কৃষকের কান্না ক্রেতাদের হাহাকার- হরতাল-অবরোধের প্রভাব বাজারে

টানা অবরোধ আর হরতালের প্রভাবে অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার। সরবরাহে ঘাটতি থাকায় প্রতিদিনই বাড়ছে কোন না কোন পণ্যের দাম। জমি থেকে ফসল বিক্রি করতে না পারায় মাথায় হাত পড়েছে অনেক কৃষকের। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফসল বিক্রি করতে পারলেও পাওয়া যাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত দাম। অন্য দিকে বাড়তি ভাড়া দিয়ে কাঁচা পণ্য বাজারে এলেও বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এমন ভারসাম্যহীন অবস্থা বিরাজ করছে বাজার ব্যবস্থায়। নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে নিম্ন ও সাধারণ আয়ের মানুষের দুর্ভোগ। গত কয়েক দিনে মাছ-মাংসের সঙ্গে দাম বেড়েছে চাল, ডাল, পিয়াজসহ আরও অনেক নিত্যপণ্যের। বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি দেশী পিয়াজ ৪০ টাকা বিক্রি হলেও শনিবার ৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়া মাছ, মাংস, কাঁচামরিচসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। কয়েকটি পণ্য মওসুম ফুরিয়ে যাওয়ায় দর অনেক চড়া। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে এসব চিত্র দেখা গেছে। রাজধানীর খুচরা বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি কাঁচামরিচের দাম বেড়েছে ২০-৩০ টাকা। ৩০ টাকার কাঁচামরিচ কেউ ৫০ টাকা আবার কেউ বিক্রি করছে ৬০ টাকা। এছাড়া বিদেশী রসুন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০০ টাকায় ও দেশী রসুন বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। বাজারে এখন নতুন পিয়াজ বেচাকেনা হচ্ছে। তাই দর কমার কথা। কিন্তু পণ্যবাহী পরিবহনে আগুন দেয়ার ঘটনায় আমদানি ঝুঁকি ও খরচ বেড়েছে। যার প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে। গরুর মাংসের কেজি ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৩২০ টাকায়। এছাড়া সব ধরনের চালের দাম গত কয়েক দিনে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে জানান, খুলনার বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা গেছে, সরবরাহ কম হওয়ায় নিত্যপণ্যের মধ্যে চালসহ ভোজ্য তেল, পিঁয়াজ, রসুন ও কাঁচা মরিচের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। দাম বেড়েছে অন্যান্য পণ্যের। অবরোধের আগে যেসব পণ্যের দাম ছিল কেজি প্রতি ১০-১৫ টাকা। এখন বেশি দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। খুলনাসহ আশপাশের যেসব জেলা থেকে পণ্য আসত সেগুলো সময়মতো আসতে না পারায় দাম বাড়ছে কাঁচা তরকারির। চালের দাম গত এক সপ্তাহের চেয়ে কেজি প্রতি ২-৩ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিনিকেট গত সপ্তাহে ছিল প্রতি কেজি ৫০ টাকা। যা বর্তমানে ৫২ টাকা। এ ছাড়া মোটা চাল ৩২-৩৪, আঠাশ বালাম ৩৯-৪১, কাজল লতা ৪০-৪৩, নাজির শাইল ৫২-৫৫ এবং আতপ ৩৮-৪২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৯৫ টাকা তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৫ টাকা। দেশী মসুরের ডালের দাম ছিল ১শ’ টাকা, বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকা। আমদানি করা মসুরের ডালের দাম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৬ টাকা। তবে বাজারে সব থেকে বেশি সঙ্কট তৈরি হয়েছে পিয়াজ ও ভোজ্যতেলের। বাইরে থেকে কোন ধরনের পিয়াজ আসতে পারছে না। গত সপ্তাহে যে পিয়াজ কেজিপ্রতি খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ২২-২৪ টাকা, সপ্তাহ না ঘুরতেই সেই পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩২ টাকায়। একইভাবে রসুনের দাম ছিল ৭০-৭৫ টাকা। তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫-১শ’ টাকায়। দাম বেড়েছে হলুদের। ৮০ টাকার হলুদ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে কাঁচা মরিচ। এছাড়া টমেটো, শিম, পালং শাক, ফুলকপি, লাউসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ৫-৮ টাকা হারে।
মহিউদ্দিন জুয়েল, চট্টগ্রাম থেকে জানান, সরজমিনে খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে গত এক মাসের হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে একদিনে তাদের ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ৩০ দিনের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। চাল, ডাল, সয়াবিনসহ একাধিক পণ্যে ইতিমধ্যে আমদানি কমে আসছে বলে অনেকে জানান। সারা দেশে ভোগ্যপণ্যের ৭০ শতাংশের জোগানদাতা চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। যার বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্য কনটেইনারের মাধ্যমে আসছে চট্টগ্রামের বন্দর দিয়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মহাসড়কে পণ্যবাহী গাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনায় সারা দেশে সরবরাহ কমে যাচ্ছে। একইভাবে নিরাপত্তার অভাবে অনেকে বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতে পারছেন না। সর্বশেষ ৩০ দিনের হরতালে দাম ওঠানামা করেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের। যার রেশ এখনও চলছে বলে জানান সাধারণ মানুষ। বর্তমানে মসুর ডাল কেজিতে ২০-২৫ টাকা, ধনিয়া ২০০-২৬০ টাকায়, হলুদ ১০০-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে চালের দাম বেড়েছে খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ৩-৪ টাকা। খোলা সয়াবিনের দাম প্রতি লিটারে বেড়েছে ১০-১৫ টাকা। কন্টেইনার লিটারে সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৫ টাকা।
আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, টানা অবরোধ-হরতালে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় কিশোরগঞ্জে উৎপাদিত সবজি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। তারা উৎপাদিত সবজি ও কৃষিপণ্যের মূল্য না পেলেও বাজারে এর তেমন প্রভাব পড়ছে না। একই অবস্থা পোলট্রি খামারিদের। অবরোধ-হরতালের কারণে পোলট্রি খাদ্য ও ওষুধের দাম বাড়লেও সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়ায় দাম পাচ্ছেন না তারা। জেলার বিভিন্ন বাজারে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১১৫-১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিম প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ৮৪-৯০ টাকায়। তবে দাম বেড়েছে গরু ও খাসির মাংসের। গরুর মাংস ৩২০-৩৪০ টাকায় এবং খাসির মাংস ৫৫০-৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, অবরোধ-হরতালে বাইরে থেকে গরু-ছাগল সরবরাহ কমে যাওয়ায় স্থানীয় খামারিদের ওপর তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে। এ কারণে গরু ও খাসি বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। জেলা সদরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি আলু ২০-২৫ টাকা, টমেটো ১৫-২০ টাকা, শিম ২৫-৩০ টাকা ও মরিচ ৩০-৩৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি লাউ ২৫-৩০ টাকা, ফুলকপি ১৫-২০ টাকা ও বাঁধাকপি ১৫-২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম গত সপ্তাহের মতো স্থিতিশীল রয়েছে। চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। কেজিতে ৫-১০ টাকা বেড়েছে ডালের দামও।
আসলাম-উদ-দৌলা, রাজশাহী থেকে জানান: শুক্রবার পবার নওহাটার সবজির পাইকারি বাজারে বেগুন ২৫০ টাকা, ফুলকপি ও বাঁধাকপি ২শ’-২৫০ টাকা মণ। অথচ খুচরা বাজারে বেগুন ১২-১৫ টাকা, মূলা ৮-১২ টাকা, ফুলকপি ৮-১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। সবজি চাষিরা বলছেন, সবজি পচনশীল দ্রব্য হওয়ায় অনেক সময় মাঠে থাকতেই অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার সেই সবজি বাজারে নিয়ে বিক্রি করলেও শ্রমিক খরচ ওঠে না। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। গতকাল নগরীর স্থানীয় বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ফুলকপি ৮-১০, বাঁধাকপি ৮-১০ টাকা, শিম ১০-১২, প্রতি কেজি গাজর ১০, বিভিন্ন রকম শাক ১৪ থেকে ১৫, আলু ১০-১২, বেগুন ১৫, কাঁচামরিচ ৩০-৩২, পেয়াজ ৩৫-৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে আঠাশ চাল ৩৭ টাকা বিক্রি হলেও এই সপ্তাহে দাম বেড়ে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা, মিনিকেট ৪৬ টাকা, পারিজা ৩৫ টাকা এবং হাইব্রিড (মোটা চাল) ২৮ টাকা কেজি দরে। অন্যদিকে তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ১০ টাকা। মসুর ডাল ১১৫, মটর ৭২-৮০, অ্যাঙ্কর ডাল ৪০ ও খোলা আটা ৩০-৩২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
জিয়া শাহীন, বগুড়া থেকে জানান, হরতাল-অবরোধের কারণে সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বগুড়ার ফতেহ আলী ও রাজাবাজার ঘুরে জানা যায়, নাজিরশাইল চাল আগে ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন হচ্ছে ৫৪ টাকা দরে। মোটা চাউল ৩৩ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এখন ৩৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মসুরের ডাল আগে ১১০ টাকা দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে ১১৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বুট ৫৬ টাকার স্থলে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পিয়াজ ৩৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন ৪৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বেগুন ২০ টাকার স্থলে ৩২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচ ২৪ টাকার স্থলে ৩২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে খোলা সয়াবিন ও আলুর দাম ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে।
ইসহাক আলী, নাটোর থেকে জানান, শুক্রবার নাটোরের বাজারে প্রতিকেজি নতুন পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪০-৪৫ টাকা দরে। প্রভাব পড়েছে মাছ মাংসের বাজারেও। প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম এখন সাড়ে ৩শ’ টাকা অবরোধের আগে যা ছিল ২৮০-৩০০ টাকা, দেশী মুরগির মাংস ৩০০ টাকার জায়গায় এখন সাড়ে ৩শ’ টাকা দিয়েও মেলা ভার। খাসির মাংস ৪০০ টাকার জায়গায় এখন সাড়ে ৪শ’ টাকা। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া একদিকে শুষ্ক মওসুম হওয়ায় বিলে পানি না থাকায় বাজার এখন অনেকটাই মাছশূন্য। শুক্রবার নাটোরের মাদরাসা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশী মাছের মধ্যে পাবদা-বড় বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি এক হাজার টাকা থেকে ১২০০ টাকা, ছোট সাড়ে ৮০০-৯০০ টাকা,  টেংড়া বড় ৭শ’ টাকা, ছোট ৪শ’-৪৫০ টাকা, টাকি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৩০০-৩৫০ টাকা, বিলের চিংড়ি ৪০০-৪৫০ টাকা। গুচি বাইম বড় ৪০০-৪৫০, ছোট ২৫০-৩০০ টাকা, বাইম বড় ৭শ’ টাকা, দেশী পুঁটি বড় দেড়শ’ টাকা থেকে ২০০ টাকা। মাঝারি বোয়াল ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা, বড় সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০ টাকা। শিং মাছ ৭০০-৭৫০, মাগুর ৭০০-৮০০ টাকা কেজি। এছাড়া পুকুরের কৈ ১৫০-২৫০ টাকা। সিলভার কার্প আর পাঙ্গাশ ১৫০-২০০ টাকা। সবজির বাজার ঘুরে দেখা যায়, শিম বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১০ টাকা এবং ফুলকপি ৫ টাকা কেজি, বাঁধাকপি ৫ টাকা করে। এছাড়া বেগুন ২০ টাকা, করলা ৬০ টাকা,  খিরা ২০ ও শসা ২০ টাকা কেজি। আদা ১৪০ এবং রসুন ৭০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আলু ১০ টাকা, পেঁপে ১০ টাকা ও কাঁচামরিচ ৪০-৪৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। লাল শাক বিক্রি হচ্ছে প্রতি আঁটি ২ থেকে আড়াই টাকা। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা কেজিতে। হাঁস ও দেশী মুরগির ডিম ৩৬-৪০ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে। আর লেয়ার মুরগির ডিম ২৫-২৮ টাকা হালি।

No comments

Powered by Blogger.