ভিন্নমত-মিসরে গণতন্ত্র বনাম সেনাশাসন by আবু আহমেদ

মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সে দেশের প্রধান সেনাপতি আবদেল ফাত্তাহ ক্ষমতা গ্রহণ করে মাত্র এক বছর আগে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসিকে গৃহবন্দি করেছেন।
এখন উৎখাত করা এই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নানা রকমের মামলা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ড. মুরসি একা বন্দি হননি, তাঁর দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতাও এখন জেনারেলদের হাতে বন্দি। অবশ্য সেনাবাহিনী লোকদেখানো একটি বেসামরিক সরকার গঠন করে জনগণকে বোঝাতে চাচ্ছে, তারা মুরসির সরকারকে হটিয়েছে তাহরির স্কয়ারের জনগণের দাবির পক্ষে একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়ে। তারা নিজেরা ক্ষমতা কুক্ষিগত না করে দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের দ্বারা মিসরের এই ক্রান্তিলগ্নে একটি বেসরকারি মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেছে। কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, সেনাবাহিনীকে এই অধিকার দিল কারা? সেনাবাহিনী এবং অনির্বাচিত ব্যক্তিরাই যদি দেশ শাসন করে, তাহলে গত দুই বছরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে মিসরে এত এত নির্বাচন অনুষ্ঠানের কী প্রয়োজন ছিল? তাহরির স্কয়ারে যেসব মুরসিবিরোধী লোক জমায়েত হয়েছিল, তারা মিসরের কত শতাংশ লোকের প্রতিনিধিত্ব করছিল? তারা যদি অধিকাংশ লোকের প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে গত নির্বাচনগুলোতে তারা তাদের নিজেদের প্রার্থী দিয়ে জিতিয়ে আনল না কেন? আসলে সবই ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র বর্তমানের অবস্থায়ও থাকবে না। যারা জোর করে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য থাকবে দুটো- এক. মুরসির দল ব্রাদারহুডকে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় করা। এ জন্য এই দলকে বেআইনি ঘোষণা করতে তারা নতুন নতুন সামরিক ফরমানের আশ্রয় নেবে। এর কারণ হলো, তারা জানে, ব্রাদারহুডকে যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়, তাহলে সেই ব্রাদারহুডই জনগণের সমর্থনে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে। সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই নতুন সরকারের অন্য উদ্দেশ্য থাকবে সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের পুরো প্রশাসনিক কাঠামোকে ফিরিয়ে আনা এবং মুবারকের লোকদের দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করিয়ে ভিন্ন নামে সেনাসমর্থিত সেই পতিত স্বৈরাচারের সহযোগীদের দ্বারা দেশ শাসন করা। সেনাবাহিনীর এসব দুষ্কর্মে মৌন সমর্থন দিতে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কিছু রাজতন্ত্রের আরব রাষ্ট্র। মিসরে ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতাকে এরই মধ্যে সীমিত করা হয়েছে। ড. মুরসির দলের প্রকাশনাগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মুবারকের সময়ে যত দুর্নীতিবাজ দেশের জনগণকে দীর্ঘ ৩৫ বছর শোষণ করেছে সেনাবাহিনীর সহায়তায়, আজকে আবার তারা রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। ড. মুরসি অতি ধীরে এবং শৃঙ্খলার মাধ্যমে দেশে একটা পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কাছে তাঁর পরাজয় হয়েছে। মুবারকের সময়ে নিযুক্ত সব লোকই সর্বত্রই বহাল তবিয়তে ছিলেন। তারাই ক্যু সংঘটনে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে। যে প্রধান বিচারপতিকে দিয়ে সেনাপ্রধানের মন্ত্রিপরিষদ সাজিয়েছে, সেই প্রধানমন্ত্রী মনসুরও মুবারকের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি। আর সেই এল বারাদি, যেন এক খলনায়ক। পদ পেলেই হলো। কিন্তু এসব লোকের জনভিত্তি নেই। মিসরের বর্তমান অবস্থা হলো, এখন থেকে দুই যুগ বা তারও আগের তুরস্কের মতো। সে সময়ে কথিত ইসলামপন্থীরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও সরকার গঠন করে টিকে থাকতে পারেনি তুর্কি জেনারেলদের ষড়যন্ত্রের কারণে। প্রতিবারই তারা তুরস্কের পিতা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ককে দূরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে- এই কথা বলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। এমনকি তুর্কি জেনারেলরা সেই সময়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধর্মের গন্ধ আছে- এমন দলকেও বেআইনি ঘোষণা করেছে। কিন্তু তুরস্কে সেই দিন আর নেই। আবদুল্লাহ গুল আর প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়িপ যখন একে পার্টির প্রধান হলেন এবং বিপুল ভোটে বারবার নির্বাচিত হলেন, তখন থেকে আর্মি জেনারেলরা পিছু হটতে শুরু করে। এখন তুরস্কে বহু ফাইভ স্টার জেনারেল বন্দি। মিসরের অবস্থা হলো অতীতের তুরস্কের মতো। জনগণ চায় একদলকে, আর সেনা জেনারেলরা চায় অন্যদের। তবে জনগণ এখন সত্য-মিথ্যা বুঝতে শিখেছে। পুরনো জেনারেলরা একদিন অবসরে যাবে, নতুন লোকরা যারা জনগণের মনের কথা বুঝতে পারবে, তারা সেনাবাহিনীর ওপরে উঠতে সক্ষম হবে। সেদিন সেনাবাহিনী গণতন্ত্র রক্ষা করবে। আজকের মতো গণতন্ত্র হত্যা করবে না। আলজেরিয়ায়ও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সেই একই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেখানেও সেনাবাহিনী গণরায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ফল হয়েছে, বহু বছর ধরে আলজেরিয়া এক ধরনের গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে ছিল। আজও সে দেশে একটি ফ্রি ইলেকশনের কথা শুনলে সেনাবাহিনী আঁতকে ওঠে।
মিসরে আজকে যে সেনাবাহিনী গজিয়েছে, সেই সেনাবাহিনী বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকারী। সেই সুযোগ-সুবিধার একটু কমতি হোক, সেনাপ্রধানরা সেটা চাইবে না। মিসর আরো অনেক দিন গণতন্ত্র বনাম সেনাবাহিনীর শাসন- এই দোলাচলের মধ্যে চলতে থাকবে। ড. মুরসিকে তারা হটিয়েছে। বিপ্লবের ওপর তারা এরই মধ্যে ডাণ্ডা-জল নিক্ষেপ করতে শুরু করেছে। একদিন তাহরির স্কয়ারও জনশূন্য হবে। নির্বাচন দিচ্ছি দিচ্ছি করে কয়েক বছর সময় নেওয়া হবে। ব্রাদারহুড যাতে আবার কিছুতেই ক্ষমতায় না আসতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হবে। সাথী হিসেবে জেনারেলরা পাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে। ফ্রান্স ও জার্মানি যে কত ভীত, তা তো লিবিয়া ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে সবাই দেখছে। মিসরের ক্ষেত্রেও তাদের সেই ভদ্রলোকি ভণ্ডামি চলতে থাকবে। মিসরের জনগণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়দের কূটচালকে যতই ঘৃণা করুক না কেন, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। যে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সঙ্গে একত্র হয়ে আধুনিক ইরাককে ধ্বংস করেছে, সেই সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার হলেন মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির দূত! আরব জনতা এই সবই বোঝে। যুক্তরাষ্ট্র আর এক স্বৈরশাসক পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান মোশাররফের মাধ্যমেও অনেক ঘৃণিত কাজ করিয়ে নিয়েছে। সেই মোশাররফ এখন পাকিস্তানে বন্দি। বিচারের মুখোমুখি। একদিন মিসরেও আজকে যারা মুরসিকে বন্দি করেছে, তারা বিচারের মুখোমুখি হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.