প্রতি বিঘায় ৪০ মণ ধান ফলিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন মিটুল

শোরের মণিরামপুর উপজেলার সাতগাতী গ্রামের যুবক ফেরদৌস মিটুল ফিলিপাইনের সুপার হাইব্রিড ধানের চাষ করে প্রতি বিঘায় ৪০ মণ ধান ফলিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। এ সাফল্যের কারণে দেশের ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অনেক কৃষিবিজ্ঞানী তাঁর ধানক্ষেত পরিদর্শন করেছেন। কৃষি মন্ত্রণালয় মিটুলকে ফিলিপাইনে পাঠিয়ে উন্নত ধানচাষের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এরপর দেশে ফিরে তিনি সুপার হাইব্রিড ধানচাষের একটি ভিলেজ ও একটি টাউন গড়ে তুলেছেন।
মিটুল মনে করেন, দেশের মোট আবাদি জমির ২০ শতাংশে এই ধানের চাষ করা হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এমনকি ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে চাল বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে। সুপার হাইব্রিড হলেও সম্ভাবনাময় এ ধানের বীজ উৎপাদন শুরু করেছে চুয়াডাঙ্গার দত্তনগর কৃষি ফার্ম।

উচ্চ মাধ্যমিক পাস মিটুল গরিব ঘরের সন্তান। তাঁর মাত্র ১০ শতক ধানের জমি রয়েছে। ২০০৮-০৯ বোরো মৌসুমে তিনি প্রথমে নিজের ১০ শতকের সঙ্গে লিজ নিয়ে মোট ৭০ শতক জমিতে ফিলিপাইনের এসএল-৮-এইচ সুপার হাইব্রিড জাতের ধানের বীজ বপন করেন। তিনি ওই বীজ সংগ্রহ করেছিলেন এক নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে। প্রথমবার ফলন পেয়েছিলেন হেক্টরে ১০ দশমিক ৬৯ টন। এ সময় তাঁর জমিতে 'ক্রপ কাটিং' করেন কৃষিসচিব সি কিউ কে মুস্তাক। এ সাফল্য দেখে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে স্থানীয় সংসদ সদস্য খান টিপু সুলতানের সহযোগিতায় কৃষি মন্ত্রণালয় মিটুলকে ফিলিপাইনে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠায়।

মিটুল বলেন, 'আমি ফিলিপাইনে গেলে এসএল অ্যাগ্রিটেক করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. হেনরি লিম আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিনি আমাকে ম্যানিলা, দাবাও ও মিন্দানাও এলাকার সব কৃষি খামার ঘুরিয়ে দেখান। সুপার হাইব্রিড ধান চাষের কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। আমি আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) পরিদর্শন করি।' দেশে ফিরে মিটুল নতুন উৎসাহে ফের ওই জাতের ধান চাষ করে ২০০৯-১০ বোরো মৌসুমে ১০ দশমিক ৯২ টন হেক্টরে ফলন পান। চলতি বোরো মৌসুমে তিনি হেক্টরে ১২ টন অর্থাৎ বিঘায় ৪০ মণ ধান ফলিয়েছেন।

এ কারণে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. নাজমূল ইসলাম জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিশেষজ্ঞ ড. জেড করিমসহ কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি কর্মকর্তারা তাঁর ধানক্ষেত পরিদর্শন করেন। মিটুল তাঁর এলাকার ১৫০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি এসএল-৮-এইচ ভিলেজ গড়ে তুলেছেন। আর ডাঙ্গা মহিষদিয়া, আশিঙ্গাড়ি ও পাড়িআলি গ্রামের ১৮২ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে ২০০ একর জমি নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি সুপার হাইব্রিড টাউন। এ ছাড়া তিনি কিশোরগঞ্জের নকলায় ১৫০ জন ও গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় ১৫০ জন কৃষককে সুপার হাইব্রিড ধান চাষের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের যশোরের উপপরিচালক মো. তফিজ উদ্দিন বলেন, এসএল-৮-এইচ অপার সম্ভাবনাময় ধান। মিটুল বিঘাপ্রতি ৪০ মণ ফলন পেয়েছেন। এখন দত্তনগর কৃষি ফার্মে এ ধানের বীজ চীনের একজন বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত হচ্ছে। মণিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, 'দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মিটুল একটি মডেল হতে পারে। চলতি বোরো মৌসুমে তাঁর ফলন হয়েছে হেক্টরে ১২ টন। ধান কাটার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। আমার জানা মতে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এত বেশি পরিমাণ ধান এর আগে ফলেনি।'

কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. নাজমূল ইসলাম বলেন, 'মিটুল একজন সফল ও আদর্শ চাষি। আমরা তাঁর প্রযুক্তি ও চাষপদ্ধতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি।' জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিশেষজ্ঞ ড. জেড করিম বলেন, 'আমি মিটুলের ধানক্ষেত পরিদর্শন করেছি। তিনি আধুনিক ধান চাষের দৃষ্টান্ত হতে পারেন।'

মিটুল বলেন, 'আমি একজন গরিব কৃষক। আমি বাংলাদেশের ভাতের অভাব দূর করার জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আমার প্রযুক্তি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চাই। আমি মনে করি, দেশের মোট আবাদি জমির ২০ শতাংশ জমিতে সুপার হাইব্রিড ধানের চাষ করা হলে অবশ্যই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এমনকি আমরা চাল রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব।' তিনি জানান, অনেক কৃষককে তিনি এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এবং কৃষকরা তাঁর কথামতো ধান চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.