তারেক রহমানের দরবারে ভিড় দ্রুত বাড়ছে by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বাংলাদেশে পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে জয়ী হতে না হতেই বিএনপির মরাগাঙে বান ডেকেছে। ঢাকার সাংবাদিকরা তো সেটা টের পাচ্ছেনই, লন্ডনের রাজনীতি-সচেতন বাংলাদেশীরাও সেটা টের পাচ্ছেন বিলক্ষণ। লন্ডনে তারেক রহমানের দরবারে ভিড় বেড়ে গেছে। দেনদরবার, তদবির, উপঢৌকন, তারেক রহমান এখন শাহজাদা নন, শাহেনশাহ। তার ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জেনেছি, আগামী বিএনপি সরকারের মন্ত্রিত্বের উমেদারিও শুরু হয়ে গেছে। খবরটা কতটুকু সঠিক জানি না, মন্ত্রিত্বের উমেদারির সঙ্গে পাউন্ড-ডলারেরও ছড়াছড়ি হচ্ছে। ইচ্ছা করলে তারেক রহমান এখন নাকি লন্ডনেই একটি নতুন হাওয়া ভবন গড়ে তুলতে পারেন। শুধু মন্ত্রিত্বের উমেদারি নয়, বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্যের তদবির তদারকও শুরু হয়ে গেছে। লন্ডনের বাংলাদেশী ও ভারতীয় সাংবাদিক মহলের একটি অংশের খবর, বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন, এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা অনুগৃহীত কিছু বড় ব্যবসায়ী, মিডিয়া মালিকও গোপনে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেন। এমনকি ভারতের কিছু বড় ব্যবসায়ীও। ইউরোপিয়ান কূটনীতিকদেরও কেউ কেউ তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল একটি সেমিনার উপলক্ষে সম্প্রতি লন্ডনে এসেছিলেন। দলীয় কর্মী সভায় এখনও তিনি তার আগের কথাই বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে তারা নির্বাচনে যাবেন না। তার ঘনিষ্ঠ মহলই বলছে, এটা তার মুখের কথা, মনের কথা নয়। সিটি কর্পোরেশনগুলোর পাঁচ পাঁচটিতে বিরাট জয়লাভের পর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিএনপির কোনো স্তরের নেতাকর্মীদেরই আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। এমনকি খালেদা জিয়াও পারবেন না। ক্ষমতার মোয়া এত হাতের কাছে তা জেনেশুনে বিএনপির মতো দল দূরে দাঁড়িয়ে জিভ চাটতে পারে?
তারেক রহমানেরও নাকি স্ট্র্যাটেজি তাই নির্বাচনে যাওয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক আর না হোক। তবে নির্বাচনের এখনও সময় আসেনি। এই সময়টাতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যতটা দরকষাকষি চলে চলুক। যতটা বেশি সুবিধা চাপ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া যায় ততটাই লাভ। লন্ডনে বসে তারেক দলের স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করছেন, ঢাকায় বসে খালেদা জিয়া পুত্রকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খাড়া করে সেই স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন। তারেক নাকি মির্জা ফখরুল, তার মা এবং দলের বর্তমান হাইকমান্ডের বিশ্বস্ত কারও কারও কাছে বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে তার সমবয়সী, সমমনা এবং আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নতুনদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, দলের এবং আঠারো দলীয় জোটের মওদুদ, ডা. বি চৌধুরী, কর্নেল অলি প্রমুখ বয়স্ক ও আগের কোনো মন্ত্রী ও নেতাকে তার কেবিনেটে স্থান দেবেন না।
এই খবরটা, সত্যাসত্য যাই হোক, ফাঁস হয়ে যেতেই আঠারো দলীয় জোটও আর আগের মতো জোটবদ্ধ নয়। ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে। ডা. বি. চৌধুরী, কর্নেল অলি প্রমুখ বিএনপিতে ফিরে আসার উদ্যোগ নিয়ে পিছিয়ে গেছেন। এখন তারা বলছেন, নিজ নিজ দলের অস্তিত্ব বজায় রেখে তারা আঠারো দলীয় জোটে আসবেন; কিন্তু বিএনপির সঙ্গে মিশে যাবেন না। ড. ইউনূস এবং ড. কামাল হোসেন প্রমুখের মধ্যেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে তাড়ানোর জন্য তাদের সব কথাবার্তা, উদ্যোগ, আয়োজন বিএনপির ক্ষমতায় আসাকে সাহায্য জোগাচ্ছে বটে, কিন্তু তারাও- বিশেষ করে ড. কামাল হোসেন জানেন, তারেক রহমানের ক্ষমতায় আসা হবে শুধু দেশের জন্য নয়, তাদের জন্যও এক মহাবিপর্যয়। তারেক ক্ষমতায় আসতে পারলে ব্যবহƒত কমলার খোসার মতো তাদের দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। কাদের সিদ্দিকী খামোখাই গলায় গামছা বেঁধে নর্তন-কুর্দন করছেন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০টি আসনও পাবে না। যদি তাই হয়, তাতে তার লাভটা কী? তার দল কি তিনটা আসনও পাবে? যদি না পায় তাহলে বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচনে জয় হলে তার এত উল্লাসের কারণ কী? কেবল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পরাজয় থেকে সুখ আহরণ? কথায় বলে ‘পাগলের সুখ মনে মনে, রাত্রি হলে তারা গনে।’ তারেক রহমান ক্ষমতায় আসতে পারলে কাদের সাহেবের কদর করবেন, সে আশায় গুড়েবালি, বয়স হয়েছে, কাদের সিদ্দিকীর বোঝা উচিত, তিনি এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীত; বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কোনোটাই নন।
এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশের বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে জেনারেল এরশাদ এবং তার জাতীয় পার্টি কী করবে। দেশের রাজনীতিতে এরশাদ সাহেব এবং জাতীয় পার্টি এখনও একটি বড় ফ্যাক্টর। ড. কামাল হোসেন এবং ড. ইউনূসের চেয়েও রাজনীতিতে এরশাদ সাহেব বড় ফ্যাক্টর। ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম এখন একটি মৃত ঘোড়া। আর ড. ইউনূস কাগজের বাঘ হলেও তার শক্তির উৎস গ্রামীণ ব্যাংকের নারীরা নয় (যেটা তিনি দাবি করেন), তার শক্তির উৎস তার মুখে তীক্ষè আমেরিকান দাঁত (American teeth) রয়েছে। ক্রুশ্চেভ যেমন গত শতকে চীনকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, আমেরিকাকে তোমরা কাগজের বাঘ বলছ বটে, কিন্তু তার আণবিক দাঁত রয়েছে। বাংলাদেশে বিএনপিকেও তাই ড. ইউনূসকে সাদরে ডেকে কোলে স্থান দিতে হচ্ছে।
এরশাদ সাহেব এবং জাতীয় পার্টি এখনও মহাজোটে আছেন। কিন্তু মনস্থির করেননি মহাজোটে থাকবেন কী ছাড়বেন অথবা জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করবে কিনা? জেনারেল এরশাদের রাজনীতির আমি অনেক সমালোচনা করেছি, এখনও করি। কিন্তু এ কথা সত্য, মহাজোটে থাকা অবস্থায় তাকে যতটা অবজ্ঞা ও উপেক্ষা সহ্য করতে হয়েছে, অন্য কোনো দল হলে অনেক আগে মহাজোট ছাড়ত।
এই পার্টি থেকে একজন মাত্র মন্ত্রী গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি এরশাদ সাহেবেরই ছোট ভাই জিএম কাদের। তিনি বিমানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি যতটা অপদস্ত হয়েছেন, এমনকি তার মন্ত্রী দফতরের সেক্রেটারি (তিনি কবিও বটে) যেভাবে যখন তখন তার নির্দেশ অমান্য করাসহ তাকে নানাভাবে অপদস্ত করতেন, সেই করুণ কাহিনী মন্ত্রী থাকাকালে তার মুখ থেকে আমি শুনেছি। তিনি আমার হাত ধরে বলেছেন, ‘ভাই, আমি মন্ত্রী পদ ত্যাগ করতে চাই। আর অবমাননা সহ্য হয় না। কিন্তু বড় ভাইয়ের (এরশাদ) জন্য পারছি না।’ আমি তাকে নিয়ে আমার কলামে লিখেছিলামও।
জাতীয় পার্টিতে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার মতো যোগ্য বহু পুরুষ এবং নারী এমপি আছেন। তাদের মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করা হলে সরকারের যথার্থ পরিচয় মহাজোট সরকার হতো এবং সরকারের দক্ষতা ও শক্তি বাড়ত। এ কথা আওয়ামী লীগ সংগঠনের বেলায়ও সত্য। কেবল অনুগত বিবেচনায় কিছু অযোগ্য ব্যক্তির হাতে সংগঠনটি তুলে না দিয়ে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের সংগঠন পরিচালনার ভার দিলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হাসিনা দলে এবং মন্ত্রিসভায় এমন একা হয়ে যেতেন না। পরিস্থিতি এমন ঘোরালো হয়ে উঠত না।
প্রধানমন্ত্রী একা কত দিক সামলাবেন?
জাতীয় পার্টির কথায় আসি। দেশের এই দুঃসময়ে জাতীয় পার্টি যথার্থই একটি গঠনমূলক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে, যদি এরশাদ সাহেব ঠাণ্ডা মাথায় দলের ভেতরের ও বাইরের চাপ অগ্রাহ্য করে দলের নির্বাচন-পূর্ব নীতিনির্ধারণ এবং দলীয় ঐক্য অক্ষুণœ রাখতে পারেন। জেনারেল এরশাদের উচিত, মহাজোটে তার দলের অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসা এবং সুস্পষ্ট কথাবার্তা বলা। বৈঠক সন্তোষজনক না হলে তিনি এককভাবেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। আঠারো দলীয় জোটে গেলে এবং তারেক রহমানকে ক্ষমতায় এনে এরশাদ সাহেব তার নিজের মর্যাদা ও দলের সম্মান কতটা রক্ষা করতে পারবেন এবং দেশে গণতন্ত্রকে কতটা সুরক্ষা দিতে পারবেন সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে।
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনগুলোতে উপর্যুপরি জয়লাভের পর বিএনপির নেতানেত্রীদের কথাবার্তার ধরনই বদলে গেছে। তারা এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন ইতিমধ্যেই ক্ষমতায় এসে গেছেন। সরকারি প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার অভিযোগ, বিএনপি নেতারা ইতিমধ্যেই তাদের ধমকাতে শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশ না মেনে তাদের হুকুম মানতে বলছেন। হুকুম দেয়া হচ্ছে, তাদের কথা না শুনলে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাদের খবর আছে।
সম্ভবত এই আস্ফালন, ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ বিএনপির জন্য কাল হবে। লন্ডনে তারেক রহমানের দরবারে মন্ত্রিত্বের, ব্যবসা-বাণিজ্যের উমেদারের সংখ্যা যতই বাড়–ক, তাকে ‘ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে প্রদর্শন করে নির্বাচনে নামাই সম্ভবত বিএনপির স্বপ্নভঙ্গের কারণ হবে। ১৮ দলীয় জোটের অভ্যন্তরীণ ঐক্যও তাতে শেষ পর্যন্ত টিকবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।
এই ভুলটি করেছিল ভারতে কংগ্রেস। নেহেরু ডায়েনিস্টের ক্যারিশমা রাহুল গান্ধী বহন করেন এবং ভারতের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠা এই ধারণা থেকে রাহুলকে ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খাড়া করে কংগ্রেস আগামী সাধারণ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করতে চেয়েছিল। অতি অল্প দিনের মধ্যেই দেখা গেছে, রাহুল নেতৃত্বে কোনো ক্যারিশমা এবং ভারতের তরুণ প্রজšে§র ভোটদাতাদের মধ্যেও তার প্রভাব তেমন গড়ে ওঠেনি। এখন কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাহুল গান্ধীকে ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন-প্রচারণায় আর তুলে ধরা হবে না।
বাংলাদেশেও নির্বাচন প্রচারণায় বিএনপি তারেক রহমানকে মূলধন করে এবং তাকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরে দারুণ ভুল করছে। রাহুল ভারতের রাজনীতিতে কিছুটা বিতর্কিত; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমান শুধু বিপুলভাবে বিতর্কিত নন, নিন্দিতও। তার বিরুদ্ধে অতীতের অপকীর্তি, অপশাসন, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির যে বিশাল অভিযোগ, তা মাথায় নিয়ে একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে বসা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আদালতের অনেক বড় বড় মামলা তার মাথার ওপর ঝুলে আছে। তারেক রহমান এসব মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে দেশে আসছেন না। বর্তমান সরকার মেয়াদ শেষে ক্ষমতা ছাড়লেই তিনি দেশে ফিরবেন। তখনই শুরু হবে তার নেতৃত্বের আসল পরীক্ষা। তার বিরোধীরা তখন দলের ভেতরে ও বাইরে- এমনকি আঠারো দলীয় জোটেও মাথা তুলবে। আওয়ামী লীগসহ দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দলও তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। তার অতীতের বিতর্কিত ও নিন্দিত কার্যকলাপ জনসাধারণের সামনে আবার উঠে আসবে।
এই মুহূর্তে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী ভাবতে পারেন, আগামী নির্বাচনে তারেক রহমান তাদের তুরুপের তাস। কিন্তু বাস্তবে এই তুরুপের তাসটি বিতর্ক, বিরোধিতা ও নিন্দার ঝড়ে উড়ে যায় কিনা সময় এলেই তা দেখা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.