প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা নির্ভর করছে জ্বালানিসংকট নিরসনের ওপর

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি সম্ভাবনা এখন সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছে জ্বালানিসংকট নিরসনে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর। আর জ্বালানিসংকট নিরসনে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুতের অত্যাধুনিক উৎপাদনসক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০০৯-১০) এই অভিমত তুলে ধরা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটির খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের জোগানের অব্যাহত ঘাটতি বিদ্যমান উৎপাদনের ক্ষমতাকে যেমন বাধাগ্রস্ত করছে, তেমনি নতুন উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগকে শ্লথ করে দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে প্রবৃদ্ধির মধ্যমেয়াদি সম্ভাবনার ক্ষেত্রে বাইরের খাত থেকে দুটি ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ দুটি হলো: প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও জনশক্তি রপ্তানিতে নিম্নমুখী প্রবণতা।
তবে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রভাবে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে পারে বলে প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত অগ্রসরমাণ অর্থনীতির দেশগুলো থেকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হলে তা বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
কিন্তু জনশক্তি রপ্তানির নিম্নমুখী প্রবণতা সহজে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা অনেক কম বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি জনশক্তির প্রধান আমদানিকারক দেশগুলোতে, এমনকি যেগুলোয় প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়নি সেগুলোতেও স্থানীয় কর্মসংস্থানকে সুরক্ষা করতে বিদেশি শ্রমিক কমানো শুরু করছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এসব দেশে খুব কম ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি শ্রমিকদের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। ফলে কাজ হারানো বাকি শ্রমিকেরা দেশের শ্রমবাজারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
এই অবস্থায় এসব শ্রমিককে বিদেশি অন্য বাজারে প্রেরণের জন্য সরকারি উদ্যোগের সুপারিশ করার পাশাপাশি দেশীয়ভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগ (এসএমই) স্থাপন করে স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে তেমন আশঙ্কাজনক কিছু দেখছে না। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে মূল্যস্ফীতিকে দ্রুত উসকে দিতে পারে, এমন কোনো উপাদানের সক্রিয়তা এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলে বার্ষিক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের অসন্তোষের বিষয়টি নিষ্পত্তি করায় এবং জ্বালানিমূল্য দ্রুত বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের কোনো ঘোষণা না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমনটি মনে করছে।
তবে অতি মূল্যায়িত পুঁজিবাজার ও আবাসন খাত মধ্য মেয়াদে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে আবাসন খাতের যে স্ফীতি, তা প্রাথমিকভাবে ঋণতাড়িত নয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। তাই এই স্ফীতি প্রশমনে মুদ্রা ও ঋণনীতির প্রভাব তেমন একটা কার্যকর হবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মাধ্যমে শেয়ারবাজারভিত্তিক স্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে আরও আছে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণসীমা অনুসরণ, ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজার কার্যক্রমের মধ্যে সীমারেখা মেনে চলতে বাধ্য করা ইত্যাদি।
পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ে ঋণের বিপরীতে পুনঃ অর্থায়নসুবিধা বাতিল এবং জমি ক্রয়ে ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিশ্ব আর্থিক সংকটে সৃষ্ট বিশ্বমন্দার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খানিকটা দেরিতে পড়েছে। ফলে রপ্তানি, আমদানি ও বিদেশি নতুন বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা কম থাকায় বাংলাদেশে এই সংকটের প্রভাব সীমিত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে রপ্তানির গতি দুর্বল হয়ে গেলেও পরবর্তী সময়ে তা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে এবং সার্বিক প্রবৃদ্ধিও জোরালো হতে শুরু করেছে। এর অন্যতম কারণ হলো কৃষি খাতের গতিময়তা। কৃষি খাতে গতি আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণে জোর তদারকি চালিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় নানা ধরনের সহায়ক পদক্ষেপ নিয়েছে।
সার্বিকভাবে জাতীয় বাজেটে ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের যে ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে, তা অর্জনযোগ্য বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

No comments

Powered by Blogger.