তিনটি কবিতা by ওমর শামস

উপমা পুরাণ

১.
আমরা সকলেই একটি প্রসিদ্ধ উপমা জানি। উপমাই যদি কবিত্ব হয় তবে এই উপমাটিকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে:

পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। 
বহু সমাজবাদীরা পোস্টার লিখে, বক্তৃতা দিয়ে, ট্রেড-ইউনিয়ন করে যা বোঝাতে পারেন নি, এই উপমাটি যেন সেই দুরূহ কাজ সম্পন্ন করেছে। আপনারা জানেন, এই উপমাটি কবি সুকান্তর। এবং কুড়ি শতকে কোলকাতায় রচিত।

কী আশ্চর্য, একদিন পুরোনো কবিতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঐ একই উপমা আমি আবার পেয়ে গেলাম তেরো শতকে। একটি বাদামি মরক্কো চামড়ার সোনার জালির মলাটের ভিতরে গয়নার মতো ফার্সি হরফের মধ্য থেকে বেরিয়ে পড়ে:

আমাদের কোনো পানির সোরাহি নেই
আমাদের বস্ত্র নগণ্য,
কোনো কম্বল নেই রাত্রির জন্য—
ভাবি পূর্ণিমার চাঁদ যেন একখানা রুটি।

হে বাংলার বুজুর্গ, আপনারা শুনুন, উপমাটি মৌলানা রুমীর—তেরো শতকে কোনিয়ায় বসে লেখা। সবুজ আর গোলাপি, দুটি ভেজা জলরঙের মতো মিশে যায় সাতশো বছরের দূরত্ব-নৈকট্যের দুটি ভাবনা, দুটি ডানা, দুটি স্পন্দিত বুক।

ভাষা, ত্বক, গোত্র, খাদ্য, বসন এমন কি সময়ের পার্থক্য সত্ত্বেও সকল কবির আত্মা যে একই স্থান-কালে বসবাস করে, তা জেনে আমি প্রফুল্ল হলাম। মনে হলো, বেঁচে থাকার জন্য এ এক একবিংশতম আনন্দ। বোরহেসের বক্তব্য মনে পড়লো:

সকল শ্রেষ্ঠ উপমাই এক।



২.
কিন্তু উপমার অনস্তিত্বও আমি অনুভব করেছি।

যখন সুনামিতে ভেসে যায় তট-গ্রাম-তল্লাট, পশু, পক্ষী, শিশু, অশীতিপর—
তখন?

যখন দাঙ্গায় খুন হয় নিরীহ; যুদ্ধে জ্বলে যায় ক্ষেত-নদী-গৃহ-শহর-শাড়ি-হাড়-মাস—
তখন?

যখন দু-হাজার টন ক্লাস্টার বোম পড়ে মহল্লায়—
তখন?

যখন দুর্ভিক্ষে ধুঁকে-ধুঁকে মরতে থাকে মা ও শিশু,
যখন অস্ত্রোপচারে কাটতে হয় পা, ক্যান্সার কুরে খায় অন্ত্রনালী—
তখন?

তখন কী বলতে পারে উপমা?

বেশি কী বলতে পারে?
কী করতে পারে কূটাভাস?


৩.
একবার ১৯৭২ সনে ঠাটারি বাজারে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে দ্যাখা হয়েছিলো আমার। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলুন, তখন কী বেশি বলতে পারে উপমা, সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনের শিরা-উপশিরার মতো লুকিয়ে!

তিনি শুধু তাকিয়েছিলেনবাবিলন-
নিনেভ-বিদিশার মতো ব্যবধান চোখের মধ্যে ঠিকরে দিয়ে; তারপর হারিয়ে গেলেন ভিড়ের মধ্যে। এই প্রশ্ন নিয়ে আমি একটি ব্যথিত রোগীর মতো অন্ততঃ একটি করুণ অথচ আশাবাদী কমলালেবুর অপেক্ষায় আছি।

যে কাহিনীটি আপনারা শুনলেন, সেটি কি উপমা দিয়ে কখনো বলা যেত!


ম্যাকবেথ

সবাই প্রধান কবি, অপ্রধান কেউ আর নয়,
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী শিল্পের ডালে বসে অমাবস্যায়
কাব্যের খুনসুটি—এ উহারে কয়।

ভাব দিয়ে যায় না হে কাব্যে অভাব,—কৃতি, মগ্ন-চেতনায়।
সেনাপতি, যাদুকর, পাদ্রী, সান্ত্রী, রাজনীতিবিদ—
এদের কৃতিত্বের মন্ত্রণা-সারবত্তা, সমারূঢ় অদ্য কবিতায়।

উপমাই কবিত্ব—ব্রহ্মসত্য জেনে গেছে কবিকুলধর।
যে মতো নিষ্পত্র গাছ সমাবৃত শুধু বিম্বফলে,
উপমায়-উপমায় উদ্বৃত্ত শ্লোক, ঋদ্ধি ও ব্যঞ্জনা তবু অগোচর।

ছন্দে ধরেছে ক্ষয়—ক্ষত, পুঁজ, পিত্তটিও গলা,
তাহার শরীর না কি মর্গে জুড়োলো ব্যবচ্ছেদে কেটে-ছিঁড়ে।
তন্মধ্যে কিঞ্চিৎ নাহি শিল্পকলা।

সোনার আংটি আর নয় সে; জংধরা লোহা যে রূপক।
জীবন নদীর তীরে এক পায়ে বদ্ধপরিকর
শব্দকে লুফে নিতে কবিযশোপ্রার্থী যতো ধুরন্ধর সাহিত্যিক বক।

আরো বক বকধার্মিক, যে পারে ধরে নিতে সরকারী-আবগারী-রোজগারী সুতো।
কবিতাও পণ্য বটে, বিক্রিপন্থা ধনতন্ত্রে সূক্ষ্ম শাস্ত্রকলা,
নবীন শ্রমিক যারা ভক্তিসহ মুছে দেবে প্রবীণের শ্রদ্ধাভর জুতো।

হঠাৎ হাওয়ায় এক বুড়ো কাক এসে বলে, ব্যাঙ্গমা ও হে ব্যাঙ্গমী,
সুবচনী গল্প রাখো, নিবিষ্ট চোখে দ্যাখো, দূরে আরো দূরে:
যেখানে নদীর পারে শ্যাওড়ায়-কুয়াশায় ধোঁয়াচ্ছন্ন আছে পোড়ো জমি,

ওখানে তিনটি বুড়ি, ডাইনী ও পিশাচিনী খলে নাড়ে গভীর পাচন
অমাবস্যায় সবই দেখা যায়: স্মৃতি, সত্তা, ভবিষ্যৎ—কে পায় সোনার খনি,
কার ভাগ্যে লেখা আছে নির্ঘাৎ অকাল মরণ।

ঐ পথ দিয়ে না কি যাবে এক ধনুর্ধর সমারূঢ় কবি,
বুড়িরা বলবে তাকে:
কাকে খুন করবে সে? রাজা হবে,
হস্তগত হবে তার শায়েরীর চাবি।

দুই পাখি

What immortal hands or eye
Could frame thy fearful symmetry!
—William Blake

কেউ কি সত্যি করে বলবে না তবে—
কোত্থেকে আসি আর কোথায়ই বা যাই।
—ওমর খৈয়াম

উইলিয়ম ব্লেক:
অবিনাশী কোন শক্তি, কে ঋত্বিক
বানায় রে মেষ তোরে হ্লাদে হার্দিক?
যামের নেত্রে জ্বলে শক্তি সংরাগ
হলুদ ডোরায় প্রাণে সুগ্রথিত বাঘ!

ওমর খৈয়াম:
নক্ষত্র নিকরে সৌম্য, খুঁত নাহি পাই,
প্রকৃতিও বাঙ্ময়ী নিখুঁত রুবাই।
ব্যাঘ্র ও মেষ তবু কোত্থেকে আসে,
কুত্রাপি যায়—সে জবাব তো নাই!

উইলিয়ম ব্লেক:
মর্মী ও ঋত্বিক এমন ঘটক
অনুপম সৃষ্টি করে শিল্প সংবেদক
পারে নাকি রসায়নী, সাংখ্যতত্ত্ববিদ?
নন্দনহীন বটে রুখা জ্যামিতক!

প্রলয় মহেশ্বর দুষ্ট উরিজেন,
হিল্লোলে ক্যামনে তোলে জলের সফেন!

ওমর খৈয়াম:
প্রকৃতিও সংখ্যারাশি জ্যামিতিতে রচা
বিস্ময়ী যুক্তিধর্মে নক্ষত্র খচা।
ব্যোমের পরিধি পরে ধরা ব্যাঞ্জনা
এক বিন্দু জলেতেও ঐশ্বর্য ধ্বজা।

বিজ্ঞান ও শিল্প যদি দুই চক্রবাল,
অনন্তে, মেলে নিকি সমান্তরাল?
===============================
কবিতাত্রয়ী by টোকন ঠাকুর ও কামরুজ্জামান কামু  কবিতা- 'নিরাকারের মুখ' by সৈয়দ তারিক  ছয়টি কবিতা' by গোলাম কিবরিয়া পিনু   কবিতা- 'স্বর্ণজল্লাদ' by পিয়াস মজিদ  কয়েক'টি কবিতা- by শামসেত তাবরেজী ও আলতাফ হোসেন  গদ্য কবিতা- 'ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুল' by শামীম রেজা  কবিতা- 'আমার গ্রীষ্মকাল' by কাজল শাহনেওয়াজ  কবিতা- 'পাঁচটি কবিতা' by মুজিব ইরম  কবিতা- 'পাগলের হাসি ও অন্যান্য কবিতা' by মহাদেব সাহা   কবিতা- 'যেভাবে ঘরের কিসসা রচিত হয়' by ওমর কায়সার   কবিতা- 'বীতকৃত্য ও অন্যান্য কবিতা' by মাসুদ খান   কবিতা- 'পাঁচটি কবিতা' by সরকার আমিন   কবিতা- 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি'   পাঁচটি কবিতা' by অবনি অনার্য  কবিতা- 'ছুটপালক' by সব্যসাচী সান্যাল  গদ্য কবিতা- 'লীলা আমার বোন' by নান্নু মাহবুব   কবিতা- 'উৎসর্গ' by অসীম সাহা  তিনটি কবিতা' by বদরে মুনীর  কবিতা- 'সেরগেই এসেনিন বলছে' by আবদুল মান্নান সৈয়দ  কবিতা-মোহাম্মদ রফিক এর কপিলা থেকে ও অঙ্গীকার  কবিতা- 'সেতু' by বায়েজীদ মাহবুব  উপন্যাস- 'রৌরব'  by লীসা গাজী »»»   (পর্ব-এক) # (পর্ব-দুই) # (পর্ব-তিন) # (পর্ব-চার শেষ)   গল্প- 'পান্নালালের বাস্তু' by সিউতি সবুর   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা  আহমদ ছফার অগ্রন্থিত রচনা কর্ণফুলীর ধারে




bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ ওমর শামস


এই কবিতা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.