পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ -মত দ্বিমত সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়েছে। এ নিয়ে দুজন শিক্ষাবিদের মতামত ছাপা হলো। by মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ নামে যে বিলটি পাস হয়েছে, তা অত্যন্ত জরুরি ছিল। কেননা ১৯৯২ সালে যে আইনটি পাস করা হয়েছিল তাতে অনেক দুর্বলতা, অসংগতি ও অসম্পূর্ণতা ছিল। একই সঙ্গে এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ আইন বলেও আমি মনে করি। এর মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।
এ আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। আগে যেকোনো ব্যক্তি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারতেন। নতুন আইনে বলে দেওয়া হয়েছে, উপাচার্য হতে হলে শিক্ষার সঙ্গে অন্তত ২০ বছর যুক্ত থাকতে হবে এবং এর মধ্যে ১০ বছর শিক্ষকতা করতে হবে।
উপাচার্যকে সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। অন্যদিকে উদ্যোক্তারা অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান থাকবেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা-পয়সা জোগাড় করেন উদ্যোক্তারা। সে ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্য থেকে অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান হওয়াই যুক্তিসংগত। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। আইনে অ্যাক্টিভেশন কাউন্সিল গঠনের কথাও বলা হয়েছে। এই কাউন্সিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নির্ধারণ করবে।
তবে এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদারকি বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন পাস হয় ১৯৭৩ সালে। তখন কিন্তু দেশে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, সব কটি ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের আইনটি পর্যালোচনা করে বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে অনেক কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা প্রয়োজন। এর ক্ষমতা ও জনবল বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ফির প্রশ্নও সামনে এসেছে। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখন বড় সমস্যা, ভালো শিক্ষক পাওয়া। ভালো শিক্ষক পেতে হলে ভালো বেতন দিতে হবে। আর ভালো বেতন দিতে হলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেশি ফি নিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আইনে কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ছয় শতাংশ শিক্ষার্থীকে বিনা বেতনে পড়ানোর কথা বলা আছে, যারা মেধাবী, দরিদ্র ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
এ প্রসঙ্গে আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির কথা বলতে পারি। সেখানে বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকা বৃত্তি দেওয়া হয়। তা ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বেতনের বাইরেও অনেক সুযোগ-সুবিধা পান, তাঁদের বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বেতন ছাড়া অন্য কোনো সুবিধা পান না।
নতুন আইনে আরেকটি কথা বলা হয়েছে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত শিক্ষা দিতে না পারলে সরকার সেটি বন্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু এর সঙ্গে তদারকি কাজ বাড়াতে পারলে শিক্ষার মানও বাড়বে। কিন্তু আইনে এ কথা বলা নেই, তিন-চার বছর পর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবে। আমি মনে করি, তাদের অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকা উচিত, না হলে তাদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ধরে রাখতে টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু টাস্কফোর্স তো খণ্ডকালীন। আমার পরামর্শ হলো, জাতীয় এডুকেশন কাউন্সিল গঠন করার, শিক্ষানীতিতে যার কথা উল্লেখ আছে।
এ জাতীয় এডুকেশন কাউন্সিল সরকারি-বেসরকারি—সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান নির্ধারণ এবং গ্রেডিং করবে। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে যেমন গ্রেডিং হবে, তেমনি বিষয়ভিত্তিকও। তাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বুঝতে পারবেন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়টির মান কতটা উন্নত।
সার্বিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনকে আমি একটি পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ আইন বলেই মনে করি।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: প্রতিষ্ঠাতা-উপাচার্য, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি।

No comments

Powered by Blogger.