জাগৃতি-শুদ্ধস্বরে ফুটে আছে নীরব প্রতিবাদ by মোছাব্বের হোসেন

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার ভেতরে ঢুকতেই আলাদা করে চোখে পড়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির স্টলটি। এ যেন শুধু সাদামাটা কোনো দোকান নয়। দোকানের প্রতি পরতে পরতে ফুটে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। এক কোণে টেবিলে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ আর কাদা মাটি, রক্তমাখা কলমদানি, রক্ত লেগে থাকা পাণ্ডুলিপি আর চটের বস্তা।
দোকানের ভেতরে মাঝে দীপনের ছবির নিচে লেখা—‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা।’ স্টলের ওপর কালো ব্যানারে জাগৃতি প্রকাশনীর ডান দিকে দীপনের ছবি আর নিচে লেখা ‘সকলের মাঝে শুভবুদ্ধির উদয় হোক...’।
জাগৃতির স্টলটিতে যেন ফুটে উঠেছে
প্রতিবাদের ভাষা। ছবি: জাহিদুল করিম।
প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপনকে গত বছরের ৩১ অক্টোবর শাহবাগে আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
জাগৃতির স্টলে দীপনকে আলাদাভাবে স্মরণ করার জন্য প্রতিটি নতুন প্রিন্ট করা বইয়ের শেষে কালো ব্যাজের প্রিন্টে ছাপানো হয়েছে দীপনের ছবি। স্টলে একটি ঝুড়িতে কিছু কাঠের চাবির রিং রাখা। সেখানেও দীপনের ছবি। কালো প্রিন্ট করা একটি প্রচারপত্রে দীপনের ছবিসহ সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখা হয়েছে। আগ্রহীরা অনেকে তা সংগ্রহ করছেন। স্টলে পাঠকের সমাগমও বেশ ভালো।
স্টলে দীপনের টেবিলে রক্তের ছোপ ছোপ
দাগ আর কাদা মাটি, রক্তমাখা কলমদানি,
রক্ত লাগা পাণ্ডুলিপি। ছবি: জাহিদুল করিম
এবার এই প্রকাশনী থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ছয়টি নতুন বই এসেছে। সব মিলে বিশটি বই বের হবে বলে জানা গেল। নিয়মিত না হলেও মাঝেমধ্যেই দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক সেখানে আসেন। তবে নিয়মিত স্টলে বসছেন দীপনের স্ত্রী চিকিৎসক রাজিয়া রহমান। কালো ব্যাজ পরেন তিনিও। তিনি জানান, দোকানে নানাভাবে দীপন হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে। দীপনের কথা বলতেই বারবার আবেগাপ্লুত হলেন তিনি। বলেন, ‘মাত্র তিন মাস আগে যে মানুষটাকে হত্যা করা হলো, অথচ এই বইমেলায় তাঁকে স্মরণ করল না কেউ। হতে পারত এই বইমেলায় তাঁর নামে একটি আলাদা চত্বর কিংবা এই বইমেলাটা তাঁকে উৎসর্গ করা যেত। কেউই কিছু করল না। অথচ এই সৃজনশীল শিল্পের সঙ্গে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ করে চলে গেলেন।’
রাজিয়া আর কথা বলতে পারলেন না। চাপা কান্নায় মুখ ঢাকলেন তিনি। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে জানালেন, এই বইমেলায় পুরোনো বইগুলোই পাঠক বেশি খুঁজছেন ও কিনছেন। এই দোকানে গত বছর বই কিনেছিলেন ইন্দিরা রোডের বাসিন্দা আরাফাত। এবারও এখানে বই কিনতে এসেছেন তিনি। দীপন হত্যার প্রতিবাদ জানালেন তিনিও। বললেন, মানুষকে এভাবে হত্যা করতে হবে কেন? এটি কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
দীপনকে হত্যা করার দিনই আরেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের লালমাটিয়ার কার্যালয়ে ঢুকে স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। বইমেলায় সেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের স্টলেও দেখা গেল প্রতিবাদের ভাষা। কর্মচারীদের কেউ কিছু বলতে না চাইলেও দোকানের সবকিছুতে যেন প্রতিবাদের ভাষা ফুটে আছে। কালো আর লাল রঙে দোকান সাজানো হয়েছে। খুঁটিগুলো কালো রং করা হয়েছে।
এই স্টলের বই বিক্রেতা মো. আশরাফুল জানান, টুটুল এখনো বইমেলায় আসেননি। এখান থেকে নতুন বইও বের হয়নি। পাঠকেরা এখান থেকেও পুরোনো বইগুলোই ঘুরেফিরে কিনছিলেন। এখানেই মিরপুর থেকে আসা এক পাঠক আসিফ বলেন, এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, একজন প্রকাশককে হত্যা করা হলো! আরেক প্রকাশকসহ তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হলো। এর বিচার এখনো হলো না। কেউ ধরা পড়ল না। কে জানে আবার এ ধরনের ঘটনা ঘটে কি না...!
শুদ্ধস্বরের দোকানেও মানুষ আসছেন। কিনছেন পুরোনো বই। ছবি: জাহিদুল করিম

No comments

Powered by Blogger.