সরকারের ব্যর্থতা ও অমানবিকতার এক ভয়াবহ কাহিনী by বদরুদ্দীন উমর

২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকার শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মৈত্রী সংঘ মাঠে খেলা করছিল কয়েকটি ছেলেমেয়ে। এ খেলার সময় জিহাদ নামে একটি ৪ বছরের ছেলে মাঠের পাশে ওয়াসার পরিত্যক্ত পানির পাম্পের খোলা পাইপের ৬০০ ফুট নিচে পড়ে যায়। সে তার খেলার সাথীদের সঙ্গে খেলার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ পাইপটি কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ওয়াসার বন্ধ করে দেয়ার কথা থাকলেও চরম গাফিলতির কারণে তারা এ কাজটি না করার ফলে পাইপের মুখ খোলা ছিল। জিহাদের খেলার সাথী মুনসুর যুগান্তরের প্রতিনিধিকে জানায়, জিহাদসহ চারজন সেখানে গোল্লাছুট খেলছিল। এ সময় বিল্লাল নামে একটি ছেলে জিহাদকে ধাওয়া করার সময় সে দৌড় দিতে গিয়ে পাইপটির মধ্যে পড়ে যায়। এ সময় তারা পাইপের মুখে গিয়ে দাঁড়ালে জিহাদের ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার শোনে। এই ছেলেরা চিৎকার শুনে কান্নাকাটি ও চেঁচামেচি শুরু করলে পাশেই এক মুদি দোকানি সিরাজ দৌড়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে শিশুটির কান্নার শব্দ শুনতে পান। এরপর ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে আধঘণ্টা পর তাদের লোকজন সেখানে উপস্থিত হয় (যুগান্তর, ২৮.১২.২০১৪)।
উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণকারী ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা অঞ্চলের সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, রাত ৯টার দিকেও তিনি শিশুটির কান্নার শব্দ শোনেন। তাদের ডাকে শিশুটি সাড়াও দিয়েছিল। শিশুটিকে উপর থেকে কয়েক দফা জুস দেয়া হয়েছিল যা সে খেয়েছিল। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে উপর থেকে পাইপের মাধ্যমে অক্সিজেনও সরবরাহ করা হয়। তাকে জীবিত উদ্ধার করার সব চেষ্টাই তারা করেন (ওই)। কিন্তু সব চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে উপরে আনা সম্ভব হয়নি। পরে ওয়াসার লোকজনও যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এসব চেষ্টা সত্ত্বেও জিহাদকে টেনে উপরে আনা তাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, তাদের হাতে যা কিছু যন্ত্রপাতি ছিল তা নিয়ে শিশুটিকে উদ্ধারের চেষ্টা সত্ত্বেও তারা ব্যর্থ হন। এ সময় শিশুটিকে উদ্ধার করার জন্য রাত সাড়ে ১১টার সময় বশীর নামে এক স্বেচ্ছাসেবক জিহাদকে উদ্ধারের জন্য পাইপের ভেতরে নামার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি রানা প্লাজার দুর্ঘটনার সময় একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অনেক কাজ করেছিলেন। কিন্তু অন্য একজনকে ভেতরে নামতে দিলে তারও জীবনহানির আশংকার কথা ভেবে তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি। বশীর আহমদ বলেন, তার নিজের জীবন বিপন্ন করেও তিনি শিশুটিকে বাঁচাতে পাইপের ভেতরে নামার জন্য দুই দফা চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে বাধা দেয়া হয়। পরে জিয়াউর রহমান নামে আরেক যুবক শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য পাইপের ভেতরে নামার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাকেও ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা নিচে নামতে বাধা দেয়। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস ও ওয়াসার কর্মীরা তাদের হাতে থাকা যন্ত্রপাতি নিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করতে অক্ষম হন। সব থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, রাত তিনটার সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সেখানে উপস্থিত হয়ে আধঘণ্টা পর্যবেক্ষণের পর ঘোষণা করেন, ‘পাইপের ভেতরে শুধু জীবিত নয়, মৃত কোনো মানুষেরও অস্তিত্ব মেলেনি।’ প্রতিমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর ওয়াসা ও ফায়ার সার্ভিসের অক্ষমতার মুখে উদ্ধার কাজ বন্ধ করা হয়! কিন্তু আরেক বিস্ময়কর ব্যাপার হল, তাদের দ্বারা এভাবে উদ্ধার কাজ পরিত্যাগ করার ১৫ মিনিটের মধ্যেই স্থানীয় লোকেরা জিহাদকে উপরে নিয়ে আসতে সক্ষম হন!! এ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘বিশেষজ্ঞ’দের অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্যে যে চরম অমানবিকতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়, এটা নিঃসন্দেহে এক ভয়াবহ ব্যাপার। শুধু তাই নয়, এর অপরাধমূলক চরিত্রও উপেক্ষার বিষয় নয়। জিহাদের খেলার সাথীরা, স্থানীয় লোকরা এবং সর্বোপরি ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা অঞ্চলের সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম নিজে শিশুটির কান্নার আওয়াজ বারবার শোনা সত্ত্বেও প্রতিমন্ত্রীর এ বেপরোয়া ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে সমগ্র প্রশাসন ও সরকারের অমানবিক ও অনৈতিক চরিত্রের প্রতিফলন ঘটে, এ নিয়ে কোনো সুস্থ ও মানবিক চেতনাসম্পন্ন লোকের কি বিতর্কের কোনো অবকাশ আছে? এর জন্য যে প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া দরকার, এ বিষয়েও কারও কি অন্য মত থাকতে পারে?
অন্যদিকে ঘটে আরেক ঘটনা। জিহাদ পানির পাইরে মধ্যে পড়ে যাওয়ায় তার মা ও বাবার অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই শোকে অস্থির ছিল। সেই অবস্থায় নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য পুলিশ জিহাদের বাবা নাসির ফকিরকে থানায় ধরে নিয়ে যায় জিহাদ কোথায় আছে এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য! শুধু তাই নয়, সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার ওপর নির্যাতন করা হয়। এমনকি ক্রসফায়ারের জন্য তাকে র‌্যাবের হাতে তুলে দেয়ার হুমকিও তারা প্রদান করে!! এভাবে তারা শিশুটির শোকগ্রস্ত বাবাকে সেই অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা থানায় আটক রাখে। জিহাদের লাশ হাসপাতালে নেয়ার পরই থানা থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে!!! এখানে প্রশ্ন হল, শিশুটি ওয়াসার খোলা পাইপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার পর কোন যুক্তিতে তার বাবাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হল? একজন সাধারণ মানুষ কী কারণে নিজের সন্তানকে গায়েব করে দিয়ে নাটক করতে পারে? এর কোনো যুক্তি কি সুস্থ লোকের মাথায় আসতে পারে? নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য সরকার ও প্রশাসন কোন পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারে, তার প্রমাণ কি এর মধ্যে পাওয়া যায় না? শুধু তাই নয়, পুলিশের এ নির্যাতনের সাফাই গেয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পুলিশ কমিশনার বলেন, সদিচ্ছাবশত শিশুটির বাবার ‘নিরাপত্তার’ জন্যই তাকে আটক রাখা হয়েছিল! (ডেইলি স্টার ২৯.১২.২০১৪)।
সরকার ও তাদের আজ্ঞাবাহী পুলিশ কথায় কথায় মানুষ ধরে নিয়ে যায়, তাদের ওপর নির্যাতন করে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে তারা সব সীমা অতিক্রম করেছে এতে সন্দেহ কী? এ ক্ষেত্রে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা করেছেন তার অপরাধমূলক চরিত্রই বা অস্বীকার করবে কে? এর জন্য মন্ত্রিসভা থেকে কি তাকে জবাবদিহি করতে বলা এবং এজন্য তার উপযুক্ত শাস্তির দাবি কি অযৌক্তিক?
এখানে উল্লেখ্য, সরকারের এই অপদার্থতা ও অমানবিকতার পরিচয় শুধু এ দুর্ঘটনার মধ্যেই পাওয়া যায়নি। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার সময়ও সরকার ও প্রশাসন নিহত ও আহতদের বিল্ডিং থেকে বাইরে আনার ক্ষেত্রে চরম অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছিল। সে সময় সাধারণ লোকজনই ব্যাপক আকারে উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং তারা যদি এভাবে অংশগ্রহণ না করতেন, তাহলে আরও অনেকেই মারা পড়তেন। সারা দেশে আজ প্রশাসন কীভাবে ভেঙে পড়েছে, চুরি-দুর্নীতি ছাড়া যে তাদের মাথায় আর কোনো ধান্ধা নেই এটা প্রশাসন, পুলিশ এবং সর্বোপরি তাদের সরকারের কার্যকলাপের মধ্যে প্রতিদিনই দেখা গেলেও জিহাদের উদ্ধার কাজে তাদের অক্ষমতা, অপদার্থতা ও অমানবিকতার যে পরিচয় ও প্রমাণ তারা রেখেছে, একটি দেশ ও জনগণের জন্য এর থেকে ভয়াবহ ব্যাপার আর কী হতে পারে?
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.