৬২ বছরে ইত্তেফাক

দৈনিক ইত্তেফাক-এর ৬২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। জন্মলগ্ন থেকেই দৈনিক ইত্তেফাক বাংলাদেশকে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে। যাঁদের ত্যাগ, পরামর্শ ও ভালবাসায় দৈনিক ইত্তেফাক কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে এসেছে তাদের আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। দৈনিক ইত্তেফাক গভীর  শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নির্ভীক সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে। এঁদের সীমাহীন প্রেরণা, ভালবাসা ও ত্যাগের বিনিময়ে দৈনিক ইত্তেফাক আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে। দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে দৈনিক ইত্তেফাকের ভূমিকা ছিল অনন্য। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে আপসহীনভাবে সত্য প্রকাশ করে গেছে। একসময়ে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের সামরিক শাসক দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। সে সময়ে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আপস করলে মানিক মিয়া ইত্তেফাক প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি এবং তাঁর চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাংবাদিক শ্রেণী জনমানুষের সংবাদপত্রের প্রতি যে বিশ্বাস তাঁর সঙ্গে আপস করেননি। তিন বছর পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ রেখেছিলেন। পত্রিকার সাংবাদিকরাও অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছিলেন কিন্তু কেউই মাথা নোয়াননি। মানিক মিয়া আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নির্ভীক সাংবাদিকতার যে উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করে গেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। বাঙালির অধিকার রক্ষায় পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে বারবার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়; এমনকি হুমকি ও লোভ-লালসা দেখিয়েও লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। শুধু তাই নয়, ২৫শে মার্চ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অন্যান্য স্থাপনার সঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাককেও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু মানুষের ভালবাসায় বারবার প্রবল প্রতাপে ফিরে এসেছে দৈনিক ইত্তেফাক। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়া ও দৈনিক ইত্তেফাক এই ত্রয়ী এক হয়ে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এক উত্তুঙ্গ সীমাকে স্পর্শ করেছিল। তারই পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার গণতন্ত্রের প্রতি অনমনীয় অবস্থান, ক্ষুরধার লেখনী দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। মানিক মিয়ার মানস দর্পণ ছিল যেন ইত্তেফাকের প্রতিটি পৃষ্ঠা। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল তাঁর সেই সংগ্রামী জীবনের হাতিয়ার। গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এ ব্যক্তিত্ব্ব দেশের সাংবাদিকতাকে বদলে দিয়েছিলেন। মানুষের প্রত্যাশা, বেদনাকে জোরালোভাবে তুলে ধরবার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে জীবনব্যাপী তিনি এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’ শিরোনামে কলাম লিখে দেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন মানিক মিয়া। ‘মোসাফির’ শিরোনামে তাঁর ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে নির্ভীক সত্য ভাষণ, অনন্য রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা এবং গণমানুষের প্রতি ভালবাসার কারণেই বাংলার মানুষের হৃদয়ে তিনি অবিনশ্বর হয়ে রয়েছেন। তার আপসহীন মনোভাবের কারণে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি শাসকরা বারবার তাঁর কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর বারবার নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। ষাটের দশক  থেকে আইয়ুবের মার্শাল ল’ ও মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইত্তেফাক কঠোর অবস্থান নেয়। ১৯৬১ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ ধরার জন্য ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট’ জারি করেন। এ বছর পূর্ব পাকিস্তানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপনের উদ্যোগ নেয়া হলে সরকার, প্রশাসন ও তাদের সমর্থনকারী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বিরোধিতা করে, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন উদযাপন কমিটির সদস্য এবং দৈনিক ইত্তেফাক সে সময় রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৬ সালের ৬ই নভেম্বর আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। দৈনিক ইত্তেফাক ৬ দফার পক্ষে অবস্থান শুধু নয়, অন্যতম প্রচারকের ভূমিকা পালন করে। ১৬ই জুন ১৯৬৬ ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া গ্রেপ্তার হন ও পরদিন পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি নিউ নেশন প্রেসও বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রায় দশ মাস পর ১৯৬৭ সালের ২৯শে মার্চ মানিক মিয়া মুক্তি পান। মুক্তিযুদ্ধের পর দৈনিক ইত্তেফাক নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত হতে থাকে। সময়ের দাবি মেটাতে ইত্তেফাক-এর বিন্যাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে সত্য, তবে ন্যায়, গণতন্ত্র এবং দেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে ইত্তেফাকের অবস্থান কখনো বদলায়নি। বদলাবেও না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই দায়ভার বহন করে যাচ্ছে ইত্তেফাক।

No comments

Powered by Blogger.