জলবায়ু পরিবর্তন ও ইমামদের সচেতনতা b y মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীব্যাপী যে বিপর্যয় ঘটতে পারে, তা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে এই গ্রহের বাসিন্দাদের। ভূপৃষ্ঠের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিক দুুর্যোগ ও পরিবেশদূষণ, খাদ্যাভাব, কর্মসংস্থানের সংকটসহ নানা সমস্যার আবর্তে নিপতিত। জলবায়ুর এই পরিবর্তন বহুলাংশে মানুষের সৃষ্টি। শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোই এর জন্য প্রধানত দায়ী। সামাজিক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নতি বজায় রাখতে গিয়ে উন্নত দেশগুলো বিশ্বপরিবেশের ওপর এমন বিরূপ প্রভাব ফেলেছে যে গোটা মানব জাতির এক বৃহদাংশের জীবন দারুণ বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অথচ মানুষের বিভিন্ন অপকর্ম থেকে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘জলে-স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু কিছু কাজের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সূরা আর-রুম, আয়াত-৪১)
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবে মেরু অঞ্চলের পাশাপাশি হিমালয়ের বরফও গলে যাচ্ছে বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে। পৃথিবীর শক্তির যে একটা ভারসাম্য আছে, এতে সামান্য একটু পরিবর্তন ঘটলেই ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রায় পরিবর্তন সূচিত হতে পারে। বরফ যত গলছে, সমুদ্রের উচ্চতা তত বাড়ছে। তাই পরিবেশ সংরক্ষণে মসজিদের ইমামদের আরও সোচ্চার হতে হবে। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবার আগে-পরে বক্তৃতা, বিবৃতি, মিলাদ-মাহফিল, আলোচনা ও সভা-সেমিনারের বাইরে ব্যাপকভাবে গণসচেতনতা বাড়াতে জনগণের কাছে যেতে হবে।
উন্নত দেশসহ সবার সম্মিলিতভাবে জলবায়ুদূষণের মাত্রা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ক্রমেই বিশ্বজনমত জোরালো হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে বিশ্বমানবতা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে না পারলে মানবসভ্যতা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের যে অংশটি মানুষের লোভ বা মুনাফার চরম পরিণতি হিসেবে দেখা দিয়েছে, এর প্রতিকারের জন্য বিশ্বব্যাপী মানুষের গণসচেতনতা ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর একান্ত অপরিহার্য। মসজিদের ইমাম-খতিবরা জনগণকে এই শিক্ষা দেবেন যে চেষ্টা ও সাধনা মানব জাতির উন্নতির চাবিকাঠি। মানুষ চেষ্টার মাধ্যমে নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটায় এবং আল্লাহ তাআলা তার জীবনের সফলতার পথ সুগম করে দেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।’ (সূরা আর-রাদ, আয়াত-১১)
মহান সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রাকৃতিক বিধানকে লঙ্ঘন করে প্রায়ই মানুষ নির্বিচারে জাতীয় মহামূল্যবান ভূ-সম্পদ গাছপালা, বৃক্ষলতা, বনজঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, নদীনালা, পশুপাখি ও কীটপতঙ্গ ধ্বংস করছে। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অপচয়, সম্পদ বিনষ্টকরণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাকৃতিক রূপ পরিবর্তিত হয়। অথচ বনজঙ্গল, পাহাড়-পর্বত সবকিছুকেই আল্লাহ তাআলা বিশেষ প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছেন। অপ্রয়োজনে ও লাভের কারণে কখনোই এগুলো বিনষ্ট বা নির্বিচারে ধ্বংস করা উচিত নয়। এতে শরিয়তের দৃষ্টিতে যেমনভাবে পাপী হতে হয়, তেমনিভাবে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতির জন্যও দায়ী হতে হয়; যা মানবতার পরিপন্থী এবং যেকোনো ধর্মের বিচারেও চরম অন্যায়। সৃষ্টির সঠিক প্রয়োগ ও প্রয়োজনের সুন্দর বর্ণনা দিয়ে তা সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘পৃথিবীকে আমি বিস্তৃত করেছি এবং এতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি, আমি পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তু সুপরিমিতভাবে উদ্গত করেছি এবং এতে তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছি আর তোমরা যাদের জীবিকাদাতা নও, তাদের জন্যও। প্রতিটি বস্তুর ভান্ডার আমার কাছে আছে এবং আমি তা জ্ঞাত পরিমাণেই সরবরাহ করে থাকি।’ (সূরা আল-হিজর, আয়াত ১৯-২১)
যারা সৃষ্টিকর্তার বিধান অমান্য করে, মানুষের উপকারী উপাদান ও বৃহৎ সৃষ্টিজগৎ যা মানুষকে ঝড়-তুফান, ভূমিধস, দুর্ভিক্ষ, খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ুর পরিবর্তনে পৃথিবীর উষ্ণায়নের অতিরিক্ত তাপ থেকে রক্ষা করে; সেসব পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল ও নদীনালা ধ্বংস করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে, তারাই হলো প্রকৃতপক্ষে জালিম বা অত্যাচারী; দেশ-জাতি ও মানবতার দুশমন এবং বিশ্বের সব প্রাণীর শত্রু। যাদের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক ও বিশৃঙ্খলা, অসহায় লোকের মৃত্যুর কারণ এবং দেশ ও জনগণের সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে, আল্লাহ এসব জালিমের জুলুম সহ্য করেন না। যে ব্যক্তি কোনো বড় ধরনের অন্যায় বা কবিরা গুনাহ করে, সে সারা বিশ্বের মানুষ, চতুষ্পদ জন্তু ও পশুপাখির প্রতি অবিচার করে। কারণ, তার গুনাহের কারণে অনাবৃষ্টি ও অন্যান্য যেসব বিপদ-আপদ দুনিয়ায় নেমে আসে, এতে সব প্রাণীই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কিয়ামতের দিন এরা সবাই গুনাহগার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করবে। তাদের শাস্তি সম্পর্কে ঘোষিত হয়েছে, ‘কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা আশ-শুরা, আয়াত-৪২)
প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখা এবং এর অনুকূলে পরিশ্রম করার শিক্ষাও মানবতার ধর্ম ইসলাম অত্যন্ত উত্তমরূপে প্রদান করেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ এবং বৃক্ষরোপণের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তেও তোমাদের কারও হাতে একটি চারাগাছ থাকে, তাহলে সে যেন সেই বিপদসংকুল মুহূর্তেও তা রোপণ করে দেয়।’ (আদাবুল মুফরাদ)
অতএব, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মহাবিপর্যয় রোধে দেশের জনগণকেও সচেতন থেকে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করতে হবে এবং পাহাড়-পর্বত, নদীনালা, বনজঙ্গল, সুন্দরবন সুরক্ষাসহ সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রে ও সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষায় সর্বোচ্চ মনোযোগী হতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর ঝুঁকি কমাতে পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্য সামাজিক আন্দোলনসহ গণসচেতনতা বাড়াতে পাড়া-মহল্লায় মসজিদের ইমামগণ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.