অনিয়মই বহাল রইল by আবুল কাসেম ফজলুল হক

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়েছে। এ নিয়ে দুজন শিক্ষাবিদের মতামত ছাপা হলো।
জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া কিছু দিন আগে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তার সঙ্গে সংগতি রেখেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন ও পাস করা হয়েছে। শিক্ষা এখন বাণিজ্যিকীকৃত হয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষানীতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনেও বাণিজ্যিকীকরণের এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা বা সংযত করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। বাণিজ্যিকীকরণের যা যা ক্ষতিকর দিক আছে, তার সবই এখানে দেখা যায়। যাঁরা বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালান, তাঁরা পুঁজি বিনিয়োগ করেন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। শিক্ষাকে এ রকম পুঁজির পণ্যে পরিণত রাখা সরকারের দিক থেকে উচিত নয়। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির সঙ্গে সংগতি রেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ব্যবসায়িক প্রবণতা সরকারের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল। মনে হয়, সরকার চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছে। জনগণের দিক থেকে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য ভিন্ন রকম চাপ সৃষ্টি করা হলে ফল অন্য রকম হতো। সে ব্যাপারে উদ্যোগ আসার কথা দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক-চিন্তাবিদ ও জ্ঞানসাধকদের পক্ষ থেকে। কিন্তু বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হিসেবে যাঁরা সমাজের অভিভাবকত্ব করেন, তাঁদের বেশির ভাগের মধ্যেই সে রকম চিন্তাভাবনা, এমনকি প্রবণতাও নেই। ছাত্ররাজনীতির যে রূপ, তার মাধ্যমেও এমন কোনো চাপ সৃষ্টি হয় না, অথবা চিন্তাভাবনা দেখা দেয় না, যাতে অবস্থার উন্নতি হতে পারে।
একাডেমিক স্বাধীনতা বলে যে ব্যাপারটি বোঝানো হয়, তা মূলত পাঠ্য বিষয়, পাঠ্যক্রম ইত্যাদি স্থির করার স্বাধীনতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত ও জ্ঞানগত কাজকর্মের স্বাধীনতাও এর সঙ্গে জড়িত। সেসব ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সরকার হস্তক্ষেপ করতে চায়নি বলে বর্তমান আইন দেখে মনে হয়েছে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং কাজ করে যাবে, তা সরকার বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের আওতায় অন্তত কিছুটা নির্ধারণ করে দিতে পারত। যেমন, আজকের বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায়ও জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি অবলম্বন করা অপরিহার্য। বাস্তবে দেখতে পাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিয়েও এর ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারী ভাব চলছে। তাতে উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা পাচ্ছে না, জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও উন্নতি হচ্ছে না। ঢাকা-রাজশাহী-চট্টগ্রাম-জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের যে মনোভাব দেখতে পাই, তাতে দেখি, শিক্ষকদের আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রভৃতি দল করার স্বাধীনতাকেই চূড়ান্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন-সংক্রান্ত চিন্তার স্বাভাবিক বিকাশ নয়, বিকার মাত্র। যাঁরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন প্রবর্তন এবং শিক্ষানীতি প্রণয়নের সঙ্গে আছেন, তাঁরা এসব ভালো করেই জানেন। কিন্তু তাঁরা কাজ করেন নিতান্তই পুঁজিপতিদের স্বার্থে ও বাজারি মানসিকতায়। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, তাঁরা কাজ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বদৃষ্টির অনুসারী হিসেবে। দেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধ সেখানে কথার কথা মাত্র।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছাত্র-শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য আর্থিক ব্যাপারে ন্যায়বিচারের স্বার্থেই সামঞ্জস্য বিধান করা সরকারের কর্তব্য ছিল। সেদিকে সরকারের মনোযোগের পরিচয় নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, বামপন্থী রাজনীতিবিদদের দিক থেকেও সে সম্পর্কে বাস্তবসম্মত ও যুক্তিসংগত সমালোচনা লক্ষ করা যায় না। আসলে অর্থনৈতিক ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ অপরিহার্য।
এটা লক্ষ করার বিষয়, চাকরিমুখী কিছু বিষয়ই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। অর্থকরী কিছু দিক ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৃষ্টিশীল দিকের প্রতি দৃষ্টি নেই। শিক্ষার্থীদের নৈতিক বিকাশের প্রতিও দৃষ্টি নেই। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও নেওয়া হয় অনেক বেশি বেতন। টাকার বিনিময়ে অনেক ক্ষেত্রে ভালো সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষা এবং সমাজের যে ক্ষতি হয়, তার প্রতিবিধানের উপায় করা উচিত ছিল। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে যুক্ত পুঁজিপতিদের চাপে সরকার তা করতে পারেনি।
সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একই ধরনের না হয়ে বিভিন্ন দিকে তাদের শিক্ষা কর্মকাণ্ড বিভক্ত ও বিকশিত করতে পারত। সরকারি নীতির মাধ্যমেই তা নির্ধারণ করা উচিত ছিল। সে ব্যাপারেও সরকার দৃষ্টি দেয়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, নতুন আইন নিয়ে আগামী ১০ কিংবা ২০ বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে এগুলো যে ইতিবাচক উন্নতি করবে, তা আশা করা যায় না। নতুন আইন করার আগে যে অনুচিত ব্যাপারগুলো ছিল এবং অপব্যবস্থার সুযোগ ছিল, সেগুলোই আইনের মাধ্যমে এখন কিছুটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হলো।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: লেখক ও অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.