ঢাকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার সফর

(গণভবনে শনিবার সকালে সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান- পিআইডি) ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক দিনটি সামনে রেখে ঢাকা এসেছিলেন তিনি। থাকলেন তিন দিন। এ সফরকে রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের মোড়কে ফেলা যায় না, অফিসিয়াল বা আনুষ্ঠানিক বলাও চলে না। কিন্তু ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এ সফরকে ঘিরে আবেগ, উৎসাহ, ঔৎসুক্য এবং সর্বোপরি প্রত্যাশা_ কোনো কিছুরই ঘাটতি ছিল না। গতকাল শনিবার তার সফরের সমাপ্তি ঘটার পর অনেকেই হয়তো স্বতঃস্ফূর্ততায় বলে উঠেছেন_ এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। মমতা কথায় ও কাজে যেন একেবারেই মমতাময়ী। তিনি গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন, প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নিয়ে তার সঙ্গে করেছেন সৌজন্য সাক্ষাৎ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিহিত করেছেন বড় বোন হিসেবে, বলেছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যার কাছ থেকে ছোট বোনের মতো স্নেহ পেয়ে ধন্য তিনি। আলোচনায় মমতা বন্দোপাধ্যায় বাংলাদেশ থেকে ইলিশ কম যাচ্ছে বলায় প্রধানমন্ত্রী কিছুটা কৌতুকছলেই বলেছেন, পানি এলে ইলিশও যাবে। একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান চলার এক পর্যায়ে শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের বিরল সম্মান লাভ করে পরিতৃপ্ত হয়েছেন। তিনি যেসব অনুষ্ঠান, সংলাপ বা ঘরোয়া আড্ডায় অংশ নিয়েছেন, প্রতিটিতে ছিলেন স্বভাবসুলভ সাবলীল, প্রাণবন্ত ও উচ্ছল। বারবার বলেছেন, আমি তোমাদেরই লোক। বলেছেন_ বাংলাদেশ আমারও দেশ, এখানে আসা মানে নিজের দেশেই আসা। এ দেশের স্বার্থ গুরুত্ব দিয়ে দেখে থাকেন তিনি। বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা চুক্তি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাকালে বলেছেন, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষা করে অচিরেই এ চুক্তি সম্পাদনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন তিনি। বলেছেন তিস্তার বিষয়ে তার ওপর আস্থা রাখতে। সৌহার্দ্যপূর্ণ এ বৈঠকে তিনি আরও জানিয়েছেন, ভারতের লোকসভার আসন্ন অধিবেশনেই যাতে দুই দেশের সীমান্ত সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদিত হয় সে জন্য ক্ষমতাসীন বিজেপি, কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসসহ সব দলের সমঝোতা হয়েছে। দীর্ঘদিনের এ সমস্যার সমাধান বাংলাদেশ তার তরফে সবকিছু করেছে, একথা বলতেও তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন না। এটা ঠিক যে, তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তি চূড়ান্ত করার বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাই মুখ্য। কিন্তু বাংলাদেশে তিস্তা প্রবেশ করেছে পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে। ছিটমহল নিয়ে যে বিরোধ তার সঙ্গেও যুক্ত পশ্চিমবঙ্গ। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে এ বিষয় দুটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রধানত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। এ কারণে বাংলাদেশের জনগণ হতাশ ও ব্যথিত হয়েছে। অনেকের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। তার রাজনৈতিক উত্থানপর্বে বাংলাদেশের জনগণ তার প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি জানিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বিপুলভাবে জয়ী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় প্রটোকল উপেক্ষা করেই তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এবারের সফরে তার আগের অবস্থান অনেকটাই দূরীভূত বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনে হয়েছে। হয়তো তিস্তার বিষয়ে আরেকটু দ্ব্যর্থহীন তিনি হতে পারতেন। গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রায় শুষ্ক তিস্তা নিয়ে যে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই তার নজরে এসে থাকবে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সমসাময়িক বিশ্বে এক ব্যতিক্রমী নেতা তিনি। যে কোনো সমস্যার গভীরে সহজেই চলে যেতে পারেন। বাংলাদেশের তিস্তাতীরের মানুষের কান্না তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন। আশা করব, বাংলাদেশের স্বার্থকে গুরুত্ব প্রদানের যে কথা তিনি বারবার উচ্চারণ করেছেন, তার ধারাবাহিকতায় দ্রুতই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে তিনি দিলি্লতে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রতি বাড়িয়ে দেবেন সহযোগিতার হাত। নিজ রাজ্যের স্বার্থ সংরক্ষণে তার আগ্রহ স্বাভাবিক। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করতে চাই তার উক্তি_ মনের সম্পর্কও ভাগাভাগি করা যায় না। তিনি শুভেচ্ছা সফরে এসেছিলেন, রেখে গেলেন আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার স্বাক্ষর। জয় করে গেলেন বাংলাদেশের মন। এখন একটিই প্রত্যাশা_ আশ্বাসের পূর্ণ বাস্তবায়ন। কথাকে কাজে পরিণত করার জন্য নেওয়া হোক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

No comments

Powered by Blogger.