ফরাশগঞ্জের রূপকথা

স্বপ্নযাত্রার সফল সমাপ্তি!
স্বাধীনতা কাপের শিরোপা নিয়েই কাল রাতে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে ফিরল ফরাশগঞ্জ। পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে ২০০ গজ দূরে বুড়িগঙ্গার তীরে এই ক্লাব। তিনতলা ভবন রাতভর আনন্দ-উল্লাসে মেতে থেকেছে হয়তো। ক্লাবের ৫২ বছরের ইতিহাসে প্রথম শিরোপা জয়—গোটা এলাকাও নিশ্চয়ই এর সঙ্গে ছিল একাত্ম।
শেখ রাসেলের উত্তরার ক্যাম্পে ঠিক এর বিপরীত ছবি কল্পনা করে নেওয়া যায়। ভাগ্যে শিকে ছিড়ল না দলটির। প্রথম শিরোপা জয়ের সুযোগ ছিল তাদের সামনেও। কিন্তু ফরাশগঞ্জ সেই সুযোগ নস্যাৎ করে নিজেরাই জিতে নিল বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের নতুন এই ফাইনালটা।
উৎসব আনন্দে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম কাঁপল উত্তেজনায়, রোমাঞ্চে। একটা সময় কী হয়, কী হয়—এমন পিনপতন নীরবতা। আবাহনী-মোহামেডান-শেখ জামাল-মুক্তিযোদ্ধার মতো বড় বড় নাম নেই। তাতে কী? এই ফাইনালের শেষটা এর চেয়ে আকর্ষণীয় হতে পারত না!
ইনজুরি কাটিয়ে এই স্বাধীনতা কাপে কালই প্রথম খেলতে নামা কালু জনসনের গোলে ফরাশগঞ্জ এগিয়ে যায় ৪১ মিনিটে। দলকে ফাইনাল পর্যন্ত তুলে আনা নারায়ণগঞ্জের তরুণ স্ট্রাইকার সোহেল রানার ঠেলে দেওয়া বল কালু কঠিন এক কোণ থেকে পাঠান জালে। মনে হচ্ছিল, আবারও একমাত্র গোলটা ধরে রেখে মাঠ ছাড়বে ফরাশগঞ্জ। কিন্তু ৮০ মিনিটে ঘানাইয়ান ডিফেন্ডার আব্বাস ইনুসার গোলে ১-১।
অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচ আর গোল দেখল না। পোস্ট একবার গোল থেকে বঞ্চিত করল রাসেলকে। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারের প্রথম পাঁচ শটে ৩-৩। সাডেন ডেথের প্রথম শটে ১-১। দ্বিতীয় শটেই ম্যাচের নিষ্পত্তি। কী রুদ্ধশ্বাস অবস্থা!
সোহেল রানা, ভিক্টর এডওয়ার্ড নন; নায়ক সুজন চৌধুরী নামের রংপুরের ২৬ বছর বয়সী এক তরুণ। সাডেন ডেথের দ্বিতীয় শটে রাসেলের প্রদীপ বড়ুয়ার শট ঠেকালেন ফরাশগঞ্জ গোলরক্ষক। প্রথম পাঁচ শটের পঞ্চম শটটিও (রাজু) আটকে দেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালের পর ফাইনালেও টাইব্রেকারে দলকে জেতালেন এই সুজন। তাঁর কীর্তি ফরাশগঞ্জের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট।
কোয়ার্টার ফাইনালে আবাহনীকে হারিয়ে সেমিফাইনালে আসা। শেখ জামালকে সোহেল রানার দেওয়া একমাত্র গোলে হারিয়ে ফাইনাল। শেষ লড়াইয়ে শেখ রাসেলকে হারাতে না পারলেও রানার্সআপ ট্রফিটাও বড় প্রাপ্তি হয়ে থাকত। কিন্তু অদম্য ফরাশগঞ্জ ঢাকার শীর্ষপর্যায়ে ৩০ বছর ফুটবল খেলার দীর্ঘ যাত্রায় কালই প্রথম প্রাণভরে উৎসব করতে পারল।
এবারের বাংলাদেশ লিগের প্রথম পর্ব শেষে ১২ দলের মধ্যে ফরাশগঞ্জের অবস্থান দশম। মাত্র দুই জয়ে পয়েন্ট ৯। পাঁচ জয়ে ১৯ পয়েন্ট নিয়ে শেখ রাসেল আছে চতুর্থ স্থানে। কাগজের এই হিসাবকে তুড়ি মেরে ফরাশগঞ্জ বোঝাল, পরিসংখ্যান কখনো ম্যাচ জেতায় না। জেতায় সাহস, কৌশল।
শেখ রাসেলের জন্য এটা হতাশার। ২০০২ সালে প্রিমিয়ার লিগে রানার্সআপ হওয়া দলটির এটাই ছিল প্রথম কোনো ফাইনালে ওঠা। কিন্তু ঘর সামলে প্রতি আক্রমণে ওঠা ফরাশগঞ্জকে আটকাতে পারেনি শেখ রাসেলও। আবাহনী-শেখ জামালের মতো তাদেরও হলো একই পরিণতি।
এর জন্য নিজেকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করতে পারবেন না আব্বাস। দলকে ম্যাচে ফিরিয়ে তিনিই টাইব্রেকারে প্রথম শটটা মারেন বাইরে। রাসেলের এডওয়ার্ড, ডিউক, ইমু গোল পান। সাডেন ডেথে গোল করেছেন ইউসুফ। ফরাশগঞ্জের ভাসানী, মামুন মিয়া, সোহেল রানা গোল করেছেন প্রথম পাঁচ শটে। সাডেন ডেথের প্রথম শটে ইউসুফ। রাসেলের গোলরক্ষক খোকন দাসের শটে হাত ছুুঁইয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেননি।
ভাগ্যদেবী তাকাল ফরাশগঞ্জের দিকেই। ফরাশগঞ্জ ক্লাব কর্তৃপক্ষ খেলোয়াড়দের ২০ লাখ টাকা পুরস্কারের ষোষণা দিয়েছে। স্বপ্নযাত্রার এমন সমাপ্তির পর এমন পুরস্কার তাদের প্রাপ্যই।
ফরাশগঞ্জ: সুজন, সানি, ভাসানী, মোজেস, খোকন দাস, মলয় (জাকির), সোহেল রানা, জুয়েল রানা, সৈকত, (মামুন মিয়া), মোখলেস, কালু জনসন (ইদ্রিস)।
শেখ রাসেল: মামুন, মুরাদ, আমিনুল, প্রদীপ, ইউসুফ, মেজবাহ (শাহেদ/ইমু), মরো মোহাম্মদ, এডওয়ার্ড, রাজু, আব্বাস ইনুসা, ডিউক।

No comments

Powered by Blogger.