সালতামামি ২০১৪- শীর্ষ শিরোনাম ঢাকার বাইরে by কোহিনূর জাহান সোমা

২০১৪ দেশের মানুষের জন্য ছিল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার বছর। ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। খুন, ধর্ষণ ও ছিনতাই ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। এসিড নিক্ষেপ আর ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটেছে। টেন্ডার ছিনতাই আর আধিপত্য বিস্তার ছিল রাজনৈতিক দলের ভেতর। গ্রামবাংলার মানুষ চুরি, ডাকাতির ভয়ে রাতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারেননি। ঘুম থেকে উঠলেই ভোরে দেখা যেত অজ্ঞাত কিংবা পরিচিতজনের লাশ। মোবাইলে সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি ছিল নিত্যদিনের ছবি। সব মিলিয়ে অস্থিরতার মধ্যে বছরটা চলে গেল। জানি না ২০১৫ কেমন হবে?
বছরের শুরুটা ভালভাবে হয়নি। ১লা জানুয়ারি নির্বাচনী সভায় যশোর-১ আসনের এমপি শেখ আফিল উদ্দিন তার কর্মী বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন, ‘ভোটার লাগবে না, ১০০ কর্মী সারাদিন ভোট দেবে।’ একই দিনে ময়মনসিংহে ১৮ দলের ১২৪২ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হলো। ১৮ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের কারণে এ মামলা হয়। এদিন রংপুরে শীতে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৩রা জানুয়ারি ফেনী, খুলনা, নাটোর, নরসিংদী ও সীতাকুণ্ডে ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওইদিন রাতে লালমনিরহাট, মুরাদনগর ও কুমিল্লায় ৩ আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করা হয়। ৪ঠা জানুয়ারি রাতে ৪৩ জেলায় দুই শতাধিক ভোটকেন্দ্রে আগুন দেয়া হয়। হত্যা করা হয় ঠাকুরগাঁওয়ে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারকে।
৫ই জানুয়ারি নির্বাচন শেষ। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৬০টি কেন্দ্রে একযোগে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই নির্বাচনে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন খবরের মধ্যে চটকদার খবর ‘চট্টগ্রামে জাল ভোটের রমরমা ব্যবসা, ঘণ্টায় আয় ২০ হাজার টাকা’। এমন আরও খবর সেদিন এসেছিল বিভিন্ন জেলা আর উপজেলা থেকে। এরপর থেকে শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ।
লাকসামে সংঘর্ষ, বাড়িঘর-দোকানপাট ভাঙচুর, আহত ২৫। এমন সংঘর্ষের খবর আরও আসছিল মাগুরা, বগুড়ার শাজাহানপুর, সিলেট এবং রাজশাহী থেকে। আর এ ঘটনায় বগুড়ায় অর্ধলাখ বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হলো ১০টি। সংঘর্ষ ক্রমে ক্রমে বাড়ছিল। ৬ই জানুয়ারি রাতে ঢাকার দোহার, নোয়াখালী ও দিনাজপুরে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় নিহত হয় ৬ জন।
এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাজীপাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়েছে শিশু ও কিশোররা।
বছরের শুরু থেকেই বিভিন্ন জায়গায় টেন্ডার ছিনতাই, টেন্ডার পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্তাদের হুমকি দেয়া হয়। এমনকি লাঞ্ছিত পর্যন্ত করা হয়েছে।
১২ই জানুয়ারি ঠিকাদারি কাজ না পাওয়ায় মামুন মাহমুদের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুসারীরা ‘বরিশালে জেলা পরিষদের প্রকৌশলী লাঞ্ছিত, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে গালাগাল’ করে।
অপরদিকে ১৬ই জানুয়ারি একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়- “কিশোরগঞ্জে ‘ফেসবুকে’ ছবি পোস্ট করায় জীবন দিলো হাসি।” ভালবেসে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিল মেয়েটি। কিন্তু তার ভাগ্যে বিয়ে জোটেনি। অবশেষে আত্মহত্যা করে সে। এমন অনেক ঘটনাই এ বছর ঘটেছে। তবে শিশু, প্রতিবন্ধী এবং ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাও কম ছিল না। বছরের প্রথম মাসেই যা ঘটেছিল তা আতঙ্কের বীজ বুনেছিল সারা বছরের জন্য। বিউটি (২৫) নামে এক যুবতীকে ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে দেয়ায় সে আত্মহত্যা করে। ঘটনাটি ঘটেছিল ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো। ২রা ফেব্রুয়ারি ‘ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলা’য় আহত হয়েছিল সাংবাদিকসহ অন্তত ২০০ শিক্ষার্থী।
অপরদিকে ৩ জঙ্গি ছিনতাই হয় ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ‘ফিল্মি কায়দায় ৩ জঙ্গি ছিনতাই’। প্রিজন ভ্যানে বোমা, গুলিতে পুলিশ নিহত। তদন্ত কমিটি রেড অ্যালার্ট জারি, ছিনিয়ে নেয়া রাকিব টাঙ্গাইলে গ্রেপ্তার’। একই সময়ে ‘গুন্ডে’ ছবিতে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে’- এ নিয়ে সারা দেশে হইচই পড়েছে। সংঘর্ষও হয়। বিভিন্ন স্থানে এ রিপোর্টটি ছিল বছরের আলোচিত ঘটনার একটি।
এপ্রিল: উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অনেক ছোটখাটো ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন কেন্দ্রে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মিনিটে ভোট পড়েছে ১১টি। অপরদিকে বরগুনার কালিরতরক দাখিল মাদরাসা কেন্দ্রে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা দল বেঁধে ব্যালটে সিল দিয়েছে। অর্থাৎ রাত পোহাবার আগেই ভোট শেষ ৩৫ কেন্দ্রে। সিরাজগঞ্জের শাহ্‌জাদপুরে জোবায়দা-ছোবহান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু-কিশোররা ভোট দেয়। এর প্রতিবাদে ২রা এপ্রিল সেখানে হরতাল ছিল। মৌলভীবাজারের রাজনগরে ৪-৫টি কেন্দ্রে কিছুটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হলেও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একজন বিজিবি’র ধাওয়া খেয়ে। অপরজন সুন্দর মিয়া (৩৬) ভোট দিয়ে বাইরে এসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। নোয়াখালীর সুবর্র্ণচর উপজেলার অনেক কেন্দ্র দখল করে ভোট উৎসব হয়েছে। অপরদিকে, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ক্রসফায়ার ও গণপিটুনিতে বাহিনী প্রধানসহ ৪ জন নিহত হয়েছে। ফেনীতে সন্ত্রাসীরা কারচালককে হত্যা করে তার প্রাইভেট কার নিয়ে গেছে। একই সময় উত্তাল ছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে যৌন হয়রানির বিচারের দাবিতে উত্তাল ছিল শাবি। রাজশাহীতে গৃহবধূর শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা। গ্রেপ্তার ১। ধামরাইয়ে কিশোরকে রিমান্ডে নিয়ে তার গোপনাঙ্গে গরম সুঁই, আগুনের ছ্যাঁকা দেয়া হয়। এই ঘটনাগুলো জনমনে ভয়ের সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া এপ্রিল মাসে রংপুরে সেনাসদস্য অপহরণ, মানিকগঞ্জের সরকারি জমি দখল, গাইবান্ধায় নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা, নাশকতা এবং হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত স্কুল মেরামত দেখিয়ে গাইবান্ধাসহ উত্তরের ৪ জেলায় ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা হাওয়া হয়ে যায়। এই মর্মে ১২ই এপ্রিল উত্তরাঞ্চলে দেড় কোটি টাকা লুটপাট-শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। আর এ মাসে আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ২২শে এপ্রিল। জেলে থেকেও ডাকাতি মামলার আসামী মঈন- নিউজটি পাঠিয়েছিলেন আমাদের সিলেট ব্যুরো প্রধান ওয়েছ খছরু। এছাড়া আলটিমেটাম ‘নারায়ণগঞ্জে ডিসি, এসপিসহ ৫ কর্মকর্তা প্রত্যাহার’। এ সংবাদ সারা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কারণ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং নিখোঁজ অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার সরকারসহ অপহৃতদের উদ্ধারের দাবিতে উত্তাল ছিল নারায়ণগঞ্জ। আইনজীবীরা বর্জন করেন আদালত। বিভিন্ন সংগঠনের দাবিতে নিরুপায় হয়ে প্রশাসন নারায়ণগঞ্জের ডিসি, এসপিসহ ৫ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.