স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র: কোথায় পাব তারে? by মুহাম্মদ লুৎফুল হক

ইতিহাস রচনার অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে নথি বা দলিলপত্র। দলিলের সাহায্য ছাড়া সঠিক ইতিহাস প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। ইতিহাসের উপাদান হিসেবে দলিল বলতে আমরা বুঝি সরকারি-বেসরকারি চিঠিপত্র, বই, পত্রপত্রিকা, স্মরণিকা, ছবি, মানচিত্র, স্মারক, চুক্তিপত্র, সাক্ষাৎকার, দিনপঞ্জি, রেকর্ডেড টেপ, সিডি, সিনেমা, রেজিস্টার, হিসাব খাতা ইত্যাদি।
স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিপ্লবী সরকার গঠিত হয় এবং বাংলাদেশ বাহিনী জন্ম নেয়। সাংবাদিক, খেলোয়াড়, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীও স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করে। প্রবাসী বাঙালিরাও নিজ নিজ অবস্থানে থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে। অনেক দেশ ও জাতি এ যুদ্ধে আমাদের নিঃশর্তভাবে সহযোগিতা করে। জাতিসংঘসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বাধীনতাযুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করে। অনেক দেশে আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে সে দেশের সরকারকে প্রভাবান্বিত করার জন্য সাধারণ মানুষ ও ছাত্ররা আন্দোলন গড়ে তোলে। অর্থাৎ, ওই সময়ের ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রধান ইস্যু। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এসব ব্যক্তি, সংস্থা, মিডিয়া, কার্যালয়, বাহিনী, সরকার ইত্যাদি তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের অজস্র উপকরণ বা দলিল সৃষ্টি করে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় এসব দলিলের গুরুত্ব অপরিসীম এবং এসব দলিলের সাহায্য ছাড়া রচিত ইতিহাস বিভিন্ন দোষে দুষ্ট হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলা একাডেমীর অধীন ‘জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস রচনা পরিষদ’ গঠিত হয়। পরিষদ দলিল সংগ্রহের কাজ শুরু করলেও বেশি দূর এগোতে পারেনি। ১৯৭৭ সালে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প’। এ প্রকল্প পূর্বের পরিষদ সংগৃহীত দলিলসহ প্রায় সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠার দলিল সংগ্রহ করে এবং ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র নামে ১৫ হাজার পৃষ্ঠার দলিলসহ ১৫ খণ্ড বই প্রকাশ করে। এ প্রকল্প ১৯৮৮ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস রচনার জন্য সরকার ‘বাংলাদেশ গবেষণা কেন্দ্র’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তটি কার্যকর করা হয়নি। ১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমী জেলাওয়ারি স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস রচনার জন্য ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: দলিল ও ইতিহাস প্রকল্প’ চালু করে কিন্তু প্রকল্পটি অসমাপ্ত থেকে যায়। ২০০১ সালের অক্টোবরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। মন্ত্রণালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়ন, দলিল সংরক্ষণ ও এসব বিষয়ে অব্যাহত গবেষণা। মন্ত্রণালয় ১৯৮২ সালে প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র পুনরায় প্রকাশ করে। এ ছাড়া ২০০৬ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস ১২ খণ্ডে প্রকাশ করা হয়। এরপর স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় আর কোনো সরকারি উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।
১৯৮২ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প’-এর কাছে মোট প্রায় সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠার দলিলপত্র মজুদ ছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যায় এ দলিলগুলোর একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়; রক্ষা পাওয়া অবশিষ্ট দলিল স্থান পায় জাতীয় জাদুঘরে। এ মুহূর্তে জাদুঘরে দলিলপত্রের এক হাজার ৫৫১টি ফাইল আছে, যার পৃষ্ঠাসংখ্যা এক লাখের অধিক হবে না। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ইতিমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত বা স্থানচ্যুত হয়েছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ বাহিনীর দলিলপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর, সেনাবাহিনীর কয়েকটি জাদুঘরে লক্ষ করা যায়। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সাত খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে। একটি খণ্ডে দলিলপত্রের উল্লেখ থাকলেও অন্যান্য খণ্ডে দলিলপত্রের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে যেসব মুক্তিযোদ্ধার ব্যক্তিগত নথি তৈরি হয়েছিল, তা পরে ভারত সরকার বাংলাদেশকে হস্তান্তর করে। দলিলগুলো সেনাবাহিনী সংরক্ষণ করছে। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে এ দলিলগুলোর অবস্থা মোটেও সন্তোষজনক নয়।
স্বাধীনতাযুদ্ধকালে বিভিন্ন ভাষায় আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় স্বাধীনতাযুদ্ধের সংবাদ নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল। এসব পত্রিকার কোনো সংগ্রহ কোথাও লক্ষ করা যায়নি। জাতীয় আর্কাইভস, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর, অন্য কিছু সংস্থা এবং বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পত্রপত্রিকা মজুদ দেখা গেলেও তা সমগ্র পরিমাণের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে দেশ-বিদেশের অনেক পেশাদার ও শৌখিন আলোকচিত্রশিল্পী ছবি তুলেছিলেন। ছবিগুলো এখন পর্যন্ত কেউ সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়নি। এগুলোর বেশির ভাগই অদ্যাবধি অনাবিষ্কৃত। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর, দৃক গ্যালারি এবং জাতীয় আর্কাইভসের উদ্যোগে কিছু ছবির সন্ধান পাওয়া গেছে এবং প্রদর্শিত হচ্ছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্রের কিছু সংগ্রহ জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভস, সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলে মজুদ থাকলেও বড় অংশ এখনো সংগৃহীত হয়নি বলেই প্রতীয়মান। সম্প্রতি পত্রিকা মারফত জানা যায়, ফিল্ম আর্কাইভসে সংরক্ষিত ফিল্মগুলো যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে লিখিত ডায়েরি এবং ব্যক্তিগত চিঠিপত্রও ইতিহাসের উপাদান। ইতিহাস রচনায় এসব দলিল বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ দলিলগুলো বিভিন্ন ব্যক্তিসংগ্রহে আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এখনই এসব ব্যক্তিগত ডায়েরি ও চিঠিপত্র সংগ্রহ না করলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা ধ্বংস হয়ে যাবে।
বেসরকারি উদ্যোগে স্বাধীনতাযুদ্ধভিত্তিক কয়েকটি জাদুঘর বা সংগ্রহশালা গঠিত হয়েছে, যার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সবচেয়ে সমৃদ্ধ। এদের কাছে মূলত আলোকচিত্র, ব্যক্তিগত চিঠি, ডায়েরি, পত্রিকার সংগ্রহ আছে। তবে এদের দলিলপত্রের সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনাও উন্নত মানের নয়। এদের দলিলপত্রের কোনো তালিকা বা ক্যাটালগ তৈরি হয়নি এবং তা গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও কোনো পেশাদারি ছাপ নেই এবং সংরক্ষণের দীনতা সর্বত্র স্পষ্ট। বেসরকারি উদ্যোগে কিছু গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এদের সংগ্রহেও কিছু দলিল আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র (ঢাকা), জেনোসাইড আর্কাইভ অ্যান্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টার (ঢাকা), বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র (চট্টগ্রাম)।
দেশের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে মজুদ স্বাধীনতাযুদ্ধের সব দলিল সংগ্রহ করতে হবে। যদি মূল দলিল না পাওয়া যায়, তবে তার ছায়াকপি, ডিজিটাল কপি বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় পুনর্মুদ্রণ বা পুনর্নির্মাণ করে জাতীয় সংগ্রহে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যক্তির কাছে বা তার পরিবারের সংগ্রহে দলিলপত্র মজুদ আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ দলিলগুলো যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আবার অনেকে এসব দলিলের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছে না বলে এর প্রতি যত্নশীলও নয়। আবার কারও কারও প্রত্যাশা, দলিলাদি পুরোনো হলে সেগুলো অনেক বেশি লাভের উৎস হয়ে উঠতে পারে। ব্যক্তিসংগ্রহে মজুদ এ ধরনের চিঠি, ব্যক্তিগত ডায়েরি, ছবি, পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন দলিলপত্র ক্ষেত্রবিশেষে মজুদকারীকে সম্মানিত করে বা অর্থ প্রদানের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হবে। বিদেশে ব্যক্তি সংগ্রহে মজুদ দলিলপত্রও একই প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করা যেতে পারে। স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলের একটি বড় অংশ ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় আর্কাইভস ও গবেষণাকেন্দ্রে মজুদ আছে। এসব দলিল স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস প্রণয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই ওই সব দেশের সরকারের সঙ্গে দলিল সংগ্রহ বিষয়ে সাংস্কৃতিক চুক্তি হতে পারে।
অনতিবিলম্বে সরকারকে স্বাধীনতাযুদ্ধবিষয়ক আর্কাইভস গঠন করতে হবে। যদি পৃথক আর্কাইভস গঠন করা সম্ভব না হয়, তবে জাতীয় আর্কাইভসের আওতায় একটি স্বাধীনতাযুদ্ধ সেল গঠন করা যেতে পারে। আর্কাইভসে সংগৃহীত সব দলিল পর্যায়ক্রমে ডিজিটাইজড করতে হবে এবং তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে সমগ্র বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ে প্রায় দেড় হাজার বই রচিত হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই দলিল-আশ্রিত নয়। ইতিহাসবিদেরা দলিলপত্রের অভাবকেই স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা মনে করছেন। ইতিহাস নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ না হলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না, দলিলভিত্তিক ইতিহাসই একমাত্র এ মানদণ্ড অর্জন করতে সক্ষম। তাই দলিলপত্রের কোনো বিকল্প নেই।
মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।
lutful55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.