যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে তারাই আগুনে পুড়িয়ে মারছে : সুজন

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, যে সংগঠনগুলো নাগরিকের নিরাপত্তা দেবে, আজ তারাই জনগণকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারছে। এর প্রোটেস্ট করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। তা না হলে গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে আছে এবং পড়বে। নির্বাচন কমিশন, আদালত-বিচার বিভাগ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের মাঝে নেতিবাচক হতাশা আছে। শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাইঞ্জে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কাযর্কারিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন ড. কামাল হোসেন, বিচারপতি আব্দুল মতিন, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, জনাব আবুল হাসান চৌধুরী, আলী ইমাম মজুমদার, ড. তোফায়েল আহমেদ, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ মহসেন রশিদ, অ্যাডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী, জাকির হোসেন, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, হুমায়ূন কবীর হিরু প্রমুখ।
বৈঠকে ড. কামাল বলেন, নির্বাচন কমিশন হলো অ্যাম্পায়ার, তারা যদি নিরপেক্ষ না থাকে তাহলে বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে কীভাবে। বিচারকদের নৈতিকতা, সত্যবাদিতা ও ন্যায়বোধ না থাকলে যত আইনই থাকুক না কেন তাতে কোনো কাজ হবে না। বিচার বিভাগ না থাকলে আমরা কেউ নিরাপদ থাকব না, আমাদের ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিরাও নিরাপদ থাকবে না। তারা কিসের মধ্যে বাস করব! বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা গেলে দেশের সংবিধান অনুযায়ী চলছে কিনা তা বিচারকরাই দেখতে পারবেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারপতিদের নিয়োগ দান এবং সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। অথচ দীর্ঘ সময় পার হলেও বাংলাদেশের এখনো বিচারপতি নিয়োগ আইন প্রণয়ন হয়নি, যে কারণে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে না হয়ে দলীয় ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, বিচারপতিদের নিয়োগ সংক্রান্ত আইন যে আইনের কথা ১৯৭২ সালের সংবিধানে বলা ছিল, তা আজও হয়নি। সংসদ বিচারপতিদের যোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন পাস করেনি। এ সংক্রান্ত আইনের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলেও শোনা যায় না।
তিনি বলেন, সরকারের ব্যাপক জনসমর্থন নেই, সংসদে সত্যিকারের বিরোধীদল নেই। নির্বাচন কমিশন যেখানে সরকারি দলকে জেতাতে ব্যস্ত, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দুর্নীতি দমন কমিশনের অন্যতম প্রধান কাজ ভিন্ন দলের রাজনীতিবিদদের শায়েস্তা করা সেখানে সরকার আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হবে বলে প্রত্যাশা করা যায় না।
শাহদিন বলেন, গত অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে আইন বিচার মন্ত্রণালয়েল বরাদ্দ ছিল ৩২৯ কোটি টাকা। আপরদিকে মৎস্য ও পশু মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৭৯৭ কোটি টাকা। অর্থ্যৎ আইন ও বিচারের উন্নয়নের চেয়ে দেশে মাৎস ও পশুর উন্নয়নের জন্য প্রায় আড়াই গুণ বেশি খরচ হচ্ছে।
রাজধানীর মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারের কিছু বাড়তি কাজ করার জন্য অতিরিক্ত ৪৩০ কোটি টাকার বর্ধিত ব্যয় অনুমোদিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ এক কিলোমিটার বর্ধিত ফ্লাইওভারের খরচ সারা বছরের আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের সব উন্নয়ন কাজের বরাদ্দের চেয়ে ঢের বেশি।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ। দুদক সরকারি দলের দুর্নীতি দেখতে পায়না। সংসদ আছে তবে তার কার্যকর পদক্ষেপ নেই। আর আইনের শাসন না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জনগণের কল্যাণ আনতে পারে না।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে বিচার মানা হয় না, বিচারহীনতা, বিচার বঞ্চনা, আইনের শাসন পাওয়ার অধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। কিছু লোক বিচার করার জন্যই বসে আছেন। ইউনিয়ন পরিষদে যান, দেখবেন গ্রাম্য আদালতের প্রধান ইউপি চেয়ারম্যান। দলীয় লোক হয়ে কীভাবে নিরপেক্ষ বিচার করবেন- প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, থানাতেও রাতের বেলা একজন উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে আদালত বসছে, সেখানে ঘুষের ছড়াছড়ি। যে কারণে এখন আর জমি সংক্রান্ত মামলা কোর্টে না গিয়ে থানায় চলে যায়।
বিচারপতিদের চায়ের আমন্ত্রণ পরিহার করার আহ্বান জানিয়ে বিচারপতি আব্দুল মতিন বলেছেন, আর চা’র দাওয়াত না, আর ডিনার পার্টি না। বিচারপতিরা যদি চায়ের দাওয়াতে যান তাহলে স্বাধীনতা পুরো কাটেল (বাতিল) হয়ে যায়, স্বাধীনতা থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আমরা আদালতের সমালোচনা করলে আদালত অবমাননা হয়ে যায়, কিন্তু সরকারের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী একবার আদালতের আদেশ অমান্য করলেন, এবং বললেন আমি আমার কাজ করবো, দেখি আদালত কী করতে পারে। তারপরও তার প্রতি আদালত অবমাননা হলো না! আমরা গঠনমূলক সমালোচনা করলেই অবমাননা হয়ে যায়, তাহলে কী আমরা কথা বলবো না?
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, এখন কোর্ট দুই ভাগে বিভক্ত। একটি আওয়ামী লীগ, আরেকটি বিএনপি। যদি আইনমন্ত্রী, এমপি বা বিচারপতির সন্তান হওয়া যায়, তাহলে তাদের কাছে ক্লায়েন্টরা যায়। তাহলে আমরা কীভাবে প্র্যাকটিস করবো?
সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, আমরা বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও কার্যকর দেখতে চাই। কিন্তু কলুষিত রাজনীতি বিরাজমান থাকলে বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে না। এ অবস্থায় দুর্নীতি রোধ করা এবং রাজনৈতিক সংস্কার দরকার, যাতে বিচার বিভাগকেও স্বাধীন করা যায় এবং মানুষ ন্যায়বিচার পায়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। এছাড়া বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়। কিন্তু আমাদের বিচার বিভাগ গবির ও দুর্বল বান্ধব নয়। এ অবস্থায় আমাদের বিচার বিভাগকে ক্ষমতাবান্ধব না হয়ে দুর্বলবান্ধব হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.