চা শ্রমিকের ঘাড়েও সরকারের লম্বা হাত! by জয়া ফারহানা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে বেজা (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল) পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, ইকোনমিক জোন বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে কৃষি জমি নষ্ট না হওয়ার বিষয়টি সরকার তীক্ষ্ণ নজরে রাখছে এবং যেখানেই ইকোনমিক জোন তৈরি হবে, কৃষি জমি রক্ষা করেই হবে। আর ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন ২০১৫ ধারা ৪-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো কৃষি জমি নষ্ট করে আবাসন, বাড়িঘর, শিল্প- কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাইবে না...। বাংলাদেশের সব কৃষি জমির ওপর দেশের যে কোনো কৃষক বা কৃষিজীবীর অধিকার থাকবে এবং খরিদসূত্রে বা উত্তরাধিকার সূত্রে বা সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত বন্দোবস্ত সূত্রে তা ভোগদখলে রাখবার অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে...।’ দুই বা তিন ফসলি জমি সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো অবস্থাতেই অধিগ্রহণ করা যাইবে না। আইন ওয়েবসাইটে রেখে ভূমি মন্ত্রণালয় অবশ্য এরই মধ্যে চাঁন্দপুরের তিন ফসলি ৫১১ একর আবাদি কৃষি জমিকে অকৃষি খাস জমি হিসেবে কাগজে-কলমে প্রমাণ করেছে। তার জন্য রেকর্ডও সংশোধন হয়েছে। তা, রেকর্ড সংশোধন আর এমন কী কঠিন কাজ ভূমি মন্ত্রণালয়ের জন্য! বোঝা যাচ্ছে, বেজার প্রস্তাব অনুমোদনের ব্যাপারে তাদের সহৃদয়তার শেষ নেই। প্রায় একই রকম সহৃদয়তা আছে দেশী-বিদেশী বহুজাতিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের জন্যও। হাজার কয়েক চা শ্রমিক আর তাদের পরিবার বাস্তুভিটা হারাল কী হারাল না অথবা হারিয়ে কোথায় গেল, তাদের ভবিষ্যৎ কী, এসব দেখার দায়িত্ব তো ভূমি মন্ত্রণালয়ের নয়। যদি হতোই, তবে ১৮৯০ সাল থেকে চাঁন্দপুরের যে তিন ফসলি কৃষি জমি চা শ্রমিকরা বংশপরম্পরায় আবাদ করে আসছেন, কোন আইনের ভিত্তিতে সেখানে স্পেশাল ইকোনমিক জোন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল? হ্যাঁ, ঠিক যে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া আইনটি খসড়া; কিন্তু কৃষি জমি রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অথবা কৃষি জমি রক্ষার ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে কী করা উচিত তার কিছু ঔচিত্যমূলক কথাবার্তা তো খসড়া আইনটিতে আছে। ওই আইন পড়েই আমরা বুঝেছি কৃষি জমি রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান। মতামত চাওয়া হয়েছিল ওয়েবসাইটে। সেখানে কৃষি জমি রক্ষায় খুবই ভালো ভালো কিছু কথাবার্তা জ্বলজ্বল করছে দেখতে পেলাম। ওয়েবসাইটে বর্ণিত মতামতের সঙ্গে দ্বিতীয় মত বা মতান্তর প্রকাশের সুযোগ কোথায়? হা-হতোস্মি, এখন তো দেখি ভালো কথাগুলো কেবল সেই খসড়া আইনটিতে রয়ে গেছে।
বাস্তবে ‘অশিক্ষিত’, ‘অপদার্থ’, ‘হতদরিদ্র’, ‘নির্বোধ’ চা শ্রমিকদের ডেকে চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, জমি রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে চা শ্রমিকদের করা আবেদন আইন অনুযায়ী আমলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ সেই ১৮৬৫-তেই ব্রিটিশ ডানকান চা কোম্পানির কাছে সরকার এই ৫১১ একর জমি লিজ দিয়েছে। এখন সরকার শ্রমিকদেরই স্বার্থে এখানে ইইজেড (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন) প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এতে ২০০০ চা শ্রমিকের জায়গায় লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। খুবই ভালো কথা। দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র আইনের প্রতি যতখানি শ্রদ্ধাশীল, শ্রমিক স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়! কিন্তু ‘বোকাসোকা’ শ্রমিকরা তো বলছেন অন্যরকম। তারা ভাবছেন বংশপরম্পরায় তারা কেবল চা পাতা তোলা অথবা চা সংশ্লিষ্ট কাজগুলোই শিখেছেন। তাদের দক্ষতাও কেবল এ কাজেই। এখন ইকোনমিক জোনের নামে যে মহাযজ্ঞ সাধিত হবে, যে এলাহি কাণ্ড অনুষ্ঠিত হবে, অত মহা মহা কাজে কি তাদের অংশগ্রহণ থাকবে? তারা ভাবছেন, থাকবে না। মহা এ ইইজেড প্রতিষ্ঠা হলে মূলত কাজ পাবে এলাকার বাইরের লোকজন, যারা এসব শিল্পের কাজে দক্ষ। আর ভিটেমাটি থেকে সমূল উচ্ছেদ হতে হবে তাদের। কী জানি, তারা বোধহয় তাদের মূর্খামির কারণেই সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম বুঝতে অসমর্থ! বেশি বেশি উন্নয়ন মানে যে, বেশি বেশি মুনাফা, অ..নে..ক মুনাফা, এ বস্তু এখনও তাদের মাথায় ঢোকেনি। এ নগরের রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিক, বস্তি-গলিঘুঁজির খেটে খাওয়া মানুষ এরা প্রায় সবাই কিন্তু উদ্বাস্তু, উন্মুল। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ঢাকায় এ ভাসমান অবস্থার আগে এদের প্রত্যেকের না হলেও অধিকাংশেরই উল্লেখ করার মতো ছোটখাটো সামাজিক পরিচিতি ছিল। এক-দু’কানি কৃষি জমি ছিল, দু-একটা গরু কিংবা গবাদিপশু ছিল। গ্রামের সমাজে তাদের মতামতের একটু হলেও মূল্য ছিল। সামাজিক বিবিধ কর্মকাণ্ডে কিছুটা হলেও অংশ ছিল। এখন এ শহরে তাদের একমাত্র পরিচয় রিকশাওয়ালা...। গত জোট সরকারের আমলে খুলনায় পর্যায়ক্রমে পাটকলগুলো লে-অফ ঘোষণা হলে যে মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল এবং তার সামাজিক অভিঘাত কী হয়েছিল সেকথা কোথাও লেখা নেই। পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শ্রমিকদের চেয়ে বিপদে পড়ল ফোরম্যান বা এ অবস্থানের কর্মচারীদের পরিবার। অধিকাংশ পরিবারের মেয়েদের কাজের অভাবে, নানা পরিস্থিতির পাকে চক্রে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় মিলেছিল বানিশান্তা ব্রথেলে। আমরা গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে বড়াই করি। আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক শিল্প রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থান নিয়েও আস্ফালনের শেষ নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকে আমাদের এক্সেসের কারণ যে অসম্ভব সস্তা শ্রম- হ্যাঁ এ অসম্ভব সস্তা শ্রমের কথাও আমরা প্রায়শই বলি বটে; কিন্তু কতটা সস্তা সেটা, সে বিষয়ে গভীর জানাশোনা কি আমাদের আছে?
চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি উল্লেখ করতে তো সত্যিই সাহসের দরকার। তবু ওই সস্তা শ্রমেই সেখানে থাকতে চাচ্ছেন তারা। চা বাগান তাদের কাছে নিছক বাগান নয়। ওইখানে আসলে তাদের হৃদয়ও পোতা। না, কেবল আলংকারিক অর্থে কথাটা বলা নয়। চা বাগানের ভেতর যারা জীবনযাপন করছেন, চা বাগানকে ঘিরে বেড়ে উঠছেন অথবা বাগানের সংস্কৃতি যাদের রক্তে মিশে আছে, চা তাদের শরীরের অংশের মতো। এ সংস্কৃতি থেকে তাদের উচ্ছেদ করার অর্থ তাদের হত্যা করাই। এ অমানবিক কাজটি না করে অন্তত তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পরিবেশ তৈরি করা দরকার। পরিবেশ কী, পরিষ্কার কথা বলা দরকার।
রসায়নবিদরা বলেন, প্রমাণিত সত্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গন্ধ থাকে চা’য়ে। এমনকি তা শ্যানেল-২৫ বা গোলাপের গন্ধের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর।
সকালে দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে এক পেয়ালা চা না হলে নগরবাসীর দিন আলুনি হয়ে যায়, সেই চা পানের সময় এখন আপনি ঠিকঠাক সেই গন্ধ পাচ্ছেন তো? জানি পাচ্ছেন। কারণ আপনাকে তো আর ৬৯ টাকা মজুরিতে দিন চালাতে হচ্ছে না।
জয়া ফারহানা : কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.