দুর্নীতির মামলা -বিচার-প্রক্রিয়ায় গতিসঞ্চারের বিকল্প নেই

আমাদের এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি কি একদমই অসম্ভব? দুর্নীতি দমন কমিশন শত শত মামলার অভিযোগপত্রের অনুমোদন দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে, কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগেরই বিচার-প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি, হচ্ছে না। নিম্ন আদালতে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে, ঢিমেতেতালায় চলবে কত মাস; কত বছর ধরে কে জানে। তারপর কোনো একদিন নিম্ন আদালত রায় দিলে অভিযুক্ত ব্যক্তি আপিল নিয়ে যাবেন উচ্চ আদালতে। সেখানে মামলাটি ঝুলে থাকবে বছরের পর বছর। মোদ্দা কথা কী দাঁড়াচ্ছে? যাঁরা দুর্নীতি করেছেন, করছেন এবং করবেন—তাঁদের বিচার করে দণ্ড দেওয়া এবং তা কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনের শাসন-আকাঙ্ক্ষী বাংলাদেশে।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান স্বভাবতই তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের সুফল দেখতে চাইবেন। দুদকের কর্মোদ্যোগের ফল সমাজে দৃশ্যমান হয়ে না উঠলে, অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না হলে জনগণ প্রশ্ন তুলবেই: দুদক কী করার জন্য আছে? গত দুই বছর প্রতিষ্ঠানটি কী করেছে? জনমনে আরও কৌতূহল জাগবে, এই প্রতিষ্ঠানই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতির অভিযোগে বাঘা বাঘা অনেক রাঘববোয়ালকে আইনের আওতায় নিতে পেরেছিল কী করে?
দুদক গত ১১ মাসে ৪৪৪টি দুর্নীতির মামলার অভিযোগপত্রে অনুমোদন দিয়েছে; কিন্তু অধিকাংশ মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, দেশের বিচার-প্রক্রিয়া ধীরগতির। অতিপ্রাচীন অভিযোগ এটি। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে সম্ভবত সবচেয়ে বড় বাধাই হলো বিচার-প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। কিন্তু এই বাধা অপসারণ কি একদম অসম্ভব? নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচার-প্রক্রিয়ার এমন দীর্ঘসূত্রতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সেসব দূর করার কার্যকর উদ্যোগ কেন নেওয়া হয় না? এই দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে কি বিভিন্ন পক্ষের কায়েমি স্বার্থ গভীরভাবে শেকড় গেড়েছে?
প্রকৃতপক্ষে সরকারের নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে চাইলে দুর্নীতির মামলার বিচার-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা সম্ভব। কিন্তু সে জন্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সরকার যদি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই রাখে যে দুর্নীতির অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেবে না, কেবল মুখে মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাহলে দুর্নীতির মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হবে কী করে? টিআইবির করা দুর্নীতি প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকারের নেতারা প্রতিষ্ঠানটির ওপর পাল্টা আঘাত হানতে যাওয়ার আগে প্রতিবেদনে বর্ণিত চিত্রগুলো গুরুত্বের সঙ্গে যাচাই করে দেখতে পারতেন। টিআইবির প্রতিবেদনে জনসাধারণ বিস্মিত হয়নি, কারণ দুর্নীতি কোথায় কোথায় কী মাত্রায় আছে, তা ভুক্তভোগী জনগণ ভালোভাবেই জানে।
দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে আগে স্বীকার করতে হবে যে দুর্নীতি হচ্ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব সরকারের। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিল নির্বাচনী ইশতেহারে। দুদককে আরও শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি ছিল। সরকার আন্তরিকভাবে চাইলেই তা করতে পারে। দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার-প্রক্রিয়া পর্যন্ত সব ধাপে গতিসঞ্চারের বিষয়টিও নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উচিত এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া।

No comments

Powered by Blogger.