অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে রাজনীতি by সুজয় মহাজন

(দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে গেছে আলু বহনকারী ট্রাক। ঘটনাটি গত শুক্রবার রাতে বগুড়ার বাইপাস সড়কের চারমাথা নিশিন্দারা এলাকার। ছবিটি তোলা গতকাল বেলা ১১টায় l প্রথম আলো) অর্থবছরের ছয় মাস শেষে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি এখন মাত্র দেড় শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ শতাংশ। আবার গত নভেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ১৪ শতাংশ, অথচ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ২৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হতে হবে। গবেষকেরা বলছেন, অর্থবছর শেষে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হবে ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। নভেম্বরের তুলনায় গত ডিসেম্বরে রপ্তানি কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রবৃদ্ধি গত ছয় মাসে প্রথমবারের মতো ১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তবে জানুয়ারি মাস নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, এরই মধ্যে উৎপাদন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। আর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতিসমূহের ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, টানা অবরোধের কারণে কেবল পরিবহন খাতেই প্রতিদিন গড়ে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। রপ্তানি কম হলে এর প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানের ওপর। আর রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি হলে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে সামগ্রিক বিনিয়োগ ও জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ওপর। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকার কর ও করবহির্ভূত খাত মিলিয়ে ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। এফবিসিসিআইয়ের মতে, রাজস্বের সিংহভাগই আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে, যা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, সরকার চলতি অর্থবছরে যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা কোনোভাবেই পুরোপুরি অর্জিত হবে না। যে পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা ছিল বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতেও বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এমনিতেই দেশে সন্তোষজনক বিনিয়োগ হচ্ছে না। এর মধ্যে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থানীয় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ আরও কমে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরাও। আর পণ্য পাঠাতে না পেরে চরম সংকটে আছেন শীতের সবজি চাষিরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ধরনের রাজনৈতিক সংকট স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে দুইভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্বল্প মেয়াদে শিল্পের উৎপাদন, সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে তাতে করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে, যা গিয়ে পড়বে সাধারণ ভোক্তার ওপর। পাশাপাশি উৎপাদকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রপ্তানিকারকদের ওপরও চাপ বাড়ছে। সরবরাহ সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে উৎপাদন হ্রাস করতে হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও। দেশের বৃহত্তম খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়জাত ও প্লাস্টিকপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ (আরএফএল) গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে জানান, সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠানকে ২০ শতাংশ উৎপাদন কমিয়ে দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য নিয়ে গড়ে প্রতিদিন ৭০০ ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। কিন্তু অবরোধের কারণে এখন ৪০০-৪৫০টির বেশি ট্রাক যাতায়াত করতে পারছে না। গত কয়েক দিনে প্রতিষ্ঠানটির পণ্যবোঝাই ১৮টি ট্রাক ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে করে পুরো সরবরাহব্যবস্থা অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেছেন, ‘বড়দিন শেষে এখন পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ আসার সময়। এ সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্রয়াদেশ কমে যেতে পারে। এরই মধ্যে অনেক ক্রেতা বাংলাদেশে না এসে আমাদের হংকং, থাইল্যান্ডে যেতে বলছেন। এর ফলে উৎপাদন খরচ যেমন বাড়বে তেমনি বাংলাদেশ সম্পর্কে ক্রেতাদের একটি খারাপ ধারণাও তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে যা এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের অপর সংগঠন বিকেএমইএ বলছে, অনাকাঙ্ক্ষিত ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ অবস্থা চললে দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি চলতি বছরশেষে সাড়ে ছয় শতাংশ থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এদিকে বিরাজমান সহিংসতা ও অবরোধের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বিকেলে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে অবরোধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে এফবিসিসিআই। সংগঠনটির মতে, অবরোধকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা ব্যবসায়ী সমাজকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহ্মদ বলেন, এ ধরনের কর্মসূচি বন্ধে আইনগত যদি কোনো সুযোগ থাকে তাহলে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাই আইনগত বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রাজধানীর মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় আরও জানানো হয়, চলমান সংকটে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার জন্য এফবিসিসিআই কোনো উদ্যোগ নেবে না। কারণ, অতীতে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য দুই নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করে কোনো লাভ হয়নি। এফবিসিসিআই বলেছে, চলমান অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবহন, উৎপাদন ও পর্যটন খাত। ২ লাখের বেশি বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান অলস পড়ে আছে আর ২০ লাখের বেশি পরিবহনশ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, চলমান সংকট দীর্ঘায়িত হলে তাতে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদনসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের কাজটি দুরূহ হয়ে পড়বে।

No comments

Powered by Blogger.