নিরাপত্তা চেয়ে আগেই পুলিশের কাছে আবেদন করেছিলেন বাবুল

নিরাপত্তা চেয়ে ও পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচতে প্রায় ছয় মাস আগেই পুলিশের কাছে আবেদন করেছিলেন বাবুল মাতুব্বর। কিন্তু নিরাপত্তা পাওয়া বা পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচা তো দূরের কথা, সেই পুলিশের দেয়া আগুনেই মরতে হলো তাকে। বাবুলের সঙ্গে পুড়ে গেছে পুলিশের কাছে আবেদন করা সেই লিখিত আবেদনপত্রটিও। ওই আবেদনপত্র পকেটে নিয়েই ঘুরতেন তিনি। যাতে পুলিশ তাকে হয়রানি করতে না পারে। ওই আবেদনের একটি অনুলিপি পাওয়া গেছে বাবুল মাতুব্বরের ছেলে রাজু মাতুব্বরের কাছে। তিনিই  জানিয়েছেন এই তথ্য।
রাজু মাতুব্বর জানান, পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচতে ছয় মাস আগে গত বছরের ১৬ই আগস্ট পুলিশের মিরপুর বিভাগের ডিসি’র কাছে আবেদন করেছিলেন তার বাবা। ওই আবেদনে বাবুল লিখেছিলেন, ‘আমি ইলেকট্রিক্যাল কাজসহ যখন যে কাজ পাই, তখন সে কাজ করে কোনোরকমে পরিবার নিয়ে দিন যাপন করে আসছি। আমি কোনো মাদক খাইও না এবং বিক্রিও করি না। লোক মারফত শুনতে পাই, আশপাশের ঘরের লোকজন নাকি মাদক বিক্রয় করে। উক্ত ঘরে মাদক বিক্রেতাদের খুঁজতে এসে পুলিশ আমাকে নানাভাবে হয়রানি করে। গত বছর আমি আপনার অফিসে একটি দরখাস্ত দেয়ার পর গত এক বছর ধরে থানা-পুলিশ আমাকে হয়রানি করেনি। বর্তমানে আবার থানা-পুলিশ আমাকে হয়রানি করে আসছে। ফলে আমি সব সময় পুলিশের ভয়ে থাকি। থানা-পুলিশ অন্যদের খুঁজতে গিয়ে যাতে আমাকে হয়রানি না করে, এই বিষয়ে শাহ্ আলী থানাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান এবং আমাকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার সুযোগদানে আপনার মর্জি হয়।’ ওই চিঠি দেয়ার পর রাজু বলেন, ‘ডিসি থানায় বলে দিয়েছিলেন। কিছুদিন পুলিশ ডিস্টার্ব করেনি। কিন্তু মাস খানেক ধরে তারা আবার চাঁদা চাওয়া শুরু করে বলে রাজু জানান।
এদিকে চাঁদা না পেয়ে চা বিক্রেতা বাবুল মাতুব্বরকে পুড়িয়ে হত্যার পর অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা। তবে বুধবার এ ঘটনার পর থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত তিন দিনেও পুলিশি তদন্তে পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও ঘটনার পরবর্তী দু’দিনে শাহ্ আলী থানার তিন এসআইসহ পাঁচ জনকে সাময়িক বরখাস্ত ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এ দিকে দু’দিনের রিমান্ডে থাকা পারুল বেগমের কাছ থেকেও তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একই থানার উপ-পরিদর্শক মো. রোকনুজ্জামান। আজ ঘটনাস্থলের পাশে গুদারাঘাটের বাসায় পরিবারের পক্ষ থেকে নিহত বাবুলের কুলখানি আয়োজনের কথা রয়েছে।
এই আলোচিত হত্যাকা-ের পর গতকাল শনিবার সিলেটে এক অনুষ্ঠান শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেছেন, কোন পুলিশ সদস্য যদি অপরাধ করে থাকে, সে দায়িত্ব তার নিজেরই । কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনীর নয়। তবে তদন্তে যদি কোনো পুলিশ সদস্যের অপরাধ প্রমাণ হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা চাকরিচ্যুত করতেও দ্বিধা করি না। প্রায় অভিন্ন হুঁশিয়ারি সিআইডি প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি শেখ হিমায়েত হোসেনের। গতকাল ঝিনাইদহে সিআইডির একটি ক্যাম্প উদ্বোধন শেষে তিনি বলেন, পুলিশের ভাল কাজ সাধারণ মানুষের মাঝে আস্থা বৃদ্ধি করে। মানুষ আশান্বিত হয়। আর পুলিশ খারাপ কাজ করলে কঠোর ব্যবস্থাও নেয়া হবে। এমনকি মামলা হবে, পুলিশকে জেলহাজতেও পাঠানো হবে। একই ধরণের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার। গতকাল নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের সোর্স পরিচয়ে কেউ চাঁদাবাজি করলে তাদের ছাড় দেয়া হবে না। পুলিশের সোর্স পরিচয়ে কেউ যদি চাঁদাবাজি করে, সেক্ষেত্রে যার কাছে চাঁদা চাওয়া হবে, অথবা বিষয়টি কারও দৃষ্টিগোচর হলে তাৎক্ষণিক পুলিশের কাছে অভিযোগ করবেন। এতে কোন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে, তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বা থানার ওসি ও সংশ্লিষ্ট জোনে উপ-কমিশনারকে জানাতে হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। পুলিশের অভিযানে সোর্স নিয়ে যাওয়া যায় কিনা, জানতে চাইলে মারুফ হোসেন বলেন, এ ধরনের সুযোগ নেই। এটি যদি কেউ করেন, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা  নেবে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. মোকতারুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, গত দু’দিন আমি মামলা তদন্তে তিন বার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। প্রত্যক্ষদর্শীসহ পাঁচজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ জড়িত থাকার কোন সাক্ষ্য বা প্রমাণ মিলেনি। কয়জন মিলে এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। দু’দিনের রিমান্ডে থাকা পারুল বেগমও জিজ্ঞাসাবাদে চাতুরি করে কথা বলছেন। দোষও স্বীকার করেনি।
এদিকে পুলিশ কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ারি ও তদন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার মানবজমিনকে বলেন, পৃথক তদন্ত কমিটি ঘটনার তদন্ত করছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও দায়ের করা মামলাটির তদন্ত করছেন। এখনও তেমন বেশি কিছু জানা যায়নি। তদন্ত প্রতিবেদনও হাতে আসেনি। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রত্যাহারকৃত পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখনও তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.