মানসভ্রমণ- 'বেলবটম, পা ইত্যাদি' by আফজাল হোসেন

সালটা মনে আছে, উনিশ শো পঁচাত্তর। প্রথম বিদেশ ভ্রমণের বছর, ভোলা কি যায়? ছোটকাল থেকে ভারতে যাচ্ছি-আসছি, সেটা যেন বিদেশ ভ্রমণ নয়। ভারতকে বিদেশ বলে ভাবাই হয়নি। ধরে নেয়া হয়েছে, ও তো ঘরের কাছে। ‘ঘরের মুরগি ডাল বরাবর’-এর মতো। ছোটবেলায় ভয় ছিল না, পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া টুপ করে পার হয়ে যেতাম, মনে হতো আনন্দময় অভিযান। পশ্চিমবঙ্গে যে মামাবাড়ি সে কারণেও তাকে বিদেশ ভাবতে আলস্য লাগে।
আগে মাঝে মাঝে ওই পারে থাকা মামাতো ভাই শান্তু বা আমার ছোট মামাকে ফোন করে বলে দিতাম ঢাকা থেকে অমুক তারিখ গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি এবং অমুক তারিখে অতটার সময় বর্ডারে আসব। সে অনুযায়ী ওরা আসত, দেখা হতো, কথা হতো। ওরা ওই পারের নিরাপত্তারক্ষীদের জানিয়ে সীমান্তের দিকে এগিয়ে আসত। এসে দাঁড়াত ওপার-এপারের সংযোগ সেতুর মাঝখানটায়। আমি বা আমরাও অনুমতি নিয়ে সে সেতুর ওপর গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যতক্ষণ খুশি কথাবার্তা বলে-টলে যে যার পথে ফিরে যেতাম। এত সহজ সম্পর্কের কারণে দুই দেশকে এই পার-ওই পার ভাবা ছাড়া, এ দেশ-ওই দেশ ভাবা হয়ে ওঠেনি।
ছয় মাস আগে আম্মাকে মামাবাড়ি পার করে দিতে সীমান্তে গিয়েছিলাম। সময় বদলেছে, সেই আপন সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে আর নেই মনে হলো। আমার অনুমতি মিলল সেতু পর্যন্ত যাওয়ার। মানে, সেতুর মুখ পর্যন্ত যাওয়া যাবে কিন্তু তার বেশি মোটেও না। এমন সাবধানবাণী শুনতে হলো। ওপারে শান্তু সেতুর দিকে আসার অনুমতি পায়নি। যেখানে ভারতীয় ইমিগ্রেশন অফিস, সেটা অতিক্রম না করে ওই অত দূরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে জানান দিতে হলো, ‘দেখতে পাচ্ছেন এইটাই আমি, শান্তু’। স্পষ্ট তো দেখা যায় না, এমন দূরত্বের মানুষকে নিকটআত্মীয় বলে চেনা সম্ভব? মানুষের গঠন, আকৃতি এবং ভঙ্গিমা দেখে অনুমান করে নিতে হয়, আর হাত নাড়ালে নিশ্চিত হওয়া যায়, ওই তো।
এই যে একদা ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক কোনো কারণে এত দূরের হয়ে গেল কে জানে? তবে এ দূরত্ব সৃষ্টিতে বহুদিনের যে অভ্যাসে আপন আপন ভাব মনে জমেছিল, সেটার বদল হবে। এবার ধীরে ধীরে মন ভাবতে বাধ্য হবে ওইপার মানে, শুকনো খালের ওইপার নয়, সেটা ভারত। বন্ধু দেশ বা আপাতত দূর সম্পর্কের হলেও সেটা বিদেশ।
যা-ই হোক, পঁচাত্তর সালে যে বয়স ছিল সে বয়স পর্যন্ত ভারত কে বিদেশ বলে ভাবা হয়নি। সেই ছোটকাল থেকে যাওয়া-আসার সহজ পদ্ধতির বদলে পাসপোর্ট-ভিসার নিয়ম-কানুনেও মনের ভাব বদলায়নি। তাই সিঙ্গাপুর যাব বলে যখন তৈরি হচ্ছি, নতুন আনন্দ পাখা মেলেছিল মনেÑ ‘আহা বিদেশ যাচ্ছি’!
কোনো বিশেষ প্রয়োজনে নয়, উদ্দেশ্য ছিল শুধুই বেড়াতে যাওয়া। ছয়-সাতজন বন্ধু ও বন্ধুস্থানীয় একসঙ্গে হয়ে ঠিক করা হলো, যাই ঘুরে আসি। এরপর সবাই বিদেশ ঘুরতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে লেগে যাই।
আমি সে বছর আর্ট কলেজ ছেড়ে বেরিয়েছি। বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকি, গল্পের জন্য ইলাস্ট্রেশন করে পয়সা রোজগার করি। দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত সামনের পাতায় কার্টুন আঁকি আর অভিনয়ও সে বছর শুরু করেছি। এত কা-ে হাতে বেশ পয়সা আসে। পকেটে বা ব্যাংকে টাকা-পয়সা পড়ে থাকবে, তেমন ধাতের মানুষ ছিলাম না। তখন মেতে থাকার বয়স, মনে হতো টাকা-পয়সা কেবল আয় ও ব্যয়ের জন্য। আয় তো ছিল দু-হাতে, ব্যয়ের জন্য চললাম সিঙ্গাপুর।
মনে মহা উত্তেজনা, টিকেট কাটা হয়ে গেছে। ভিসা নিয়ে এখনকার মতো মাথাব্যথা তখন ছিল না। সেটাও যখন হয়ে গেল, দিন গুনতে থাকি আর কতদিন বাকি। প্রথম বিদেশ ভ্রমণ, তাই প্রস্তুতিও দীর্ঘ। কোন জুতো পরে যাব, কোন কোন প্যান্ট-শার্ট সঙ্গে যাবেÑ এগুলো মাথা ঘামানোর বিষয় হয়ে ওঠে। চিরুনি না হেয়ার ব্রাশ কোনটা নিতে হবে সঙ্গে, এসব নানা হিসাব-নিকাশে ব্যস্ততার সীমা নেই।
টগবগে তরুণকালে বিদেশ যাত্রা, কত কী যে ভাবতে হয়। প্রথমে ফ্যাশন নিয়ে ভাবনা। নিজের সবচেয়ে আধুনিক কাপড়-চোপড় সঙ্গে নিতে হবে। বাছাই করে আলাদা করা হলো কোন প্যান্টগুলো সঙ্গে যাবে। তখন বেলবটমের যুগ। প্যান্টের উপরিভাগ টাইট আর হাঁটু থেকে ক্রমে নিচের দিকে যতটা পারা যায় পাজামার মতো ঢোলা। আমার যা ছিল তা থেকে মাত্র দুটো সিঙ্গাপুর যাওয়ার যোগ্য মনে হয়। দুটোতে বিদেশ ভ্রমণ হয়? আরো দুটো বেশি ঢোলা করে নতুন বানিয়ে নিতে হবে ঠিক করি। প্যান্ট বানাতে গিয়ে মনে হলো, চারটে নতুন শার্টও বানিয়ে নেয়া যাক। যেনতেনভাবে বিদেশ যাওয়া মানায় না ভেবে মনমতো বানানো হলো সব।
যাত্রা করলাম সিঙ্গাপুর এবং যাত্রা শেষও হলো, পৌঁছে গেলাম সিঙ্গাপুরের মাটিতে। শহরে ঢুকে হা। সে মাটিতে তখন উল্টো কারবার। বোকা বনে গেছি সবাই। বোকা হলে ভালো ছিল, মনে হলো আধুনিক এক শহরে আমরা সাতটা জোকার নেমে পড়েছি লোক হাসানোর জন্য। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি, মনে মনে বোকার মতো হাসি, সে হাসি মুখে প্রকাশ পায় না। নিজেদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখি আর ভাবি, কোথাও লুকাতে পারলে ভালো হতো। জানি উপায়হীন, তাই সয়ে নিতে হলো।
সিঙ্গাপুরে তখন বেলবটমের যুগ শেষ। কারো পরনে উপরে আঁটোসাঁটো আর নিচে পাজামার মতো ঢিলেঢালা প্যান্ট নেই। সে রকম প্যান্ট পরে আছি শুধু আমরাই কয়জন। প্রথম বিদেশ আসার আনন্দটা মাটি হলো বেলবটমে। প্রথম দিনটা কোনোরকমে কাটিয়ে সবার প্রথম কেনাকাটা শুরু হলো একটা বা দুটো করে প্যান্ট দিয়ে। সেই প্রথম জিন্সের কাপড় দিয়ে তৈরি প্যান্ট নয়, সর্বপ্রথম জিন্সপ্যান্ট পরা হলো আমাদের।
মান-ইজ্জত রক্ষা হলো। বুক ফুলিয়ে নামতে পারলাম শহরে। উঁচু উঁচু দেখতে সুন্দর বিল্ডিং। ছবির মতো সাজানো। হৈচৈ নেই। হুটহাট গাড়ি যাচ্ছে, কেউ হর্ন বাজায় না। মানুষেরা জোরে হেঁকে কথা বলে না। এসব দেখে মুগ্ধ হওয়ার বয়স সেটা নয়, মুগ্ধ হই অন্য কিছুতে। সবাই ফিসফাঁস করে, দেখছিস? আনন্দ-উত্তেজনায় সবার চোখে-মুখে উজ্জ্বল আভা ছটফটায়। চোখে ব্যস্ততা, অস্থিরতা কোনদিকে দেখবে? ডানে তাকালে বাম দিক মিস হয়ে যায়। সামনে তাকালে পেছন দিকে দেখা বাকি রয়ে যায়। সবাই ভাবে, আহা চারদিকে চোখ থাকলে ভালো হতো।
পা দেখার জন্য এত পাগলামো হতে পারে কেউ কখনো ভাবিনি। থাকি বাংলাদেশে, জীবনে যা দেখা হয়নি চোখে তাই পড়লে যেমন দশা হয়, আমাদের হয়েছিল সে রকম। শহর গোল্লায় যাক, চারদিকে কত পা। কথা বলছে, কবিতা লিখছে, গদ্য লিখছে। হাঁটছে না খেলছে, নৃত্য করছে। আমাদের সঙ্গে যেন লাস্যে মেতেছে পায়েরা।
ঢাকায় তখন একশ পুরুষ রাস্তায় দেখলে সে অনুপাতে দশ বা বড়জোর পনেরো জন নারী চোখে পড়ে। সিঙ্গাপুরে তার উল্টো। সব রাস্তাজুড়ে, দোকানজুড়ে চোখ যেদিকে যায় শুধু নারী আর নারী। সে নারীদের সবার পরনে স্কার্ট। অর্থাৎ হাঁটু থেকে নিচের দিকে পুরো পা প্রকাশ্যে। বাঙালি তরুণ চোখ যদি অপ্রত্যাশিত এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হয়, সে কালের হৃদয়ের ছটফটানি বেড়ে ওঠা ছাড়া উপায় থাকে না, ‘অসভ্যতা হচ্ছে’ এমন বিবেচনা হালে পানি পায় না। খুনির কি খুন করার পেছনে যুক্তির অভাব হয়? মন আর চোখ দল পাকায়, জোর বৃদ্ধি করে বলে, পাগুলো তো তাকিয়ে আছে, আমার তাকাতে দোষের কি?
নিজেদের দোষ ছাপিয়ে সিঙ্গাপুরের যে গুণ এখনো মনে ঝকঝক করছে, তা হলো আইন-কানুন রক্ষায় শক্ত ভাব। গাড়ি চলাচলে নিজের সুবিধা অনুযায়ী শর্টকাট তখনও ছিল না, এখনো নেই। তখনো ওই ছোট সামান্য আকৃতির দেশটা যেমন ছড়ানো-ছিটানো ছিল, ত্রিশ-একত্রিশ বছর পার হলেও এখনো সে ভাব বজায় রয়েছে। স্বেচ্ছাচারিতার প্রশ্রয় নেই বলে গাছ কিংবা মানুষের তৈরি ভবনও বেড়ে ওঠে নিয়মে, শৃঙ্খলায়। এখনকার তুলনায় পঁচাত্তরের সিঙ্গাপুরকে ভাবলে বিস্ময় জাগে, একই সঙ্গে হিসাবেও গরমিল হয় না। সবাই জানি, মন্দ থেকেই ভালোর উত্থান, এই হচ্ছে নিয়ম।
পেছনে তাকালে এখন লজ্জা হয়, কী সব কা- যে করেছি তখন। পার্কের বেঞ্চে ছেলেমেয়ে বসে রয়েছে দেখলে হা করে তাকিয়ে থেকেছি। দোকানে গেলে সাবান দেখে মনে হয়েছে এক ডজন কিনে ফেলি। প্লাস্টিকের ফুল দেখে মনে হয়েছে সব যদি দেশে বয়ে নিয়ে যেতে পারতাম।
আমাদের মধ্যে একজন বন্ধু ছিল প্রথম সিঙ্গাপুর এসেছে বলে একমাত্র তারই বাড়তি উত্তেজনা চোখে পড়েনি। সে আমাদের সঙ্গেও থাকত কম। তার উপভোগের ধরনও ছিল আলাদা। নামটা গোপন করে এ লেখার জন্য তার নাম দিলাম পিনু। রাতে বাইরে খেয়ে ঘরে ফিরে যখন সবাই মিলে আড্ডায় মেতে থাকি, হৈচৈ করি, পিনু নিঃশব্দে সব অগ্রাহ্য করে কী যেন হিসাব কষে। অনেক দিন পর জানতে পারলাম কী নিয়ে হিসাব। অনেকে লক্ষ্য করেছি, রুমালের ভাঁজের মধ্যে করে কী যেন আনে, তারপর হিসাব মিলিয়ে ব্যাগে যতœ করে গুছিয়ে-গাছিয়ে রাখে। তা জানতে কেউ গা করেনি কখনো। একদিন বাড়তি আগ্রহে জানা গেল পিনু কোথায় কোথায় ঘুরে ঘড়ির খুচরো যন্ত্রাংশ কিনে আনে। অবাক হই, আমাদের কা-জ্ঞানে কুলায়নি ওগুলো দিয়ে কী হবে?
Ñ রথ দেখা আর কলা বেচা বুঝিস? ওগুলো দেশে ফিরে বেঁচে দিলে সিঙ্গাপুরে যাওয়া-আসার ভাড়া, খাওয়া, ঘুরে বেড়ানোর খরচ উঠে দুটো পয়সা লাভও হাতে থেকে যাবে।
আড্ডা, হৈচৈ ফেলে পিনুর দিকে সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি, কত বুদ্ধি তার? আমরা বদলে গেলাম, মাথায় ঢুকল ওই বুদ্ধি, আমরাও তো বিক্রি হতে পারে এমন কিছু জিনিসপত্র কেনাকাটা করে নিয়ে যেতে পারি। কারো ধারণা নেই কী কিনলে লাভের মুখ দেখা যাবে। সেই ঘড়ির নাড়িভুঁড়ি কেনা বন্ধু পিনু সব জানে, গড়গড় করে বলে দেয় ফটো অ্যালবাম, মেয়েদের জন্য মেক্সি, মেয়েদের জুতা, লিপস্টিক, নেইলপলিশ, পারফিউম আর প্লাস্টিকের ফুল। সবাই সে অনুযায়ী বেড়ানোর আনন্দ মাটি করে খরচের টাকা ওঠানোর ধান্দায় নেমে পড়লাম। রথ দেখতে এসে কলা বেচার উৎসাহে সবার স্বভাব-চরিত্র, হিসাব গেল বদলে।
ঘুরে বেড়ানো, দেখা, সুন্দর জায়গার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য হুটোপুটি, সব গেল। ঘুম থেকে উঠে শুরু হয়ে যায় কেনাকাটার ব্যস্ততা। নতুন নতুন প্রশ্নও সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়,
Ñ এই মালামাল বেচা হবে কীভাবে?
Ñ ভাবতে হবে না, তোরা না পারিস তোদেরটা আমি বেচে দেব।
পিনুর ভরসা পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সবাই। মনে নতুন খুশির উদয় হতে পিনু ‘তবে’ বলে থামিয়ে দেয়। প্রস্তাব করে,
Ñ তোদেরটা বেচে যা লাভ হবে সে লভ্যাংশের অর্ধেক আমার।
এ প্রস্তাবে কারো আপত্তি হওয়ার কথা নয়, সমস্বরে জানাই হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারপর তুমুল উৎসাহে সবাই ঘুরি দোকানে দোকানে। এক সন্ধ্যায় দেখা গেল ফুটপাতে হাঁটু গেড়ে পাহাড় বানিয়ে রাখা লেডিস স্যান্ডেলের জোড়া খুঁজছি বঙ্গসন্তানরা। বিশেষজ্ঞ, উপদেষ্টা পিনু সবাইকে সাহায্য করছে, কোন ডিজাইনের ভালো চাহিদা হতে পারে দেশে। জোড়া মিললেই সেটা যে বেশি দামে বিক্রি করা যাবে তেমন নয়Ñ এই জ্ঞান দান করেছে মান্যবর পিনু। অতএব তার পরামর্শ ছাড়া কেউ এক চুল এগোয় না। সবাই একান্ত অনুগত হয়ে গেলাম। নেতা বনে গেছে পিনু, আমরা হলাম অনুসারী।
বেড়াতে আসা একদল বন্ধু লোভে জড়িয়ে, হয়ে গেলাম কারবারি। ঘুম থেকে উঠে ওইখানে যাব, দেখব অমুকটা এমন আগ্রহ থাকে না কারো। সঙ্গ ছাড়লে ব্যবসা হবে না এই হিসাবে দল বেঁধে সবাই একদিকে যাই, একসঙ্গে ঘুরি, একসঙ্গে খাই। যেন দলে না থাকলে সব জলে যাবে। সব জলে যে গেছে সে হিসাব কারো মাথায় ঢোকে না।
ফিরে আসার সময় এলে প্রত্যেকের সঙ্গী হয়ে ওঠে নতুন একটা করে স্যুটকেস। আমাদের বুদ্ধিদাতা পিনুর আরো বুদ্ধিদীপ্ত এক বিনিয়োগ সবাই হা করে দেখলাম, শেষ বেলায় দেড় হাজার টাকার পরিমাণ সিং ডলারে কেনে একটা ‘আকাই’ টু ইন ওয়ান। জানা যায়, সেটা দেশে নিয়ে অনেক দামে বিক্রি করা যাবে। তার দেখাদেখি কেউ কেউ ছুটে যায় তাই কিনতে।
আমাদের মধ্যে একজন বন্ধু ছিল, ধরে নেই তার নাম কাজল। তখনো ব্যবসায়ে নিজে পুরোপুরি নামেনি কাজল কিন্তু ব্যবসায়ী বাবার অনেক টাকা। শখ হলো সে ভিসিআর কিনবে কিন্তু সাহসে কুলোয় না। শুল্কের টাকা পরিশোধ করে ভিসিআর নিয়ে বেরিয়ে যাবে এমন পরিস্থিতি তখন নয়। তখন কেউ ভিসিআর নিয়ে আসতে চাইলে তা অপরাধ বিবেচনা করা হতো। অতএব শখ হলেও কাজলের সাহস হয় না। আবার সহায় হলো পিনু। বুদ্ধি যেমন তার, সাহসও তেমনি। সে প্রস্তাব করে আমাকে টাকা দিবি, আমি নিজ দায়িত্বে ভিসিআর পার করে দেবো। কাজল মুহূর্ত খানেক দেরি না করে রাজি হয়ে যায়, বিনা টেনশনে নতুন ভিসিআরের মালিক বনে যাবে এ সুযোগ হেলায় হারাতে চায় কে?
এলাম বাংলাদেশে, সবার বুক ধুঁকপুক করছে ভিসিআর আটকে যায় যদি। সাহসী পিনুর এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আগে থেকেই বুদ্ধি এঁটে ভিসিআর ভরে নিয়েছিল ডিনার সেটের কার্টনে। সে কার্টন নিয়ে বীরদর্পে বেরিয়ে গেল সে। হাঁফ ছেড়ে যেন প্রাণে বাঁচি সবাই। আতশবাজির উৎসব শুরু হয়ে যায় মনে, ভিসিআর বিনা ঝক্কিতে বেরিয়ে গেছে। কাজলের চেয়ে খুশি যেন আমরা। যেন সেটা শুধু কাজলের নয়, আমাদের ভিসিআর।
এমন হবে না কেন, মনে পড়ে গেল কী কষ্টেসৃষ্টে ভিসিআর দেখার ইচ্ছা মেটাতে হতো। শুনতাম এখানে-ওখানে পয়সা দিয়ে দেখা যায়। আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হতো না ওসব জায়গায়। আবার হাপিত্যেশও ছিল দেখার জন্য। একবার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে একরাতের জন্য ভিসিআর ধার করে নিয়ে আসা হয়েছিল। একটা সিনেমা সঙ্গে ছিল, আরো দুটোর খোঁজ পাওয়া যায় গুলশানে পরিচিত একজনের বাসায়। সন্ধান মিললেও আনা নেয়া তখন বিপজ্জনক। ভিডিও ক্যাসেট বহন কেন যে তখন অন্যায় ভাবা হতো কে জানে? যা-ই হোক, বুকে সাহস বেঁধে মোটরসাইকেলে চেপে রওনা হলাম গুলশান।
বাড়িতে ভিসিআর এসেছে শুনে আশপাশের ঘরবাড়িতে উৎসবের ঢেউ লেগে যায়। সবাই দুপুর থেকে যাবতীয় কাজ শেষ করার চেষ্টায় লেগে গেছে। সন্ধ্যা থেকে প্রদর্শনী শুরু হবে। একটা ছবির ক্যাসেটে দেখার আনন্দ সম্পূর্ণ হবে না। বিপদের তোয়াক্কা না করে ক্যাসেট জোগাড়ের অভিযানে বেরিয়ে পড়ি। গুলশান গিয়ে পাওয়া গেল ক্যাসেট। হাতে নিয়ে টের পাই বুক ধড়ফড় করছে। সে বস্তু নিয়ে গুলশান থেকে মণিপুরিপাড়া পর্যন্ত আসতে হবে। মনে হতে থাকে তা যেন সাত সমুদ্র তেরো নদীর দূরত্ব।
শার্টের নিচে লুকানো আছে দুটো ক্যাসেট। শহরের পিচের রাস্তায় মোটরসাইকেল ছুটছে, মনে হতে থাকে এই বুঝি দৈত্য-দানো পথ আগলে দাঁড়িয়ে গেল। মোটরসাইকেল তো পঙ্খীরাজ নয়, উড়ে যাওয়ার উপায় নেই। এসব ভাবনা মাথায় ঘুরছে, বুক কাঁপছে ঢিপঢিপ।
বনানী রেল ক্রসিংয়ের কাছে এসে গেছি, আর সামান্য গেলেই মণিপুরীপাড়া। বিপদ প্রায় অতিক্রম করে ফেলেছি। হঠাৎ দেখি সামনে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট, ইশারায় থামতে বলছে। দ্রুত চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে, ধরা পড়ে গেছি। তারপর থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, রাতে থাকতে হবে হাজতখানায়। ওদিকে বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করবে সিনেমা আসছে, সিনেমা আসছে।
সার্জেন্টের সামনে থামতে যাচ্ছি এমন অভিনয় করে হঠাৎ গতি দিলাম বাড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম হুইসেল বেঁজে উঠেছে। আমি দিশাহীন, যত জোরে পারি পালাতে থাকি। শাহীন স্কুলের সামনে পৌঁছে পেছনে তাকাই, সর্বনাশ পুলিশ সার্জেন্ট ধরার জন্য মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটে আসছে। আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার মতো। ইংরেজি ছবির অনেক তাড়া খাওয়ার দৃশ্য চোখে ভাসতে থাকে। মোটরসাইকেলকে মিনতি করে বলি, আজ সম্মান নষ্ট করিসনে ভাই।
সে রাতে সিনেমা দেখার ধরনও অদ্ভুত। এখন ভাবলে হাসি পায়। ড্রইংরুমে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আমি শত চেষ্টা করে টেলিভিশনে ভালো ছবি আনতে পারছি না। শব্দ আসছে, ছবি পরিষ্কার নয়। ছবি ভালো করার চেষ্টায় যতটুকু দেখা যাচ্ছিল সেটুকু হঠাৎ হারিয়ে গেলে পুরো ঘর অধৈর্য হয়ে ওঠে ‘গেল গেল’। সবাই আপত্তি করে, ভালোর দরকার নেই থাক যেমন আছে। যেন ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’।
রাতে আমি ছবি দেখার আগ্রহ হারিয়ে ঘুমাতে চলে যাই। ভোরবেলা দেখি ছবি চলছে। অপরিষ্কার ছবির সামনে সবার চোখ নিষ্পলক এবং বড় আকৃতির। পলক ফেললে বা চোখ ছোট হলে যেন মূল্যবান কিছু হারিয়ে যাবে এই আশঙ্কায় পাথরের মতো হয়ে আছে, নড়ে চড়ে না কেউ।
মন ভরে ভিসিআরে সিনেমা দেখা হয়েছে কাজলের বাসায়। সিঙ্গাপুর থেকে আসার পর। কাজল তার ঘর থেকে যাবতীয় আসবাব বের করে দিয়ে ঢালাও বিছানা করে নিয়েছিল। আমরা চিৎ-কাত হয়ে বা শুয়ে-বসে ছবির পর ছবি দেখতে থাকতাম। সকাল, দুপুর, রাতে বাড়ির লোকজন ঘরের মধ্যে খাবার ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যেত। কেউ আমরা দুদিন ঘর থেকে বের হইনি। এতদিন পর এসব ঘটনার বয়ানে হাসি পাওয়ারই কথা। পাক হাসি, লাগুক বোকা বোকা, এমন জীবনযাপন করে এসেছি, সে কথা তো ঠিক।
পুরনো ঘটনা স্মরণ করে এক বন্ধু সেদিন বিদেশ থেকে ফোন করেছিল। আরো এক বিশেষ কারণে তার ফোন করা। সে শুনেছে পিনু নাকি দেশে দারুণ মর্যাদার এক পুরস্কার পেয়েছে। নিজের কান বা চোখকে বিশ্বাস না করে ফোনে জানতে চায়,
Ñ ঘটনা সত্যি নাকি?
খুবই সত্যি, এ কথা জেনে প্রাণ খুলে হো হো করে হাসে বন্ধুটি।
Ñ সেই আকাই টু ইন ওয়ানের গল্প মনে আছে?
ধরিয়ে দিতে মনে পড়ে যায়। আমরা সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আসার পর গ্রাম থেকে পিনুর পিতা এসেছেন। টু ইন ওয়ান নাড়তে নাড়তে পিতা প্রশংসা করেন পুত্রের।
Ñ এই জিনিসটা এনে ভালোই করেছিস। তোর মা তো গ্রামের বাড়ি সারাদিন একা একা থাকে এই টু ইন ওয়ানটা নিয়ে গেলে তার সময় কাটবে ভালো, খুব খুশিও হবে।
গুণবান পুত্র পিতার উদ্দেশে বলেÑ
Ñ বেশ তো, নিয়ে যাও, আমি দুই হাজার টাকায় কিনেছি বিক্রি করলে তিন হাজার পেতাম, তুমি মায়ের জন্য নিতে চাও ওই কেনা দামটা দিলেই হবে।
আমরা নিজের চোখে যারা দৃশ্যটা দেখেছিলাম এবং নিজের কানে শুনেছিলাম যারা, সবার চোখ বড় আর মুখ হা হয়ে গিয়েছিল।
ফোনের বন্ধুটি সেই পুরনো গল্প তুলে হা হা করে হাসে,
Ñ আমাদের মধ্যে সে-ই ছিল গুণে-মানে অনন্য, অথচ আমরা চিনেছিলাম সে একখানা ‘কচু’।
সে কথার পিঠে কিছু বলার খুঁজে পাই না, চুপ করে থাকি। কোনো কথা নেই বলে ধমক আসে ওই প্রান্ত থেকে।
Ñ কী রে, পলিটিক্যাল নিশ্চুপ কেন? শোন কায়দাবাজি বাদ দে, সোজাসুজি বল। বিদেশে থেকে থেকে স্বভাব গেছে বদলে। স্পষ্ট কথা ছাড়া ইশারা, ইঙ্গিত, চুপ হয়ে যাওয়া এসবের মানে মাথায় ঢোকে না কিছু। গাধা ছিলাম, আরো গাধা হয়ে গেছি। এ জীবনে আর মানুষ হওয়া হলো না।
===========================


সাপ্তাহিক ২০০০ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আফজাল হোসেন

No comments

Powered by Blogger.