স্বপ্নকথা- 'আত্মবিশ্বাসী মানুষই সফল হয়' by —বেনজির ভুট্টো

বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বেনজির ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
 
এরপর ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত অক্সফোর্ডের লেডি মার্গারেট হল থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেন।
এলএমএফ শেষে অক্সফোর্ডের সেন্ট ক্যাথরিন কলেজ থেকে ডিগ্রি নেন তিনি এবং এশিয়ার প্রথম নারী হিসেবে ‘অক্সফোর্ড ইউনিয়ন বিতর্ক সোসাইটি’র সভাপ্রধান নির্বাচিত হন।
২৭ ডিসেম্বর, ২০০৭ রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৫৩ সালের ২১ জুন পাকিস্তানের করাচিতে তাঁর জন্ম।

আমার বাবা ছিলেন আমার সারা জীবনের অনুপ্রেরণা। আমি যখন আমার পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে তাকাই, দেখি তখন প্রচণ্ডভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যবধান ছিল, নারীদের প্রতি চরম বৈষম্য প্রকটভাবে উপস্থিত ছিল। আর বাবা ছিলেন সব সময়ই এর বিরুদ্ধে। আমার মা ছিলেন সব ক্ষেত্রে পারদর্শী একজন নারী। করাচির রাস্তায় তিনি ছিলেন প্রথম একজন নারী, যিনি একা গাড়ি নিজেই চালাতেন। কিন্তু মা শেখাতেন, একজন নারী বিয়ে আর সন্তান জন্ম দেওয়া ও লালন-পালনের জন্যই তৈরি হয়। মা বাবাকে বলতেন, কেন তুমি ওকে পড়াশোনা শেখাচ্ছ? কোনো পুরুষই তো আর তাকে বিয়ে করবে না। সেই সময়ে মায়ের কাছে নারীর সফলতা মানেই ছিল, কীভাবে সে একজন ভালো স্বামী পেতে পারে, সন্তান বড় করতে পারে। অথচ আমার বাবা এসব কিছুকে পাত্তাই দিতেন না। উল্টো সব বাধা ভেঙে দিয়ে আমার উচ্চশিক্ষার জন্য সর্বদা সচেষ্টা থেকে গেছেন। বাবা বলতেন, ‘ছেলে ও মেয়ে সবাই সমান, আমি চাই আমার মেয়ে সেই সব সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে, যা একজন ছেলেকে দেওয়া হয় এবং যা মেয়ে হিসেবে ওর প্রাপ্য।’
বাবাকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি, কেন তিনি এমনটা ভাবতেন। আমার সুযোগ হয়নি সেটা জানার। বিশ্ববিদ্যালয় শেষে আমি যখন ফিরে এসেছিলাম তখন তিনি জেলে ছিলেন অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে, ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। আমার এক বান্ধবী ছিল, যার বাসায় আমি প্রায়ই যেতাম—তারা তাদের ভাইয়ের খাওয়া শেষ না হলে খেতে পেত না। তাদের খাওয়া হলে পড়ে থাকা এঁটো খাবার বাড়ির মেয়েরা খেত। আমাদের বাড়িতে তেমনটা কখনোই হতো না। আমি টেবিলের প্রধান আসনে বসতাম, কারণ আমি পরিবারের বড় ছিলাম। বাবা আমাকে এটা শেখাতে সমর্থ হয়েছিলেন যে মেয়েরা কোনোভাবেই পৃথিবীর হেয়প্রতিপন্ন প্রাণী নয়।
আমাকে জীবন সম্পর্কে আরও শিখিয়েছিলেন আমার নানরা। ছোটবেলায় আমি পড়তাম মিশনারিজ স্কুলে—কভন্যান্ট অব জোসেফ অ্যান্ড ম্যারি। মনে আছে, ‘মাদার ইউজিন’ আমাকে নিয়ে যেতেন সাহিত্য আর কাব্যের জগতে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন চাঁদ গ্রহপুঞ্জের সঙ্গে। এটা এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল, যে কেউ চাঁদ আর নক্ষত্রকে জয় করতে চাইবে। তাই আমার জীবনের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষদের তালিকায় আছেন, আমার বাবা এবং মাদার ইউজিন।
আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম। আমার বাবা সব সময়ই পড়াশোনার ওপর বেশি জোর দিতেন এবং আমি দেখতাম, তিনি কতটা সন্তুষ্ট হতেন আমার ভালো ফল দেখে। আমি অনেক বেশি পরিশ্রমী ছিলাম এবং সবকিছু খুব ভালোবেসে শিখতে চাইতাম।
‘আমার মনে হয়, আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো কেটেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি সেখানে এমন সময়টায় ছিলাম, যখন সেখানকার সমাজে একটা অভাবনীয় বদল লেগেছিল। এমন একটা সময়, যখন ভিয়েতনাম-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আমি যুদ্ধের সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিলাম এবং আমি দেখেছিলাম, আমার আমেরিকান সহপাঠীরাও এ যুদ্ধের তীব্র বিপক্ষে ছিল। তারা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে নেমেছিল। আমি শিখেছি, যদি তুমি কোনো কিছুকে না সমর্থন করো, তাহলে তা রুখতে তুমিই ভূমিকা রাখতে পারো। আমি সে সময়টায় দেখেছি রবার্ট কেনেডি, মার্টিন লুথার কিংকে এবং দেখেছি আদর্শবাদকে, সিজার শাভেজ এবং শ্রম অধিকার নিয়ে আন্দোলনকে। তাই আমি ছিলাম পৃথিবী, সমাজ ও মানুষকে বাঁচানোর দলে। তখন সবাই এই বাঁচানোর দলে প্রাণপণ নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছে। আমরা ভেবেছিলাম, পুঁথিগত শিক্ষার গুরুত্ব নেই। পরীক্ষার কোনো দরকার নেই। যদিও আমি পড়তাম, পরীক্ষা দিতাম, আমার বাবার কথা চিন্তা করে। কিন্তু একটা সময় আমি আবিষ্কার করি পড়াশোনা, বাড়ির কাজ, টিউটোরিয়াল সব বাঁধাধরা গণ্ডি—এসব কিছু ছাড়াও জীবনে আরও অনেক বৃহৎ আলোচ্য বিষয় আছে, ক্ষেত্র আছে, যেখানে আমাদেরই ভূমিকা রাখতে হবে।
তখন নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। কেট মিলেট কেবল তাঁর বই লিখলেন, যা নিয়ে আমরা অনেক আলোচনা করেছি। কথা বলেছি, নারী এবং তাঁর সাফল্য নিয়ে। আমার এক অসম্ভব প্রিয় বন্ধুর কথা মনে আছে—ইউন্ডি লেসার। আমরা অনেক সময় ধরে আলাপ করতাম। কীভাবে নারী সফল হবেন? কীভাবে সে বাধা তাঁরা প্রতিরোধ করবেন? তখন অনেক নারীই মনে করতেন, তাঁদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য পেশা-ভাবনা নয়, বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া।
হার্ভার্ড-জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোই আমি পাকিস্তানে নিয়ে আসি আমার সঙ্গে। কেন আমরা আমাদের সরকার কিংবা সরকারব্যবস্থাকে বদলাতে পারব না। আমি দেখেছি, নিক্সনকে কীভাবে ইমপিচ করা হয়েছিল ওয়ারগেট কেলেঙ্কারিতে।
আমি দেখেছি, গণতন্ত্র কতটা ক্ষমতাবান। এটা সত্যিই অনেক প্রভাবশালী। গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে আমি নিজে আমার ক্ষমতাকে অনুভব করতে পারি। আমি জানি, আমার কথাকে মূল্য দেওয়া হবে এবং সবাইকে। এখানে স্থান দেওয়া হয় সবাইকে। আমার বিদেশে উচ্চশিক্ষার মধ্যবর্তী সময়ে বাবা পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেমে পড়েন। তিনি পাকিস্তানের সব সাধারণ মানুষকে আত্ম-অধিকারে সচেতন করতে চেয়েছিলেন সামন্তবাদের বিরুদ্ধে, সেনা শাসকদের বিরুদ্ধে। আমি যখন পাকিস্তানে ফিরে এসেছিলাম, এসব অভিজ্ঞতাই আমাকে অনেক দূর নিয়ে গিয়েছিল। আমি দেখেছি, গণতন্ত্র কীভাবে সফল হতে পারে, সেটা পাকিস্তান কিংবা আমেরিকা, যেখানেই হোক না কেন।
যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন আমি সব সময় সংঘাত, হানাহানি, রক্তপাত—এসব কিছুর বিরুদ্ধে ছিলাম। পঞ্চাশের দশকে মানুষের বিনোদনই ছিল শিকারে যাওয়া, শিকার করা। একবার আমার বাবা ও ভাইদের শিকারে একটা টিয়াপাখি গুলির আঘাতে মাটিতে আছড়ে পড়ে। আমি তার রক্ত সহ্য করতে পারছিলাম না। হাস্যকর শোনাতে পারে। কিন্তু আমি ওই পাখিটার কথাই ভাবছিলাম, কেন তাকে এমন পরিণতি মেনে নিতে হবে। পরিহাসই বটে—ফাঁসির দণ্ড শোনার পর আমার বাবা বলে উঠলেন, ‘আমার সেই ছোট্ট মেয়েটির কথা মনে পড়ছে, যে একটা পাখির জন্য কেঁদেছিল। আজ সে কী করবে?’
আমার বাবার মৃত্যুটাও আমাকে অনেকভাবে তৈরি করেছে। আমি আমার বাবার আত্মত্যাগ, সে সময়ে অন্যায়ভাবে নিহত সবার আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দিতে চাইনি। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। শুধু একজন নারী হিসেবে নয়, মাত্র ৩৫ বছরে মুসলিম একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারার তৃপ্তিটা ছিল এমন যে এ বিজয় নারীদের সবখানে। এ জয়ের পর আমার কাছে অনেক নারীর চিঠিও এসেছে—দেশের বাইরে থেকে, দেশের ভেতর থেকে, যে নারী হিসেবে দেশ চালানো ঠিক নয়। আমি জানি না, কেন? এটা আসলেই বিচিত্র মানুষের পৃথিবী। আমার মনে আছে, সেই নারীর কথা, যে বিমানচালক হতে চেয়েছিল। সাক্ষাৎকারে তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলা হয়, ‘ফিরে এসো, যখন আমাদের এখানে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হবে।’ এ বিজয়ের পর সত্যিই সেই নারী ফিরে গিয়েছিল এবং পাইলট হতে পেরেছিল।
বিতর্ক আরও উঠেছিল। আমার রাজনৈতিক আদর্শও বিতর্কের বাইরে ছিল না। কিন্তু আমি এসব কিছুর সঙ্গে লড়েছি, আমার এজেন্ডাগুলোর সঙ্গে। এজেন্ডাগুলো ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, দারিদ্র্য দূর করার জন্য, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য। এবং আমরা সফল হয়েছিলাম। সমালোচনাও সব সময় ছিল। কিন্তু আমার প্রথম নির্বাচনের পর আমি শিখেছিলাম, সমালোচনাকে গ্রহণ করতে হয়।
আমি দেখেছি, গণতন্ত্র কতটা ক্ষমতাবান, গণতন্ত্র মানুষের মধ্যে কতটা ক্ষমতা জাগিয়ে দেয়। জীবনে আমাদের অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু আমি মনে করি, নেতৃত্বই নির্ধারণ করে দেয় আমাদের ক্ষমতাকে—কতটুকু হারকে মেনে নেব এবং কীভাবে হারকে পরাভূত করব। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে থাকার পর আমি দৃঢ়ভাবে এই উপসংহারে আসি, যে সফল হয় এবং যে হেরে যায়, তাদের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো কে তার সফলতা কিংবা বিফলতাকে কতটুকু গ্রহণ করতে পারে এবং সেখান থেকে ফিরে আসার ক্ষমতা রাখে। কারণ সফল হওয়ার এই অভিযাত্রায়, সেখানে বিপর্যয় থাকবে, হতাশায় মুহ্যমান হওয়া মানুষ থাকবে এবং আত্মবিশ্বাসী মানুষ থাকবে যারা বলবে—না, আমরা এগিয়ে যাব। এটিই বিফলতাকে জয় করার আসল ক্ষমতা।
অ্যাকাডেমি অব অ্যাচিভমেন্ট থেকে পাওয়া। ২০০০ সালের ২৭ অক্টোবর দেওয়া সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ: শিখিত সানী
================================
আবিষ্কার খবর- আমাজনে নতুন নতুন প্রজাতির সাপ ব্যাঙ মাছ  খবর- পরমাণু চুল্লিতে জ্বালানি ভরা শুরু করেছে ইরান  কিশোর ফিচার- 'আকাশছোয়াঁ টাওয়ার ‘বুর্জ খলিফা’ by জ়ে হুসাইন  গল্প- 'ঘোস্ট হাউজ অপারেশন' by আব্দুল্লাহ আল নোমান  আলোচনা- 'মহানবীর (সা): আদর্শ জীবন' by অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান  ভ্রমণ- 'মাধবপুর লেক ভ্রমণে' by খালেদ আহমদ শিমুল  স্বাস্থ্য আলোচনা- 'সুস্থতার জন্য হাসি' by আবু হেনা আবিদ জাফর  বিজ্ঞান আলোচনা- 'মহাকাশের পড়শিরা' by মো: সাইফুল ইসলাম  বিজ্ঞান আলোচনা- 'পরিবেশবান্ধব হাইব্রিড কার' by সাকিব রায়হান  বিজ্ঞান আলোচনা- 'হারিয়ে যাবে দানব গ্রহ!' by সাকিব রায়হান  গল্প- 'ট্রেনের হুইসেল' by হামিদুল ইসলাম  আলোচনা- 'জীবজগতে বেঁচে থাকার কৌশল' by আরিফ হাসান  আলোচনা- 'মিনার : মুসলিম সভ্যতার অনন্য নিদর্শন' by শেখ মারুফ সৈকত 

প্রথম আলোর সৌজন্যে
লেখকঃ বেনজির ভুট্টো

অনুবাদ: শিখিত সানী

এই খবর'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.