এনাম হাসপাতালের আহত সাত নারী শ্রমিক by অদিতি ফাল্গুনী

১৮ বছরের আরতি রানী দাস সাভারের এনাম হাসপাতালের সাততলায় দক্ষিণ দিকের জানালার পাশে বালিশে আধশোওয়া ছিলেন। রানা প্লাজা ধসে এই অষ্টাদশী হারিয়েছেন তাঁর ডান পা। গ্রামের বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জে। সাভারে বাবা-মা আর ছোট দুই বোনের সঙ্গে থাকতেন। তাঁর মা-ও একই পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। মা ইতিমধ্যেই মৃত। সাভার শ্মশানে মায়ের যখন দাহ হচ্ছে, তখন মেয়ের ডান পা থেকে সারা শরীরে গ্যাংগ্রিন ছড়ানোর ভয়ে চিকিৎসকেরা তাঁকে অস্ত্রোপচারের জন্য ওটিতে তুলছেন। আরতির বাবা রিকশাওয়ালা। জেঠতুতো দাদা আর পিসতুতো দিদি তাঁর শুশ্রূষা করছিলেন। এক বছর হয় রানী এই কারখানায় কাজ করছেন। সুইং সেকশনে কাজ করতেন তিনি। ঘটনার দিন সকাল নয়টায় তিনি যখন সাততলায় কাজ করছিলেন, তখনই তাঁর শরীরের ওপর দালান ধসে আসে। উদ্ধারকর্মীদের হাতে বাঁচার আগে তাঁর শরীর চাপা পড়েছিল দুটি লাশের নিচে।
এনাম হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে সাতজন গুরুতর আহত নারী শ্রমিক সার দিয়ে পাশাপাশি শুয়ে ছিলেন, কারও হাত-পা কাটা, কারও বা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ নেই। গত শুক্রবার বেলা দুইটায় আমি যখন এই ওয়ার্ডে ঢুকি, দরিদ্র এই নারী শ্রমিকদের দরিদ্রতর স্বজনেরা ওয়ার্ড ভরিয়ে তুলছিলেন তাঁদের মেহনতের টাকায় কেনা, জীবনানন্দ কথিত ‘হিম, করুণ কমলালেবু’র গন্ধে। রুশ লেখক আলেক্সান্দার সোলঝেনেতসিনের দুনিয়া কাঁপানো উপন্যাস ক্যানসার ওয়ার্ড-এর কথা মনে পড়ল আমার। কৈশোর ও তারুণ্যের সন্ধিক্ষণের দিনগুলোয় ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতালের কেবিনে-ওয়ার্ডে আমিও কাটিয়েছি আট মাস, যা সাহিত্যে রূপ দেওয়ার কথা ভেবেও খুব বেশি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে আজও লিখে উঠতে দ্বিধা হয়। কিন্তু কোন সংজ্ঞায় চিত্রায়িত করি এই ‘কবন্ধ ওয়ার্ড’? রাষ্ট্রের সুস্থ, সাতজন তরুণী পোশাকশ্রমিক, যাঁরা সপ্তাহ দুয়েক আগেও ছিলেন সচল, কর্মক্ষম? কেউ ছিলেন সদ্য বিবাহিত, কেউ শিশুসন্তানের মা, কেউ আজও অবিবাহিত ষোড়শী বা অষ্টাদশী! এই নারকীয়তার কোনো তুলনা হয় না।
আরতির উল্টো দিকের বেডে লাবণী আক্তার, বছর বাইশের সুশ্রী তরুণী। তাঁর গ্রামের বাড়ি নড়াইল। তাঁর ডান হাত কাঁধ থেকে কাটা। খুব সম্প্রতি নিজের পছন্দে বিয়ে করে সাভার চলে এসেছিলেন। অর্থনীতিতে সম্মান শ্রেণীর ছাত্রী লাবণী পড়ার খরচ চালাতে রানা প্লাজার পোশাক কারখানায় নার্স হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর আগে নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। রানা প্লাজার পোশাক কারখানার শ্রমিকদের হাতে নিডল ফুটে গেলে বের করে দেওয়া, সর্দি বা জ্বরের ওষুধ দেওয়ার মতো টুকটাক কাজ করতেন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটার শিফটে। তাঁর স্বামীও পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। মাস খানেক হয় বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। লাবণী তাঁদের গৃহপরিচারিকার সঙ্গে থাকতেন। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে আটটায় অফিসে গিয়ে কাজ শুরু করার কিছুক্ষণ পর তিনি দেখেন, গোটা দালান ধসে আসছে মাথার ওপর। ভবনধসের ৩৬ ঘণ্টা পর উদ্ধারকর্মীরা তাঁকে তোলার সময় জানান, একটি হাত না কাটলে তাঁকে তোলা যাবে না। ‘আমাকে ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ইনজেকশন দিতে না দিতেই হাত কাটার জন্য ব্যথা পুরোটাই পেলাম। তখন একটি সাদা কাপড় দিয়ে হাত বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। পরে হাসপাতালে এনে ব্যান্ডেজ দেওয়া হয়।’ লাবণী আক্তারের পাশে ছিলেন তাঁর মা ও মামাতো বোন। শক্ত মনের লাবণী হাসছিলেন।
লাবণী হাসলেও গোটা ওয়ার্ডের সবচেয়ে নরম মনের মেয়ে সনিয়া ভেঙে পড়েছিলেন। ১৮ বছর বয়স। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার মধ্য দামোদরপুর। তাঁর রিকশাচালক স্বামী মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন পরম মমতায়। তাঁর একটি পা কাটা হয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে সনিয়া হাসপাতালে তাঁদের দেখতে আসা সবার হাত জড়িয়ে ধরছিলেন। আমি চলে আসার সময় উত্তর বাংলার টানে বললেন, ‘চলিয়া যাবা? আর আসিবা না?’ এ প্রশ্নের উত্তর হয় না। চলে আসতে আসতে শুনি ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছেন, ‘মোর ভুখ নাগিছে।’ তাঁর রিকশাওয়ালা স্বামী খাবার আনতে ছুটলেন।
না, লাবণীর মতো স্বামী ভাগ্য নয় ২৫ বছরের রিক্তার। দুই বছরের এক সন্তানের জননী রিক্তারও একটি হাত কাটা গেছে। রানা প্লাজায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। এসএসসি পর্যন্ত পড়েছেন। দুর্ঘটনার দিন চারতলায় ছিলেন। দুর্ঘটনার তিন দিনের মাথায় উদ্ধার হন। তাঁর মা এসেছেন তাঁকে দেখতে। ব্যথার বড়ি চেয়ে কাতরাচ্ছিলেন। প্রথমে কথা বলতে গিয়ে বিরক্ত হলেন। পরমুহূর্তেই ক্ষমা চাইলেন, ‘ব্যথায় ভালো লাগে না। স্বামী আসে দেখতে। একবার ভালো ব্যবহার করে, একবার খারাপ ব্যবহার করে।’ বর্ণনাহীন শঙ্কিত চোখে চেয়ে থাকেন তিনি। ওয়ার্ড ছেড়ে চলে আসার সময় দেখি, তাঁর প্রাইভেট কার চালক স্বামী তাঁকে ভাত মেখে খাওয়াচ্ছেন।
লাবণীর পাশের বেডেই এই কবন্ধ ওয়ার্ডের কনিষ্ঠতম সদস্য ১৬ বছরের আন্না। তারও ডান হাত কাঁধ থেকে কাটা। মুখ থেকে এখনো শৈশবের মায়া ঘোচেনি। রিকশাওয়ালা বাবার সংসারে উপার্জনে বাবার পাশে হাল ধরতে সংসারের বড় মেয়ে হিসেবে মাত্র চার মাস হলো সে এই কারখানায় যোগ দিয়েছিল। সাভারে বাবা-মা আর ছোট ভাইবোনের সঙ্গে সে থাকত। ১৬ বছরের এই এখনো শিশুর মতো মায়াবী চোখ-মুখের
শ্যামলা মেয়েটি একাই সবল পায়ে হেঁটে বাথরুমে গেল। তার রিকশাওয়ালা বাবা মেঝেতে বসে মেয়ের জন্য টিফিন ক্যারিয়ার খুলে ভাত-তরকারি বের করছিলেন।
৩০ বছর বয়সী ও দুই সন্তানের মা পাখি বেগম কাজ করতেন রানা প্লাজার সুইং সেকশনে। সাত-আট মাস হয় তিনি রানা প্লাজায় যোগ দিয়েছিলেন। পাখি বেগমের দুটো পা-ই কাটা। ‘আপনি কি সেই পাখি বেগম, যাঁর নাম গোটা দেশ জানে?’ আমার এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি হেসে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমিই সেই পাখি বেগম। সারা রাষ্ট্রে সবাই মোর নাম জানিছে।’ বুধবার সকাল নয়টায় যথারীতি মেশিনের পেছনে কাজ করছিলেন। তারপর কারেন্ট চলে গেল। একটু পরেই ভবন ধসে পড়ল। ‘আমার ওপর একটি ভিম পড়িছিল। আমিই উদ্ধারের লোকদের বললাম, আমার দুইটা পা কেটে হলেও বাঁচাও। তারা বলল, “তোমার স্বামী তাহলে তোমারে দেখবে না।” আমি বললাম, না দেখুক। আমার বাচ্চা দুইটার মুখ না দেখে আমি মরব না। তখন ইনজেকশন দিলেও, ইনজেকশন দিয়েই তো দুই পা কাটছে, তা-ও ব্যথা পুরাই পাইছি। পা কাটার পর রক্ত আর মানাচ্ছে না। সাদা কাপড়ে তখন কাটা দুই পা পেঁচায় আমারে নিয়া আসছে হাসপাতালে।’ পাখির পাশে সে সময় ছিলেন তাঁর বোনের মেয়ে ও ননদের স্বামী। তাঁর নিজের স্বামী মাত্রই দুই সন্তানকে নিয়ে বের হয়ে গেছেন। খুলনার মেয়ে পাখির ছোট ভাই তাঁর সব দেখাশোনা করছেন। পাখি চান তাঁর মা-বাবা মরা, বিএ পড়ুয়া ছোট ভাইকে যদি কেউ একটা চাকরি দিত!
গোটা ওয়ার্ডে যাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারিনি, তিনি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার মেয়ে লাভলী। ২৫ বছরের এই নারী শ্রমিক ও তাঁর স্বামী সাভারেই থাকতেন। লাভলীর আয়ে গ্রামের বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকা তাঁর দুই ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ চলত। ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করার পর লাভলীর একটি পা কাটতে হয়েছে এনাম মেডিকেলে এসে। বিষাদ ও অবসন্নতায় নিঃসাড় ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর শাশুড়িই তাঁর হয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন।
এনাম হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এ কয় দিন সংবাদপত্রে পড়া অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে যাই। সেখানে আরেক অদ্ভুত দৃশ্য। জীবিত বা মৃত কোনোভাবেই স্বজনের খোঁজ বের করতে না-পারা মানুষেরা দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন। গোপালগঞ্জ থেকে আসা এক মা বললেন, ‘আজ ১৭টা দিন এই স্কুলের মাঠেই ঘুমাই। আমার সবচেয়ে বড় মেয়ে এখানে কাজ করত। তার আয়েই সংসার চলত। লাশ না পাই, হাড় কয়টা পাইলেও বাড়িতে নিয়া গোর দিতে পারতাম।’
এনাম হাসপাতালে থাকতেই লক্ষ করছিলাম কিছু বিবেকবান সাধারণ নাগরিক এসে অসহায় লোকজনের হাতে কিছু টাকা দিচ্ছিলেন। সমাজের সর্বস্তরের বিবেকবান মানুষজনকে অনুরোধ করি, এই অসহায় সাত নারী শ্রমিকের পাশে (সিএমএইচ ও অন্য হাসপাতালে হাত-পা কাটা আরও কিছু নারী ও পুরুষ শ্রমিক আছেন) এসে দাঁড়াতে।
অদিতি ফাল্গুনী: কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.