেন সেটা জানার আগে ফিরে যেতে হবে ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ মেজর জেনারেল মইন ইউ আহমেদের তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেন ক্যুর ঘটনাকালে। ওই সময়ে ৭ মার্চ ২০০৭-এ খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টে তার বাড়িতে জীবনে প্রথমবার অন্তরীণ হয়েছিলেন। এর প্রায় ছয় মাস পরে ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭-এ জেনারেল মইন অনুগত সেনারা তাকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন সংলগ্ন দ্বিতীয় সাবজেলে নিয়ে যায়। প্রথম সাবজেলে কিছুকাল ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। তখন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এডভোকেট শিমুল বিশ্বাস, সাংবাদিক-লেখক মারুফ কামাল খান এবং এই রচনাটির লেখক, গোপন তৎপরতা চালিয়ে যান। এদের সহযোগিতা করেন গোয়েন্দা বিভাগীয় জনৈক দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা যিনি মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের বিদায়ের পর নিজেও বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান নিরাপত্তার কারণে। তবে এই প্রচেষ্টায় এই লেখক শেখ হাসিনার মুক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং তার প্রচেষ্টার আপডেট শেখ হাসিনাকে পৌছে দেয়ার জন্য তিনি আওয়ামী পন্থী একটি দৈনিকের সম্পাদককে অনুরোধ করেছিলেন। সম্পাদক সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। এই লেখক তখন উভয়কেই সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, তার কারণ ছিল, তিনি মনে করতেন এবং এখনো মনে করেন, একটা ভালো সেনাতন্ত্রের চাইতে একটা খোড়া গণতন্ত্র ভালো এবং একটা ভালো গণতন্ত্র বাংলাদেশে আনার জন্য দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠা সবার কর্তব্য।
এক বছরের বেশি সময় সাবজেলে থাকার পরে ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮-এ খালেদা জিয়া মুক্ত হন।
সেদিনই বিকেল থেকে তিনি এই লেখকের বাড়ি, ১৫ ইস্কাটন গার্ডেনসে, তার অফিশিয়াল কাজকর্ম শুরু করেন। খালেদা জিয়া নিয়মিত ইস্কাটন অফিসে আসতেন তার ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে। কিন্তু এই যাত্রাপথটি ছিল ঝুকিপূর্ণ। কারণ এয়ারপোর্ট রোডের দুই পাশে বহুতলবিশিষ্ট ভবনগুলো এবং এই পথে ফার্মগেইট ও বাংলা মোটরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ফুটওভার বৃজগুলো ছিল সিকিউরিটি রিস্ক। এসব ভবনের ছাদ বা উচু তলা অথবা ফুটওভার বৃজ থেকে কোনো স্নাইপার বা শার্প শুটার অঘটন ঘটাতে পারতো যেমন ১৯৬৩-তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি নিহত হয়েছিলেন ডালাস-এ একটি বহুতল বিশিষ্ট ভবন, টেক্সাস স্কুল বুক ডিপজিটরি (ডাল-টেক্স বিলডিং) থেকে আততায়ীর গুলিতে। এই বিলডিংয়ে এই লেখক গিয়েছিলেন এবং জেনেছিলেন সেই রকম রিস্ক সম্পর্কে।
তাই ম্যাডাম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তাকর্মীরা স্থির করেন তার অফিস ১৫ ইস্কাটন গার্ডেনস থেকে তুলনামূলক নিরাপদ স্থানে ট্রান্সফার করতে হবে। মারুফ কামাল খান, শিমুল বিশ্বাস, সেই লেখক এবং আরো কয়েকজন (যারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বাড়ি খোজা শুরু করেন।
একটি বিষয়ে এরা সবাই একমত ছিলেন যে ম্যাডাম জিয়ার নতুন অফিস ভবনের কোনো নাম থাকবে না। এর আগে বনানীতে তার অফিসের নাম ‘হাওয়া ভবন’ যে নাম সেখানে তার অফিস করার আগেই ছিল বেশ বিব্রতকর হয়েছিল। তাই বাড়ি খোজাখুজির এক পর্বে বনানীর এগারো নাম্বার রোডে কুইন্স ইউনিভার্সিটির ছেড়ে দেওয়া ভবনটি উপযুক্ত হলেও সেটা ভাড়া নেওয়া হয়নি কুইন্স শব্দটির জন্য।
পরিশেষে গুলশানের ৮৬ নাম্বার রোডের ৬ নাম্বার বাড়িটি নির্বাচিত হয়। এই বাড়ির কোনো নাম ছিল না এখনো নেই। এটির টেনান্ট ছিলেন ইজিপ্টের তদানীন্তন রাষ্ট্রদূত। তিনি চলে যাবার পর এটি ডেভেলপারকে দিতে চেয়েছিলেন বাড়ির মালিক দুই ভাই, যাদের প্রয়াত পিতা ছিলেন বিএনপির এমপি। এই দুই ভাইয়ের সুবিবেচনা এবং আনুকূল্যে দোতলা ভবনটি হয় ম্যাডাম জিয়ার নতুন অফিস ভবন। ইজিপশিয়ান রাষ্ট্রদূত চলে যাবার পর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা বাড়িটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। ডেভেলপাররা বাড়ির সামনের দিকে পাইলিংয়ের জন্য কিছু খোড়াখুড়ি শুরু করেছিলেন। এই বাড়িটিকে বাসযোগ্য এবং অফিসযোগ্য করার দায়িত্ব নেন ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুর রহমান (খাই ত্রাণ দেই রুল নামে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির ভাষায় ‘বাইচান্স সম্পাদক’ মাহমুদুর রহমান এবং যে বিচারপতি চলমান বহু সংকটের জন্য অন্যতম দায়ী ব্যক্তি)।
ধীরে ধীরে বাড়িটি পরিচ্ছন্ন ও সজ্জিত হয়। সব রুমে নয় কয়েকটি রুমে এয়ারকন্ডিশনার বসানো হয়। হাওয়া ভবনে ফেলে আসা ও নষ্ট হয়ে যাওয়া ডিজেল জেনারেটরটি এনে মেরামত করা হয় এবং লোডশেডিংকে কিছু সময়ের জন্য সামাল দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পুরনো ফার্নিচার ও ম্যাডাম জিয়ার অফিস রুমের জন্য পুরনো কার্পেট আনা হয়। সব রুমে লেমন ও ডিপ ইয়েলো রংয়ের কম্বিনেশনে সাধারণ পর্দা টানানো হয়। চারটি ছোট টিভি সেট আনা হয় দোতলার জন্য দুটি এবং নিচতলার জন্য দুটি। সারা বাড়িতে একটি ছোট কিচেন করা হয়। নিচতলায় এই কিচেনে শুধু চা-কফি তৈরি এবং পিরিচ-পেয়ালা-চামচ ধোবার ব্যবস্থা করা হয়। এই কিচেনে দৈনন্দিন রান্নার ব্যবস্থা হয়নি ডেইলি ৫০ ঊর্ধ সংখ্যক মানুষের রান্না সেখানে অসম্ভব।
নভেম্বর ২০০৮-এর শেষ সপ্তাহ থেকে, অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনের সপ্তাহ পাচেক আগে থেকে গুলশানের এই বাড়ি ম্যাডাম জিয়ার অফিস রুমে কার্যকর হয়। ওদিকে পল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে সেক্রেটারি জেনারেল ও অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মীদের কাজ শুরু হয়।
উচ্ছেদ বাহিনীর হাস্যকর অজ্ঞতা
ম্যাডাম জিয়া তার একটি নিজস্ব অফিস পেয়ে খুশি হন এবং তখন থেকে শুধু সরকারি ছুটির দিন বাদে প্রতিদিনই সন্ধ্যাবেলায় তিনি এই অফিসে আসা শুরু করেন। প্রথমে তিনি আসতেন ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বনানী কাকলি রেল ক্রসিং পেরিয়ে সোজা কামাল আতাতুর্ক রোড ধরে গুলশান দুই নাম্বার গোল চত্বর পেরিয়ে।
২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের পরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ম্যাডাম জিয়াকে তার চার দশকের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের জন্য বদ্ধপরিকর হয়। এই অন্যায় প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মামলা চলার এক পর্যায়ে অনুগত আওয়ামী (সংক্ষেপে অ আ) বাহিনীর একাংশ ১৩ নভেম্বর ২০১০-এর বিকেলে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করে। সেদিন খালেদার নিজের থাকার কোনো বাড়ি ছিল না।
উচ্ছেদকারী অ আ বাহিনীর সদস্যরা জানতো না কোন রুটে এবং কোথায় খালেদা যাবেন। আমেরিকান মুভির চেইজ Chase স্টাইলে খালেদার নির্দেশে তার অভিজ্ঞ ড্রাইভার সেদিন বহু ট্রেইনিং ও বহু সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্ছেদকারী অ আ বাহিনীর ধাওয়াকারী একাধিক গাড়ির কনভয়কে দ্রুত পরাজিত করে বিকেলে গাড়ি নিয়ে হাজির হন গুলশানের এই অফিস বাড়িতে। সেই সময়ে মাত্র দুটি ক্যারিয়ার ব্যাগসহ (একটিতে ওষুধ এবং আরেকটিতে অতি প্রয়োজনীয় টয়লেটৃজ) ম্যাডাম জিয়াকে রিসিভ করেন মারুফ কামাল খান এবং এই লেখক।
খালেদা জিয়াকে অবৈধ, অমানবিক, অশালীন এবং অসভ্যভাবে তার চার দশকের বাড়ি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তারপরে তার চরিত্র হনন কর্মসূচি বাস্তবায়নে আওয়ামী সরকার কয়েক দিন ব্যাপী মিডিয়া ক্যামপেইন চালিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে তিনি সেখানে বিলাসী জীবন যাপন করতেন। বাস্তবটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। খালেদা জিয়া শৈশবকাল থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরে মানুষ হয়েছিলেন (যেটা তার প্রতিপক্ষ হননি) এবং তার ফলে বড় বাড়ি ও বিলাসসামগ্রী বিষয়ে তার আগ্রহ কখনোই ছিল না। ওই চরিত্র হনন প্রপাগান্ডায় দেখানো হয়েছিল খালেদার বাড়ির ফৃজ থেকে রেড এবং হোয়াইট ওয়াইনের দুটি বটল পাওয়া গিয়েছে। যারা ওয়াইন খান তারা জানেন, সাধারণত হোয়াইট ওয়াইন ঠাণ্ডা খাওয়া হয় এবং তাই সেটা খোলার আগে কিছুক্ষণ ফৃজে রেখে অল্প ঠাণ্ডা অর্থাৎ চিলড (Chilled) করে সার্ভ করা হয়। আর রেড ওয়াইন খাবার আগে কর্ক খুলে রুম টেমপারেচারে রাখা হয় এবং কখনোই ঠাণ্ডা খাওয়া হয় না। বরং কেউ কেউ মাইক্রোওয়েভে একটু গরম করে রেড ওয়াইন খেতে ভালোবাসেন। ওয়াইন প্রসঙ্গে একটু তথ্য দিলাম এই জন্য যে ভবিষ্যতে যদি খালেদাকে তার অফিস এবং বর্তমান আবাসস্থল থেকে আবারও উচ্ছেদ করা হয় তাহলে পাঠকরা অবশ্যই যেন সেকেন্ড রাউন্ড চরিত্র হনন সম্পর্কে প্রস্তুত থাকেন। এখানে পাঠকদের মনে পড়বে, পল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে গোপালিশ বাহিনীর হামলার পরে সেখানে কম্পিউটার ধ্বংস করা হয়েছিল এবং তাজা বোমা পাওয়ার দাবি করা হয়েছিল। সুতরাং অ আ বাহিনী আবারও যদি উচ্ছেদ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় তাহলে গুলশান অফিসের কম্পিউটার ধ্বংস করা হতে পারে এবং বোমাও পাওয়া যেতে পারে। আওয়ামী প্রচারণা প্রতিভা হয়তো আবিষ্কার করবে জঙ্গি বিএনপির গুলশান অফিসের ছাদে নিউক্লিয়ার রকেট এবং ড্রোন এয়ারক্রাফট রেডি ছিল। আমি অ আ উচ্ছেদ বাহিনীকে উপদেশ দেব তারা যেন ওভারকিল না করেন। ওয়াইন বটলের মতো ভুলের পুনরাবৃত্তি না করেন ককটেল বোমা অথবা পেট্রলবোমার পরিবর্তে অতি উৎসাহী উচ্ছেদ বাহিনী যেন গুলশান অফিসে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার ড্রোন বা রকেটলঞ্চার স্টক না দেখিয়ে দেয়। আর হ্যা, ওয়াইন বটল রাখলে, এবার শস্তা অস্ট্রেলিয়ান ওয়াইন না রেখে দামি ফ্রেঞ্চ ওয়াইন, মার্লো (রেড) এবং শাবলি (হোয়াইট) রাখবেন। তাতে অ আ বাহিনীর পরিচালকদের শিক্ষা ও রুচিবোধ জানা যাবে।
বাই দি ওয়ে, ১৩ নভেম্বর ২০১০-এ খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করার পরে সেখানে পাওয়া আমার হাতে লেখা একটি চিঠির কপি উচ্ছেদ বাহিনী প্রকাশ করেছিল। এই চিঠি ছিল অক্টোবর ২০০১-এর নির্বাচনের আগে ম্যাডামকে তার ভাষণ সম্পর্কিত আট-দশ লাইনের সাজেশন। এখন আমি সম্ভাব্য উচ্ছেদ বাহিনীকে অনুরোধ করবো আমার কোনো লেখা বের করার জন্য সময় নষ্ট না করতে। কারণ, আমার বিবেচনায় অক্টোবর ২০০১-এর পর বাংলাদেশে যেসব সাধারণ নির্বাচন হয়েছে তার ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল এবং সেসব নির্বাচন বিষয়ে আগাম সাজেশন দেওয়া পণ্ডশ্রম হতো। তাই কোনো চিঠি আমি আর লিখিনি। সরি, ফোকস।
মনের মতো বাড়ি
গুলশান অফিসে কাজ শুরু করার পরে ধীরে ধীরে ম্যাডাম জিয়া তার নিজের রুচি অনুযায়ী ওপরতলায় কার্টেইন, কার্পেট, ফার্নিচার ও লাইটসও বদলানো শুরু করেন। প্রথমে তিনি থাকতেন গুলশানে লেইক শোর হোটেলের কাছে তার ভাইয়ের ফ্ল্যাটে। অর্থাৎ, গুলশানের অফিসটাই ছিল তার ব্যক্তিগত স্থান। সুতরাং ব্যক্তিগত আবাসস্থল না পাওয়া পর্যন্ত গুলশান অফিসই হয় তার বাড়ি যেখানে তিনি দীর্ঘ রাত পর্যন্ত নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিটিং করতেন এবং মাঝে মাঝে রেস্ট রুমে একটি ছোট ডিভানে রেস্ট নিতেন। নতুন নীল রংয়ের কার্টেইন, শাদা কার্পেট এবং একাধিক টেবিল ল্যাম্পে তিনি গুলশান অফিস সাজান। ফার্নিচার হয় কিছুটা হেভি। দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মিটিং রুমে টিক ও গ্লাসের চার কোনা সেন্টার টেবিলটা হয় বেশ বড়। এখানে প্রতিদিন ফ্রেশ ফ্লাওয়ারের আগমন হতে থাকে। ম্যাডামের খাস অফিস রুম, যেটা ছোট, সেখানেও সেন্টার টেবিলে নিয়মিত ফ্রেশ ফ্লাওয়ারের ব্যবস্থা হয়। তার এই দুটি রুমের কার্পেট হয় শাদা রংয়ের, যে রংটি তার সবচেয়ে প্রিয়। শ্যান্ডলিয়ের বা ঝাড়বাতি এবং উগ্র বাতি ম্যাডামের অপ্রিয়। তার হবি হচ্ছে টেবিল ল্যাম্প কালেকশন যেখানে শেডের নিচ থেকে নম্র আলো ছড়িয়ে পড়ে রুমে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে উচ্ছেদ হবার সময়ে ম্যাডামের দুশ্চিন্তা ছিল তার কালেকশনের টেবিল ল্যাম্পগুলোর কি হবে এবং শাদা কার্পেটের কি দুরবস্থা হবে, গুলশান অফিসে ম্যাডামের মিটিং এবং অফিস রুমে কার্পেটের শাদা রং রক্ষার জন্য কিছু অংশে ট্রান্সপারেন্ট প্লাস্টিক কভার দেওয়া হয় এবং অতিথিদের অনুরোধ করা হয় জুতা খুলে ঢুকতে।
ওপরতলায় ম্যাডাম জিয়া যে রুমে স্ট্যানডিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে মিটিং করেন, সেখানে কনফারেন্স টেবিলের মাঝখানে মিনি পাম টৃর চারা আছে। মিটিংয়ের সুবিধার্থে সেখানে কোনো ফ্লাওয়ার ভাস (Vase) রাখা হয় না।
দোতলার দুটি দেওয়ালে ম্যাডাম তার প্রয়াত স্বামীর ফটো স্থাপন করেন এবং তার পাশেই তার নিজের দুটি ফটোও স্থাপিত হয়। এ ছাড়া অন্য স্থানে তার দুই ছেলে, তারেক ও আরাফাতের ছবিও স্থাপিত হয়। ২০০৯ এবং ২০১০-এ মিডিয়াতে অতি সমালোচিত তারেক ও আরাফাতের ছবি তখন অফিসে স্থাপন করাটা ছিল ম্যাডামের দৃঢ় ইচ্ছার প্রতিফলন। বিএনপির কিছু শীর্ষ নেতা এবং কর্মী, তাদের মতে সঙ্গত কারণেই, চাননি তার দুই ছেলের ছবি অফিসে টাঙ্গানো হোক। গুলশান অফিসে গুঞ্জরিত হতে থাকে কেন ম্যাডাম তার দুই ছেলের ছবি অফিসে টাঙ্গালেন? বিদেশি অতিথিরা, বিশেষত যারা ডেইলি স্টার পড়ে আসেন তারা অফিসে এসে দুই ‘ভিলেইনে’র ছবি দেখবেন? কিন্তু তারা কেউই সাহস করে তাদের আপত্তি ম্যাডামকে জানাতে পারেননি।
প্রসঙ্গটি একদিন সবিনয়ে উত্থাপন করায় ম্যাডাম জিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওনার (জিয়ার) মৃত্যুর পর থেকে আমি আমার এই দুই ছেলে, তাদের বৌ আর নাতনিদের নিয়েই বাড়িতে ছিলাম। বাড়িতে তাদের ঘিরেই ছিল আমার জীবন। তারা কেউই আজ আমার পাশে নেই। তাদের সবাইকে বিদেশে থাকতে হচ্ছে। এখন গুলশানের এই ঠিকানাই আমার অফিস এবং বাড়ি দুটিই। তাই এই ভবনটি আমি সাজিয়েছি। এখানেই তো আমি বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছি। কিন্তু ওরা কোথায়? ওরা আছে। দেওয়ালে ছবির মধ্যে আছে। ওদের দেখলে কিছুটা শান্তি পাই।’
খালেদা জিয়ার প্রতিপক্ষ নেত্রী সিমপ্যাথি পলিটিক্স বা সহানুভূতি আদায়ের রাজনীতিতে পারদর্শী, অশ্রু বিসর্জনে পটিয়সী এবং সহমর্মিতা অর্জনে পরিশ্রমী। খালেদা জিয়ার চারিত্রিক অবস্থান এর সম্পূর্ণ বিপরীতে। তিনি ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কথা খুব কম বলেন। আর তাই গুলশানের অফিসে দুই ছেলের ছবি টাঙিয়ে তাদের প্রতি এক মায়ের শাশ্বত টানের আর কোনো ব্যাখ্যা খালেদা তার দলীয় নেতাকর্মীদের দেননি।
এই প্রসঙ্গটি এখানে উল্লেখের কারণ হলো, সম্প্রতি শেখ হাসিনা একাধিকবার প্রকাশ্যে প্রশ্ন করেছেন, উনি (খালেদা জিয়া) কেন অফিসে থাকেন? উনি কেন গুলশান অফিস ছেড়ে নিজের বাড়িতে যাচ্ছেন না?
আশা করি শেখ হাসিনা এখন বুঝবেন, গুলশানের অফিস, খালেদার শুধু অফিসই নয় বাড়িও বটে। তা ছাড়া খালেদা কোন গৃহে কখন থাকবেন সেটা নির্দেশ দানের ক্ষমতা তার নেই। বরং শেখ হাসিনা এটা ভেবে খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানাতে পারেন যে কেন তিনি (খালেদা) দাবি তোলেন নি যে, অনির্বাচিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও হাসিনা কেন গণভবন ছেড়ে সুধা সদনে যাচ্ছেন না। কারণ গণভবন তার অফিসও নয় বাড়িও নয়।
লেইক শোরের ফ্ল্যাট থেকে পরে খালেদা জিয়া গুলশানের ৭৯ নাম্বার রোডের ১ নাম্বার বাড়ি থেকে স্বল্প দূরে ৮৬ নাম্বার রোডের ৬ নাম্বার বাড়িতে এই অফিসে যাতায়াত শুরু করেন।
এভারেস্টের চাইতেও বড় মিথ্যাবাদী
অবরোধের ৫০ দিনের প্রথম পর্যায়ে গুলশানে রোড ৮৬-র বিভিন্ন স্থানে ইট ও বালির একাধিক ট্রাক এবং অ আ বাহিনীর জলকামান এনে খালেদা জিয়ার অফিসের চারদিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। আওয়ামী নেতারা তখন টিভিতে বারংবার বলতে থাকেন, খালেদা প্রায়ই তার অফিসে ও বাড়িতে মেরামতের কাজ করান। এ জন্যই এই ট্রাকগুলো সেখানে এসেছে এবং এ সব ট্রাক সেখানে উপস্থিত হওয়ার দায়-দায়িত্ব তাদের নয়।
কিন্তু টিভিতে ওইসব ইট ও বালির ট্রাক ড্রাইভাররা তাদের ইন্টারভিউতে বলেন, বনানীর কাছাকাছি থেকে অ আ বাহিনীর নির্দেশে তাদের গুলশানে নিয়ে আসা হয় এবং এ জন্য তারা কোনো ভাড়া অথবা পারিশ্রমিক পাননি। তারা দুশ্চিন্তায় ছিলেন তারা খাবার ও পানি পাবেন কিনা সে বিষয়ে।
এভারেস্টেরও উচ্চতার পরিমাপ সম্ভব। কিন্তু আওয়ামী নেতাদের মিথ্যা কথনের কোনো পরিমাপ সম্ভব নয়।
কিভাবে ৫০ দিন কেটেছে
৩ জানুয়ারি ২০১৫-তে খালেদা জিয়া জানতেন না যে গুলশানের এই বাড়িতেই তাকে অবরুদ্ধ হতে হবে এবং পঞ্চাশ দিন কাটাতে হবে।
কিভাবে তার এই দিনগুলো কেটেছে এবং কাটছে?
এখানে প্রকাশিত গুলশান অফিস ভবনটির দুই তলার ফ্লোর চার্ট প্রকাশিত হলো। বলা বাহুল্য, সেখানে এই সময়ে কোনো আর্কিটেকটকে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই আমার স্মৃতি থেকে যতোটা সম্ভব ওই ভবনের ফ্লোর প্ল্যান আমি বুঝিয়ে দেই জনৈক তরুণ আর্কিটেকটকে (বর্তমানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। আমার বর্ণনার ভিত্তিতে এই তরুণ আর্কিটেকট (মেনি থ্যাংকস) ফ্লোর প্ল্যানটি একেছেন। ফলে কিছু ভুলভ্রান্তি এখানে থেকে যেতে পারে।
তা সত্ত্বেও এই ফ্লোর প্ল্যান থেকে পাঠকরা বুঝবেন একটানা ৫০ দিন মাত্র প্রায় ৫০০০ স্কোয়ার ফিটের একটি বাড়িতে ৫০ ঊর্ধ্ব সংখ্যক ব্যক্তির অবরুদ্ধ হয়ে থাকাটা কতো কঠিন।
নিচ তলা : গ্রাউন্ড ফ্লোর প্ল্যান
টিভি দর্শকরা সাধারণত বন্ধ মেইন গেইটের ছবি দেখতে পান। এটি অ আ বাহিনী বা অনুগত আওয়ামী বাহিনী (গোটা পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সশস্ত্র বাহিনীকে দায়ী করা অনুচিত হবে) বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। সাধারণত ভিজিটররা ছোট গেইট দিয়ে ভবনের প্রাঙ্গনে ঢোকেন। এই ছোট গেইটের বাইরে অনুগত আওয়ামী বাহিনী খাতাপত্র নিয়ে বসে আছে। কে ভেতরে গেল এবং বাইরে এল এসব তারা খাতায় লেখে। কেউ পানি অথবা খাবার নিয়ে গেলে এরা বাধা দেয় এবং ‘ওপরের নির্দেশ আছে’ বাক্যটি উচ্চারণ করে সাধারণত ভদ্রভাবে আগন্তুকদের ফিরিয়ে দেয়। তবে বেবি নাজনীনের মতো সেলিবৃটি হলে তাকে গুলশান থানাতেও নিয়ে যেতে পারে। এত কাছে থেকে বেবি নাজনীনের মতো নিরপেক্ষ নন এমন সেলিবৃটিকে দেখার সুযোগ অ আ বাহিনী হাতছাড়া যে করতে চায় না তাতে অবাক হবার কিছু নেই।
৩ জানুয়ারি ২০১৫তে অবরুদ্ধ হবার আগে খালেদা জিয়ার শাদা নিসান গাড়ি মেইন গেইট দিয়ে ঢুকতো এবং বেরুতো। এই গাড়ি গারাজে নয় কার পার্কে থাকে। মেইন গেইট দিয়ে ঢোকার পরে ডান দিকে পরিত্যক্ত গারাজে বসানো হয়েছে ডিজেল জেনারেটর যার কথা আগেই বলেছি। এটি পাওয়ারফুল জেনারেটর এবং এটা দিয়ে পুরো ভবনের সব এসি, লাইট ও কম্পিউটার চালু রাখা সম্ভব।
গাড়ি পার্কিং প্লেস থেকে তিন সিড়ি ওপরে রিসেপশন বারান্দা। এখান থেকে ম্যাডাম জিয়া ঘোরানো সিড়ি দিয়ে ওপরে যান। ম্যাডামের হাটুর সমস্যা থাকায় সিড়িতে উঠতে তার কিছুটা অসুবিধা হয়। তাই অন্য নেতা-কর্মী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের সঙ্গে মিটিং নির্ধারিত থাকলে তিনি ওপর তলায় না উঠে, সরাসরি নিচতলার বৈঠকরুমে বসেন। এই রুমে একটা ছোট কাঠের মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। তবে সেখানে সাধারণত ম্যাডাম বসেন না।
এই রুমে একটি সার্কুলার টেবিল আছে যার চারপাশে বিশিষ্ট অতিথিরা বসেন। এই রুম ও তার পাশের রুমের দেওয়াল ভেঙ্গে কাঠের ফ্লেক্সিবল পার্টিশন করা হয়েছে। ফলে পাশের রুমে সব টিভি ক্যামেরা ও টিভি কর্মীদের সংকুলান হয়। টিভি ক্যামেরা রুমের পেছন দিকে একটা ছোট দরজা আছে। এই দরজার অবস্থানটি জেনে নিলে অ আ বাহিনীর সম্ভাব্য আকস্মিক আক্রমণের সময়ে সাংবাদিক ও ক্যামেরা ক্রুরা দ্রুত প্রস্থান করতে পারবেন।
নিচ তলায় আছে আরো দুটি রুম। একটিতে বসেন অফিসের প্রশাসনিক কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ (আইজিপি) আবদুল কাইয়ুম। যিনি ছাত্রকালে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন এবং প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন। তার বিশেষ গর্ব, তার আইজিপি থাকাকালে তিনি ক্রসফায়ার জাতীয় অবৈধভাবে কাউকেই মৃত্যুমুখে ঠেলে দেননি। আর্থিকভাবে সৎ বলে তার সুখ্যাতি আছে। খুব দুঃখজনক বিষয় যে তার সভ্য, মানবিক আচরণ, নৈতিকতা এবং আর্থিক সততা পরবর্তীকালে তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে খুব কম দেখা গেছে।
২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত আপাত স্বাভাবিক সময়ে কাইয়ুম আসতেন উত্তরায় তার বাড়ি থেকে। এখন ৩ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে তিনি গুলশানে অবরুদ্ধ আছেন এবং সেই ভবনটির সার্বিক প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন। তবে তিনি খুব লো প্রোফাইলে থাকতে পছন্দ করেন। তাই টিভি দর্শকরা খুব কমই তাকে দেখেছেন। তাহলে একজন আইজিপি কাইয়ুমের কোনো দোষই কি নেই?
হ্যা, আছে। তিনি ধূমপান করেন তবে কম এবং লাইট নিকোটিনের সিগারেট।
এই রুমে তার পাশে বসতেন সাবেক আমলা ও রাষ্ট্রদূত সাবিহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বিএনপির ফরেইন এফেয়ার্স কমিটির সক্রিয় সদস্য।
১০ জানুয়ারিতে তার শাদা ড্যাটসান মোটরকার দুর্বৃত্তরা গুলশান অফিসের কাছেই পুড়িয়ে দেয়।
বৃটিশ হাইকমিশনার মি. রবার্ট গিবসন যখন অবরুদ্ধ ম্যাডাম জিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন, তখন, সাবিহউদ্দিন তার সঙ্গে গুলশান অফিসে যান। কিন্তু তিনি ফিরে আসতে পারেন নি। দুই দিন অফিসে তিনি অবরুদ্ধ ছিলেন। এখন তিনি মিডিয়া-ফোকাস থেকে দূরে আছেন।
একইভাবে স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য মি. নজরুল ইসলাম খান যখন সফরকারী ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যদের নিয়ে যান ম্যাডাম জিয়ার সঙ্গে দেখা করাতে, তখন তিনিও আটকে যান এবং এই লেখার সময় পর্যন্ত তিনিও সেখানে অবরুদ্ধ আছেন।
এই রুমে আরো বসেন (ডেস্ক শেয়ার করে) ইঞ্জিনিয়ার জসিম উদ্দিন। উদ্যমী এবং উদ্যোগী এই তরুণ ইঞ্জিনিয়ারকে এখানে নিয়োগ দিয়েছিলেন মাহমুদুর রহমান। দুই যমজ শিশু কন্যা সন্তানের পিতা জসিমও অবরুদ্ধ আছেন এই ভবনে যাদের কথা তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন। তিনি তার দুই নয়নমনি ও স্ত্রীকে ছেড়ে গুলশান অফিসের ইঞ্জিনিয়ারিং দিক (কম্পিউটিং, জেনারেটর, এসি, ওয়াটার সাপ্লাই) প্রভৃতি দিক সচল রাখছেন। এ ছাড়া এই রুমে আছেন কমপিউটার অপারেটর হুমায়ুন কবির। নিচতলার এই রুমে দুজন অতিথি বসতে পারেন। বলা বাহুল্য অনেক অতিথি এখানে আসেন যার ফলে অনেক অফিশিয়াল কাজ বিঘিœত হয়। অ আ বাহিনী যদি গুলশান অফিস এটাক করে তাহলে হুমায়ুনের কম্পিউটার থেকে আওয়ামী মস্তিষ্কপ্রসূত বিভিন্ন “সাংঘাতিক ইসলামী জেহাদি এবং দেশদ্রোহিতামূলক” ই-মেইল ইত্যাদি আবিষ্কৃত হবে এবং সেসব নিরপেক্ষ টিভিতে ভবিষ্যতে প্রচারিত হতে পারে। ভিউয়ার্স, ইউ হ্যাভ বিন ওয়ার্নড!
গুলশান অফিসের প্রেস বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত মারুফ কামাল খানের খুব ছোট অফিসটি নিচ তলায় অবস্থিত। এখানে ঠাসাঠাসি করে সর্বোচ্চ পাচ অতিথি বসতে পারেন। একটা সচল ছোট টিভি এবং একটা অচল ফটো কপিয়ার আছে এই রুমে। আর আছে মারুফ কামাল খানের বেনসন অ্যান্ড হেজেস নিঃসৃত ধোয়া, যেটা তার জন্য খারাপ, তার গেস্টদের জন্যও খারাপ। পঞ্চাশ দিন একটানা অবরুদ্ধ থাকার ফলে খালেদা জিয়ার পরেই সবচেয়ে বেশি হেলথ রিস্কে আছেন মারুফ কামাল খান। গত তিন বছরে বিভিন্ন চিকিৎসার জন্য ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে বহুবার এবং সিংগাপুরে দুইবার তাকে থাকতে হয়েছিল।
এ ছাড়া নিচের তলায় কাজ করেন প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান ও শামসুদ্দিন দিদার এবং অন্যান্য স্টাফ। এদের সবার জন্য এই ফ্লোরে আছে দুটি টয়লেট। এই ফ্লোরে হাটাহাটির জায়গা বলতে আছে চার অথবা পাচ ফিট চওড়া একটা ছোট করিডোর।
দোতলা : ফার্স্ট ফ্লোর প্ল্যান
এবার আমার সঙ্গে চলুন ঘোরানো সিড়ি বেয়ে দোতলায়।
দোতলায় উঠলে ডান দিকে দেখবেন চেয়ারপার্সনস সিকিউরিটি ফোর্স, সংক্ষেপে সিএসএফ (CSF) -এর রুম। ম্যাডাম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা সমন্বয়কারী সাবেক সেনা কর্মকর্তা সুদর্শন আবদুল মজিদ ও তার সহকর্মীরা এই রুমে থেকে সিকিউরিটি মনিটরিং স্কৃনে নজর রাখেন বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে কি হচ্ছে। সিএসএফ-এর এই রুমটি গাড়ি পার্কের ঠিক ওপরে আগে এটি ছিল এই বাড়ির একমাত্র বারান্দা বা ব্যালকনি। পরে থাই গ্লাস দিয়ে ব্যালকনিকে পরিবর্তিত করা হয় রুমে। ফলে গ্রীষ্মকালে রুমটি খুব গরম হয়ে যায়।
এই রুমের বিপরীতে আছে স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিং রুম। এখানে একটি সার্কুলার টেবিলের চারপাশে বসেন স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা। সাধারণত এই রুমটি ব্যবহার করেন বিশিষ্ট অতিথিরা এবং বিএনপির নেতারা ওয়েটিং রুম রূপে। এখান থেকে তাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় ম্যাডাম জিয়ার অফিস রুমে।
এই রুমের পরে আছে একটি অফিস রুম যেটা প্রথমে নির্ধারিত হয়েছিল এই লেখক, মাহমুদুর রহমান এবং সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরীর জন্য। শেষোক্ত দুজন এখন জেলবন্দি। এখন এই লেখকের ডেস্কটি ব্যবহার করছেন চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। এ ছাড়া এই রুমে আট জন অতিথি বসার স্টিল ফার্নিচার আছে।
এই রুমের বিপরীতে একটি ছোট রুমে আছে কিছু কম্পিউটার ও ইন্টারনেট কানেকশন। এই রুমটি কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়। এসব রুমের শেষ প্রান্তে আছে একটি টয়লেট।
স্ট্যান্ডিং কমিটি রুমের পরে আছে আরেকটি অফিস রুম যেখানে বসেন ম্যাডামের সহকারী (জিয়াউর রহমানের ভ্রাতুষ্পুত্র) ডিউ। এই রুমে আছে কয়েকটি ফাইলিং ক্যাবিনেট। আর আছে একটি এটাচড টয়লেট।
এর পরেই আছে বিশিষ্ট অতিথিদের মিটিং রুম যেখানে ঢুকতে হয় লবি থেকে সরাসরি। ঢোকার আগে সিএসএফ সদস্যদের কাছে রেখে দিতে হয় ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন। এই ডিগনিটারি রিসেপশন রুমের ছবি সাধারণত দর্শক পাঠকরা দেখেন। ম্যাডাম খালেদা জিয়া এই রুমে রিসিভ করেন দেশ বিদেশ থেকে আগত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের, যেমন রাষ্ট্রদূত ও বিদেশি ডেলিগেটদের। এই রুমের দেওয়ালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ও ম্যাডাম খালেদার ছবি ছাড়াও আছে বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার কিছু অয়েল পেইনটিং। আর আছে বাংলাদেশ ও বিএনপির ফ্ল্যাগ।
এই ফ্লোরে কোনো কিচেন বা কুকিং স্পেইস নেই। ফলে অতিথিদের চা-কফি-স্ন্যাকস সার্ভ করতে হয় নিচতলা থেকে সযতেœ ওপর তলায় এনে। এই কাজটি করেন স্বপন এবং এনাম। ম্যাডামের অভিরুচি অনুযায়ী এরা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ফিটফাট খাবেন। এদের হাতে প্লাস্টিক গ্লাভস থাকে পরিবেশনের সময়ে।
ডিগনিটারি রিসেপশন রুমের পরেই আছে ম্যাডাম জিয়ার অফিস। এখানে ছোট একটা ডেস্ক ব্যবহার করেন খালেদা যার ওপরে একটি ফুলদানিতে আছে ধানের শীষ। তার বসার চেয়ারের পেছনে আছে প্রয়াত স্বামী ও নিজের ছবি এবং বাংলাদেশ ও বিএনপির ফ্ল্যাগ। এ ছাড়া দেওয়ালে আছে কয়েকটি অয়েল পেইনটিংয়ে গ্রামীণ বাংলার দৃশ্য। সেন্টার টেবিলে আছে ফ্রেশ ফ্লাওয়ার ভাস। এই রুমে চার পাচজন অতিথি বসার জন্য দুটি সোফা আছে। একটি সোফা আছে ম্যাডামের জন্য। তবে তিনি কদাচিৎ সোফায় বসেন। সাধারণত তিনি চেয়ারে বসেন এবং অতিথিরা স্টিল চেয়ারে (দুটি কাঠের) বসেন। এই রুমে আছে একটি ছোট ফ্ল্যাট স্কৃনের টিভি।
এই অফিস রুমের সঙ্গেই এটাচড লম্বাটে রেস্ট রুম যেখানে কোনো জানালা নেই, শুধু একটা সরু ডিভান পাতা সম্ভব সেখানে। ধারণা করছি এই ডিভানেই খালেদা জিয়া তার পঞ্চাশটি রাত কাটিয়েছেন। এই রুমের সংলগ্ন আছে একটি টয়লেট।
দোতলায় খালেদা জিয়ার সাহচর্যে আছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান যিনি এক পর্যায়ে নিচে গেইটে এসে অ আ বাহিনীকে দৃপ্তভাবে জানিয়ে দেন, জেলখানাতেও বন্দিদের পানি ও খাবার ব্যবস্থা হয় - কিন্তু অবরুদ্ধ রোড ৮৬-র ৬ নাম্বার বাড়িতে সেটা হচ্ছে না। তিনি জানতে চান এর কারণ কি?
অ অ বাহিনী নিরুত্তর থেকেছে।
অ আ বাহিনীর নেত্রীও নীরব থেকেছেন।
অ আ বাহিনীর গুলশান কর্মকর্তারা বলেছেন তারা খাবার ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি জানেন না।
তাহলে সেলিমা রহমানের প্রশ্নের উত্তরটি কে জানে?
সাগরেরও সীমানা আছে, কিন্তু এদের নির্লজ্জার সীমানা নেই।
দোতলায় আরো আছেন মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা।
এ ছাড়া খালেদা জিয়াকে সার্বক্ষণিক পরিচর্যা ও সাহায্যের জন্য আছেন তার বুয়া ফাতেমা যাকে নিয়ে তিনি বিদেশেও যান।
বর্তমান অবস্থা
এবার ভেবে দেখুন কিভাবে মাত্র ৫০০০ স্কোয়ার ফিটে ৫০ দিন কাটিয়েছেন ৫০ অথবা তার উর্ধ্ব সংখ্যক ব্যক্তিরা? যেখানে কিচেন মাত্র একটি (তা-ও সব রান্নার জন্য অনুপযুক্ত), টয়লেট মাত্র পাচটি, যেখানে নেই কোনো বারান্দা-ব্যালকনি, যেখানে নেই হাটাচলার কোনো স্পেইস, যেখানে নেই কোনো লন্ডৃ রুম এবং যেখানে নেই কোনো বেডরুম।
কিন্তু যেখানে আছে ইলেকটৃসিটি লাইন কেটে দেওয়ার সম্ভাবনা (৩১ জানুয়ারি ভোর রাত দুটো থেকে ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত ইলেকটৃসিটি লাইন কেটে দেওয়া হয়েছিল)। যেখানে আছে ওয়াটার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা (ইলেকটৃসিটি না থাকলে ওয়াটার পাম্প চলবে না)। যেখানে আছে অনাহার ও অভুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা।
বিভিন্ন পত্রিকার সূত্রে জানা যাচ্ছে ম্যাডাম জিয়ার সহ-অবরুদ্ধরা ড্রাই খাবার যেমন, চিড়া, মুড়ি, গুড়, খেজুর খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু এই খাবারের স্টক কতো দিনের? সম্প্রতি জি-নাইন নামে একটি রিসার্চ গোষ্ঠির প্রেসিডেন্ট এডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান এবং জেনারেল সেক্রেটারি ড. সায়ন্থ সাখাওয়াৎ কেএফসির ফ্যামিলি বাকেট খাবার ম্যাডাম জিয়া ও তার সহযোদ্ধাদের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। অ আ বাহিনী তাদের বলেছিল, খাবার নিয়ে ভেতরে যেতে পারেন, তবে বাইরে ফিরে আসার কোনো নিশ্চয়তা তারা দিতে পারবে না। (ওপরের নির্দেশে?)। এরপর জি-নাইন টিম সেই খাবার ভেতরে পৌছে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে ফিরে আসেন।
আজ এই লেখাটি লেখার সময়ে জি-নাইনের অপর এক সদস্য এভিয়েটর রেজাউর রহমান, যিনি এক সময়ে এয়ার ফোর্সে ছিলেন, তিনি জানান, তিনি এবং সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কিছু অফিসার ও তাদের স্ত্রীরা অবরুদ্ধদের জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু অ আ বাহিনী তাদের ফিরিয়ে দেয় এবং কোনো খাবারই গুলশান অফিসে পৌছাতে দেয় না।
‘তোমাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো’ ৭ মার্চ ১৯৭১-এর শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের এই অংশটি ৪৪ বছর পরে বাস্তবায়িত করতে প্রতিজ্ঞ হয়েছে তার অনুসারীরা - তবে পাকবাহিনীকে মারতে নয় - বাঙালিদের মারতে।
জি-নাইন, বেবি নাজনীনসহ আরো অনেকে যারা পানি ও খাবার নিয়ে গুলশান অফিসে গিয়েছেন, তাদের দৃষ্টান্ত অনুকরণীয়। প্রতিদিনই সহমর্মিদের উচিত হবে সেখানে পানি ও খাবার নিয়ে যাওয়া। এক পর্যায়ে প্রতিরোধকারী অ আ বাহিনী বাধ্য হতে পারে পানি ও খাবার ভেতরে পৌছে দিতে।
প্রসঙ্গত মনে পড়ছে বিশ্ব শ্রদ্ধেয় কংগ্রেস নেতা মোহন দাস করমচাদ গান্ধির একটি কাহিনী।
তিনি লন্ডনে ব্যারিস্টার হবার পরে সাউথ আফৃকাতে আইন পেশা শুরু করেছিলেন। একবার তিনি সেখানে ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসে ভ্রমণ করছিলেন। তখন শ্বেতাঙ্গ শাসিত সাউথ আফৃকার কোনো ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে কোনো কালো বা ব্রাউন যাত্রীর উপস্থিতি ছিল অকল্পনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য। ফার্স্ট ক্লাসে সেই সময় আরেকটি মাত্র যাত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন শ্বেতাঙ্গ। ট্রেন চলা শুরু হবার কিছু পরে গান্ধির দিকে তাকিয়ে ওই শাদা লোকটি কম্পার্টমেন্টের মেঝেতে ঘৃণাভরে থুথু ফেললেন। গান্ধি কিছু না বলে সেই থুথু একটা রুমালে মুছে তুলে নিলেন। শাদা লোকটি কিছুক্ষণ পর আবারও একই কাজ করলেন। গান্ধি আবারও তার রুমালে থুথু মুছে তুলে নিলেন। এভাবে তিনবার যখন ওই শাদা লোকটি মেঝেতে থুথু ফেললেন তখন তিনবারই গান্ধি তার থুথু তুলে নিলেন।
শাদা লোকটি নৈতিক পরাজয় মেনে চতুর্থবারে চলমান ট্রেনের জানালার বাইরে থুথু ফেললেন। গান্ধিও মৃদু হেসে তার রুমালটি বাইরে ফেলে দিলেন।
হয়তো অ আ বাহিনী এমন সংশোধনী আচরণ করবে না। তবুও তাদের পরীক্ষা করে দেখতে পারেন খালেদা ভক্তরা।
শিগগিরই গরম পড়বে।
তখন এই অবরোধবাসিনী ও অবরোধবাসীদের দুর্দশা চরমে উঠতে থাকবে।
আমাদের তথা বিশ্ববাসীর চোখের সামনেই এটা ঘটছে এবং ঘটবে।
আমরা দেখছি ২০১৫-তে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দুর্দমনীয় লক্ষ্যে ৫০ ব্যক্তি যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে লড়াই করছেন। যেটা আমরা লক্ষ্য করিনি ১৯৭১-এ। তখন আওয়ামী নেতারা আত্মসমর্পন করেছিলেন অথবা পলায়ন করেছিলেন  কোনো যুদ্ধক্ষেত্রেই আওয়ামী নেতারা দৃশ্যমান ছিলেন না।
দেশবাসীর একমাত্র কর্তব্য
২০১৫-র গণতন্ত্র লড়াইয়ে গুলশানে বিএনপির নেত্রী ও তার সহযোদ্ধারা দৃশ্যমান। বাংলাদেশের বহু বীরত্ব গাথার মধ্যে চিরকালের মতো সংযুক্ত হয়ে গিয়েছে তাদের নাম।
আশা করা যায় এই অবরুদ্ধ বীর যোদ্ধারা ৫০ সংখ্যার কলংক মোচনে সফল হবেন।
ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এদের নাম?
না।
বাংলাদেশে বিকৃত ইতিহাস রচিত হয়।
যে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন আওয়ামী লীগ প্রণীত ইতিহাসে তাকে পাকিস্তানি গুপ্তচর বলা হয়।
এই বিকৃত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে এদের নাম লেখানোর জন্য এরা লড়াই করছেন না।
এরা লড়াই করছেন প্রকৃত বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সত্য ইতিহাস দেশবাসীকে দেওয়ার জন্য।
তাই এই মুহূর্তে দেশবাসীর একমাত্র করণীয় হলো ম্যাডাম খালেদা জিয়ার আন্দোলনের ডাকে সদা সচেতন থাকা, সদা সক্রিয় হওয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সফল হওয়া।
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

No comments

Powered by Blogger.