ভাষার রাজনীতি, রাজনীতির ভাষা by সৌরভ সিকদার

সভ্যতার বিবর্তনের ধারায় মানুষ রাজনৈতিক চরিত্র ও পরিচয় অর্জন করেছে। মানুষের সামাজিক সখ্য এবং রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে ভাষার অবদান। তাই ভাষা যেমন রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, তেমনি রাজনৈতিক ভাষাও মানুষের মধ্যে নতুন স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে। এ কারণে প্রায় সব দেশেই জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো যে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করে, সেখানে ভাষা বা শব্দ প্রয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক সময় নির্বাচনের ফলাফলকে এটি প্রভাবিত করে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দটি সমাজ ভাষাবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে মনস্তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানের বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু হতে পারে। আমরা একটু অতীতে ফিরে তাকাতে পারি। ১৯৩৩ সালে হিটলার যখন জার্মানির রাষ্ট্রনায়ক হলো, সে সময় রাইখ সংস্কৃতি সংসদ গড়ে উঠেছিল গোয়েবলসের নেতৃত্বে। সমগ্র জাতির চিন্তাধারা রাইখ নেতৃত্বের অনুগামী করতে শিল্প-সাহিত্য, সংবাদপত্র, বেতার, থিয়েটার সবকিছুতেই প্রচারণার কাজ করে তারা। এক জার্মান এক সংস্কৃতিপন্থী—এই ভাবনা সবাই মেনে না নিলেও শেষ পর্যন্ত ভাষিক অহংকার ও জাত্যাভিমানে ভয়ে ভক্তিতে শ্রদ্ধায় এক জার্মান হয়ে ওঠে। হিটলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে যে অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল তার নাম ভাষা, রাজনৈতিক ভাষা। এ প্রসঙ্গে তার বক্তৃতা এবং জীবনীগ্রন্থ মাইন ক্যাম্প-এর কথা উল্লেখ করাই যথেষ্ট। আমরা আমাদের বাংলাদেশের কথা যদি অলোচনা করি তবে দেখব, শুধু ভাষার রাজনীতি অনুধাবন করতে না পেরে পাকিস্তানি শাসকেরা অনেক সংগ্রাম করেও শেষ পর্যন্ত পরাজয় মেনে নিয়ে বাংলাদেশ নামের নতুন মানচিত্র জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছিল। একইভাবে বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের যে ভাষণ, সেটিও ছিল বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির আত্মচেতনা এবং ঐক্য প্রয়াসের অন্যতম ভিত্তি। ভাষা দিয়ে, শব্দ দিয়ে মানুষকে মুক্তির মিছিলে দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছিল। তাই ভাষার রাজনীতি না বুঝে পাকিস্তান ভেঙে গেল (আরও অনেক কারণও ছিল), পক্ষান্তরে রাজনীতির ভাষা দিয়ে মাতৃভাষা তথা মাতৃভূমির প্রতি আনুগত্য তৈরির এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো সেদিন এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে। ইতিহাসে আমরা ভিন্নচিত্রও দেখি, জনমানুষের ভাষা ও ভাব না বুঝে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিণতিতে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। আমাদের দেশে মাঝেমধ্যেই রাজনীতিবিদেরা যথার্থ ভাষা ব্যবহার না করার পরিণতি তাঁদের দিতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
ভাষা যে কত বড় রাজনৈতিক হাতিয়ার তার প্রমাণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করে, তখন তাদের সাদা চামড়ার প্রশাসনিক ব্যক্তিরা এ দেশের ভাষা শেখার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করেছিলেন বাংলা শেখার জন্য। ‘নেটিভ’দের ভাষা না জানলে শাসন-শোষণ করা যায় না—তাই এ প্রচেষ্টা। রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখতে তাই শোষিত শ্রেণীর ভাষা জানা আবশ্যক। ইংরেজরা সেটা জানত বলেই রাজনীতিতে কাজে লাগিয়েছে ভাষাকে। পাকিস্তানি শাসকেরা ভাষা ভুলে ধর্মের রাজনীতিতে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ভাষার নিজস্ব শক্তি আছে। একে কাজে লাগাতে পারলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয়। আবার জনগণের সঙ্গে ভাষিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করলে বৈরিতা তৈরি হয়। ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের দ্বন্দ্ব মূলত ভাষাকে কেন্দ্র করে, যা পরবর্তী কালে রাজনৈতিক সমস্যায় পর্যবসিত হয়। মুহাম্মদ আবদুল হাই লিখেছেন, ‘ভাষা ব্যবহারে মানুষের যথেচ্ছ অধিকার থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রশ্নে মানুষকে এমনিভাবে সংকুচিত হয়ে যেতে হয়, মনের কথা মুখ পর্যন্ত এসে আটকে যায়। নিছক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে সহজভাবে নিজের ভাষার ওপরেও সে তার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। আর রাষ্ট্র! তার অনুসৃত আদর্শ প্রচারের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রচার বিভাগের মারফত ভাষা ব্যবহারের সব রকম মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে স্বদেশে ও বিদেশে তার মত বিস্তার করে দিতে মোটেও কুণ্ঠিত হয় না।’
কখনো কখনো রাজনীতিবিদ তথা রাজনৈতিক সরকার ভাষাকে ব্যবহার করে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে যেতে চায় নিজের শাসন ক্ষমতাকে আরও দীর্ঘায়িত করার জন্য। কিন্তু একসময় আসল ঘটনা বেরিয়ে পড়লে বিপরীত ফলই ঘটে। ভাষা নিয়ে রাজনীতি করলে তার পরিণতি যে কী হয়, তা পাকিস্তান ছাড়া আর কে ভালো জানে। আমাদের ভাষা আন্দোলনের এক কৃতী ব্যক্তিত্ব আহমদ রফিক এ বিষয়ে আমাদের বলেন, ‘আমাদের বাংলা ভাষা রাজনৈতিক কারণেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। ওরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণা দিয়ে নিজেদের অদূরদর্শিতার পরিচয়ই প্রকাশ করেছিল। সে আমলে এ নিয়ে ইত্তেহাদ এবং আজাদ-এ অনেক লেখালেখিও হয়েছে। মুহম্মদ এনামুল হক, কাজী মোতাহার হোসেন তাঁদের লেখায় সতর্ক করে দিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাষার প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ল রাজনীতির বৃত্তের মধ্যে এবং এর পরিণতি আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের জন্ম। এ কারণেই আমি বলি, ভাষা থেকে আমরা নতুন ভূখণ্ডে পৌঁছে গেছি। ভাষা আন্দোলন তাই শুধু ভাষারই আন্দোলন নয়, এটি রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনও।’
ভাষার ওপর মানুষের যেমন জন্মগত অধিকার, তেমনি দেশের রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুসারেও তার ভাষা নিয়ন্ত্রিত অথবা বাধার সম্মুখীন হয়। রাজনীতির শক্তি তার ভাষার স্বাধীনতার সামনে দেয়াল তুলে দেয়। আবার অন্যভাবে মানুষের ভাষার স্বাধীনতা খর্ব হলে, ভাষা প্রতিরোধ করা হলে, তখন ভাষা ও রাজনীতি পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। আর এ যুদ্ধে ভাষার জয়ের সম্ভাবনাই বেশি থাকে। কেননা ভাষার সঙ্গে মানুষের আবেগ এবং অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত।
ভাষার শক্তি মূলত তার সৌজন্য এবং নমনীয়তার মধ্যে। গত নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দৃষ্টান্ত দিয়ে, এ বিষয়ের ইতি টানতে চাই। ওবামা তাঁর ভাষণে মানুষকে হতাশা থেকে স্বপ্নের জগতে টেনে আনেন, ভুল স্বীকার করতে ভালোবাসেন, বিরোধী পক্ষের প্রশংসা করতে চেষ্টা করেন, সবশেষে ‘আমিত্ব’ বর্জন করে একাকার হয়ে যান সাধারণ মানুষের মধ্যে। এখানেই তাঁর ভাষার শক্তি। ওবামার ভাষণগুলো পড়লে আমাদের রাজনীতিবিদেরা উপকৃত হবেন। তাঁরা আরও বেশি মানুষের কাছে আসতে পারবেন। আর যে যত সহজে সহজ ভাষায় মানুষের কাছে আসতে পারে, সে তত আপন হয়ে ওঠে। এখন আর আমাদের ভাষা নিয়ে রাজনীতি করার অবকাশ নেই এই বাংলা ভাষা প্রধান রাষ্ট্রে। কিন্তু রাজনীতির ভাষা পরিবর্তন করার অবকাশ রয়ে গেছে। সরকার এবং বিরোধী দল ভেবে দেখলে একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহ্যময় এ দেশে শুধু ভাষা দিয়ে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হতে পারে। অন্তত বাংলাদেশের জনগণ তাই প্রত্যাশা করে। সে ভাষা কি আপনারা পড়তে পারেন?
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.