ইরাকে জিম্মি- সন্তানের প্রতীক্ষায় মায়ের বুকফাটা আহাজারি

মায়ের আর্তনাদ। বাকরুদ্ধ পিতা। স্বামীর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকানো প্রিয়তমা স্ত্রী। প্রতারণার মামলা করে ভীত-সন্ত্রস্ত ভাই। এ অবস্থা ইরাকে জিম্মি ১৮০ জন বাংলাদেশীর স্বজনদের। তাদের আর্তনাদ, হাহাকার আর বুকফাটা কান্নায় গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের হলরুমে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। জিম্মির স্বজনদের সংবাদ সম্মেলন পরিণত হয় শোকাতুর মানুষের সমাবেশে। আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে বাতাস। দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে জিম্মিদের ফেরত আনতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কাকুতি-মিনতি জানান স্বজনরা। এদিকে আগামী ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগে জিম্মিদের ফেরত আনার দাবি করেছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা। দুপুরে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে ছেলের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন মা। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ছোট মাছুয়া গ্রামের জাকিয়া বেগম চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন ‘আমি কিছুই চাই না। আমার একমাত্র ছেলেরে ফেরত চাই। ওর শোকে গেল মাসে বাপটাও মইর‌্যা গ্যাছে। ট্যাকা গেছে যাক, আমার গর্ভের ধনরে আপনারা দ্যাশে আইনা দ্যান।’ ডায়াসে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলতে বলতেই সংজ্ঞা হারান তিনি। পরে অন্যরা ধরাধরি করে মুখে পানি ছিটিয়ে তার সংজ্ঞা ফেরান। জাকিয়া জানান, তার একমাত্র ছেলে রুবেল শাহ গত ৭ মাস ধরে ১৭৯ জন হতভাগ্য বাংলাদেশীর সঙ্গে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় ইরাকের নাজাফে একটি ঘরে বন্দির মতো রয়েছে। তাদের ঠিকমতো খেতে দেয়া হয় না। দিনে ২টা রুটি, রাতে শুধু একটা কলা খেয়ে কাটছে তাদের দিন। ছেলের এমন দুরবস্থার কথা শুনে এক মাস আগে রুবেলের পিতা আবুল শাহ মারা গেছেন। মানবাধিকার সংগঠন রাইটস যশোর, শিক্ষা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম ও বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ (বামাসপ) বিপদগ্রস্ত এসব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে রাইটস যশোর-এর নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক লিখিত বক্তব্যে বলেন প্রতারণার শিকার জিম্মি ওই ১৮০ জনের অনেককেই কাতারে ভাল বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ২২শে মে ইরাক নিয়ে যায় একটি রিক্রুটিং এজেন্সি। সেখানে নিয়ে গিয়ে তাদের কাছে থাকা সকল বৈধ কাগজপত্র এবং মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নেয়। প্রতারণার প্রতিবাদ করলে এজেন্সির লোকেরা তাদের হুমকি দেয় এবং বিকল্প কোন উপায় নেই বলে জানায়। বাধ্য হয়ে সেখানে তারা কাজ করতে রাজি হলেও কোন কাজ না দিয়ে বিগত ৭ মাস ধরে আটকিয়ে রেখেছে। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, ইরাকে যাওয়ার জন্য বিএমইটি’র ছাড়পত্র, মেডিক্যাল রিপোর্ট, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ কোম্পানির লোকেরা করেছে। এমনকি ভুক্তভোগী ১৮০ জনকে শুধু কোম্পানির নাম জানানো হয়। ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে বিনয় কৃষ্ণ দাবি করেন ইরাক যাওয়ার আগে এজেন্সি তার পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে সকলকে জড়ো করে। তখন বলা হয়, কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন। কিন্তু সেটা না করে আকস্মিকভাবে তাদের জানানো হয় প্লেনের সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি না গেলে তারা প্লেন মিস করবেন। সে কারণে সবাইকে তড়িঘড়ি করে কন্ট্রাক্ট পেপারে সই করিয়ে নেয় তারা। ভুক্তভোগীরা জানতেও পারেনি তাতে কি লেখা ছিল। এসব দায় এড়াতে এজেন্সি বিভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে বলেও তিনি জানান। ওই সংবাদ সম্মেলনে অর্ধশতাধিক জিম্মি পরিবারের লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
তারা বলেন- তাদের কেউই গত দেড় মাস ধরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। বরং দু’একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তারা দুর্ভোগের কথাই বলছেন। স্বজনদের প্রত্যেকেই দাবি করেন, ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় কাতারে চাকরি দেয়ার কথা বলে ইরাকে পাচার করে দেয়া হয়েছে। অসহায় এসব মানুষকে দেশে ফেরত এনে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ কিংবা চুক্তি অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা করতে সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা। জিম্মি ইঞ্জিনিয়ার সিদ্দিকের ভাই জাভেদ বলেন, কিছুদিন আগে তার ভাইসহ ১৬ জনকে আলাদা করে আটক করে রাখা হয়েছে। তাদের ওপর চালানো হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের পর গত ১১ই নভেম্বর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্যে তাদেরকে ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোন আলামত লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি বলেন, কোন কথা বললেই ফাঁকা গুলি ছুড়ে তাদেরকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, তারা এমন কথা শুনছেন যে ক্রীতদাস হিসেবে তাদের বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। তিনি জিম্মিদের ফেরত আনার দাবি জানিয়ে বলেন এক শ্রেণীর কর্মকর্তা সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য এ ধরনের কাজ করছে। জিম্মি রুবেলের মা বানু আরা খাতুন কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘আমি আপনাদের কাছে আমার ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাই। তাকে পেশাব-পায়খানার পানি খেতে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন- বহু কষ্টে ধার দেনা করে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা দালালদের দিলেও এখন আমার এক পয়সা-কড়িরও দাবি নাই। শুধু সন্তানকে ফেরত চাই।’ রূপগঞ্জের মমতা ম-ল বলেন, ‘তার স্বামী জিম্মি দশরথ ম-ল কান্নাকাটি করছেন সেখানে। তিনি তাকে জানিয়েছেন কোন কথা বললেই তারা মারধর করে। তিনি বলেন, আদম ব্যাপারীর কাছে গেলে সে বলে তার কিছু করার নেই।’ গাজীপুরের বাদল মোল্লার মা কিছু বলতে চাইলেও কাঁদতে কাঁদতে কোন কথা বলতে পারেননি। কাপাসিয়ার মাজেদা সুদে টাকা নিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন ভিক্ষা করে হলেও ছেলেকে কাছে রাখবো। কোন দাবি নাই, শুধু ছেলেকে ফেরত চাই। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মাহিনা জানান, তার জামাই (মেয়ের স্বামী) ১০ বছর গার্মেন্টে কাজ করে কিছু টাকা জমান। সব টাকাই মার গেল। বিদেশে টাকা আয় করার স্বাদ মিটে গেছে। এখন তিনি তার মেয়ের জামাইকে ফেরত পেতে চান।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার জিয়াউর রহমান বলেন- তার ভাই ফোনে দুর্ভোগের কথা বললে কোর্টে মামলা করেন তিনি। কিন্তু কয়েকদিন পর থানার ওসি আসামিকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যায়। এখন তিনি বাড়িতেও ঘুমাতে পারেন না। এছাড়া, অপরিচিত নম্বর থেকে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। তার বাবা-মা বলেন এক ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে হারিয়েছি, এখন মামলা করে আরেক ছেলেকেও হারাতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক বলেন, ৬ মাস ধরে তারা সেখানে আটক আছেন। থানার ওসি থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিয়েও তারা কোন ফল পায়নি। সব আশা ছেড়ে দিয়ে এখন তারা শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ আশা করছেন। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন- আমিও তাদের পক্ষ থেকে করজোড়ে আপনার কাছে মিনতি করছি আপনার হস্তক্ষেপ ছাড়া কিছু হবে না। তিনি বলেন, সব দেখে মনে হচ্ছে এদেশ থেকে ইনসাফ চলে গেছে। এটা চলে গেলে তো কিছুই থাকে না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, আপনি কোন সরকার চালাচ্ছেন- যে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানও দুর্বলদের পাশে দাঁড়ায় না? তিনি বলেন- আমরা আশা করবো ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগেই এর একটা সুরাহা হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আবরার, বামাসপ-এর এএইচএম নোমান প্রমুখ।
উল্লেখ্য, ইরাকের নাজাফ শহরের আবু তোরাব এলাকায় গত মে মাস থেকে জিম্মি জীবন কাটাচ্ছেন ওই ১৮০ বাংলাদেশী। ইতিমধ্যে তাদের কয়েকজনকে সেখান থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ারও অভিযোগ ওঠেছে। এ ব্যাপারে বারবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করা হলেও এখনও ওই সব কর্মীকে কাজ দেয়া হয়নি বা ফেরত পাঠানোর কারণ ব্যবস্থা করা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.