রাজধানীতে বিশাল শোভাযাত্রায় যে বার্তা দিলো বিএনপি by পলাশ সরকার

বর্তমান যে সরকার তাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি রয়েছেন।  আরও রয়েছেন সাবেক সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা,  অর্থনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, বেসরকারি সংস্থার কর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষাবিদদের প্রতিনিধি।  কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এই সরকারে নেই। অন্তর্বর্তী সরকার  মনে করে যে, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুরক্ষিত রাখতে এবং  স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি  ঠেকাতে এই সংস্কারগুলো সম্পন্ন করা জরুরি। তাদের মতে, নির্বাচনের আগে সকল কাঠামোগত ও আইনি সংস্কার সম্পন্ন করা হলে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে...

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো সাধারণ নির্বাচন। বহু আকাঙ্ক্ষিত এই নির্বাচন কবে হবে এবং কীভাবে হবে-এই প্রশ্নটি সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে এ বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ঘটে এক নজিরবিহীন ঘটনা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর টানা লড়াই ও সংগ্রামকে বাড়তি উচ্চতায় নিয়ে যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।  হাজারো ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তি পায়। গঠিত হয় নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এখনো পর্যন্ত সরকারটি তার জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রেখেছে। নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাঠামাগুলোর সংস্কারের কাজ শেষ করে তবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ইতিমধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারে ছয়টি  কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখানে একটি বড় প্রশ্ন উঠেছে, সংস্কারের সব কাজ করবে কে? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার, না পরবর্তী নির্বাচিত সরকার? পাশাপাশি, এই সংস্কারের পরিধি ও মাত্রা নিয়েও অনেক প্রশ্ন সামনে আসছে।
বর্তমান যে সরকার তাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি রয়েছেন।  আরও রয়েছেন সাবেক সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা,  অর্থনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, বেসরকারি সংস্থার কর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষাবিদদের প্রতিনিধি।  কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এই সরকারে নেই। অন্তর্বর্তী সরকার  মনে করে যে, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুরক্ষিত রাখতে এবং  স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি  ঠেকাতে এই সংস্কারগুলো সম্পন্ন করা জরুরি। তাদের মতে, নির্বাচনের আগে সকল কাঠামোগত ও আইনি সংস্কার সম্পন্ন করা হলে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে।

৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা দেশছাড়ার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানের  নেতাদের বেশির ভাগই পলাতক। অনেকেই হত্যাসহ নানা মামলায় কারাগারে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা জাপাসহ অন্য দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধেও বহু মামলা করা হয়েছে। এই মুহূর্তে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী ও গণঅধিকার পরিষদসহ সমমনা দলগুলো বেশ সক্রিয়। বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর গত ১৬-১৭ বছর ধরে অনেক জেলজুলুম, নির্যাতন হয়েছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসা বিএনপি এখনো নির্বাচনের দাবিতে তাদের অবস্থানে অটল।  সরকারের মতো বিএনপিও চায় সংস্কারের মাধ্যমে দেশের কাঠামোগত একটি পরিবর্তন আসুক এবং যত দ্রুত সেই পরিবর্তনের পর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। বিএনপি‘র এই প্রত্যাশা গত তিন মাসের নয়, বরং গত দেড়যুগের।

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত  চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাম্প্রতিক বক্তৃতায় দলের আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য ফুটে উঠেছে। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস উপলক্ষে বিএনপি শুক্রবার রাজধানী ঢাকায় একটি বিশাল শোভাযাত্রা বের করে। রাজধানীবাসীর দুর্গোভের কথা মাথায় রেখে বিএনপি শোভাযাত্রা করে সরকারি ছুটির দিনে। লোকে লোকারণ্য হয় ঢাকা। এই শোভাযাত্রা শুরু হয় নয়াপল্টন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে। শেষ হয় মানিক মিয়া এভিনিউতে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে সমাবেশের মধ্যদিয়ে। এতে দলটির ভবিষ্যত ঠিকানার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সমাবেশে এই সরকার নিয়ে বিএনপি’র অবস্থান ও প্রত্যাশা ফুটে এসেছে। একইসঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারকে দলের সমর্থন দেয়ার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।

তারেক রহমান তার ভাষণে সরকার যাতে ব্যর্থ না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।  একটি সরকারের সাফল্য ব্যর্থতা পরিমাপের জন্য যদিও তিন মাস মোটেও উপযুক্ত সময় নয়। কারণ একটি অগণতান্ত্রিক সরকার, যে কিনা রাষ্ট্রের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেখান থেকে একটি জটিল ও অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরই মধ্যে কয়েকটি অপশক্তি দাবি-দাওয়ার আড়ালে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। এমন বাস্তবতায়  সরকারে না থেকেও, তিন মেয়াদে সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিএনপি বর্তমান সরকারকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা করে আসছে। সরকার যেন ব্যর্থ না হয়, সেজন্য লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত বিএনপি’র শোভাযাত্রায় সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। দেশের রিজার্ভ তলানিতে রেখে, ব্যাংকগুলো ফাঁকা  করে দিয়ে ও দেশকে ঋণের জালে বিপর্যস্ত করে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপির পূর্ণ সমর্থন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কঠিন কাজে সরকারকে সহায়তা করবে। সর্বশেষ বক্তৃতায় তারেক রহমান একটি সমতাভিতিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথা বলেছেন। যে বাংলাদেশে  ধনী ও গরিবের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকবে না। যেখানে ধনী শুধু ধনীই হবেন, আর দরিদ্র শ্রেণি দিন দিন আরও দরিদ্র হবেন-এই চক্র থেকে বের হবার প্রত্যয় রয়েছে।  তিনি একইসঙ্গে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের কথা বলেছেন। এই গণতন্ত্র কাগুজে বা কেতাবি নয়। সকলের মতামত নিয়ে বাস্তবে প্রয়োগ করা হবে এমন একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখা যায় তার বক্তৃতায়। একইসঙ্গে তিনি একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ার ওপর জোর দিয়েছেন। যেখানে দেশের নাগরিকদের সবার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে। কোনো একটি অংশকে বঞ্চিত বা উপেক্ষা করা হবে। বরং প্রতিটি সত্তার মধ্যে আন্তঃসংযোগ ঘটিয়ে গড়া হবে নতুন বাংলাদেশ।

বিএনপি’র লাখো নেতাকর্মীর অংশগ্রহণে ঢাকায় শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রায় একদিকে দলীয় ঐক্য প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে এই ঐক্য বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার জন্য একটি শক্তিশালী পাটাতন বা ভিত্তি দিয়েছে। এরসঙ্গে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শহীদ হাজারো ছাত্র, শ্রমিকের রক্ত ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার হঠাতে গিয়ে যে নিদারুণ যন্ত্রণা ও অভিজ্ঞতা  দেশের মানুষ ভোগ করেছে তা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে উজ্জীবিত করার রসদ জোগাবে। তার ভাষ্য, আর  কোনো অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী ও একনায়কতান্ত্রিক  স্বৈরাচার ব্যবস্থা বাংলাদেশে ফিরে না আসুক। অর্থাৎ বিদ্যমান সরকার থেকে শুরু করে ভবিষ্যতের সরকারও  যেন আর কখনো স্বৈরাচারী না হয়ে উঠে, সে ব্যাপারেও সাবধান করে দিয়েছেন তিনি।
আগামীতে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত সরকারের হাতে মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠকু বাংলাদেশ।

লেখক: সংবাদকর্মী

No comments

Powered by Blogger.