রণক্ষেত্র সিলেট: মুহুর্মুহু গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল by ওয়েছ খছরু

সন্ধ্যা যখন নামছিল তখন অন্ধকার চারদিকে। এই অবস্থায়ও সিলেট নগরের প্রাণকেন্দ্র চৌহাট্টার চতুর্দিকের এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সংঘর্ষ চলছিল। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছিল গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেলের শব্দ। এর আগে বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। প্রায় ৩ ঘণ্টা কয়েকশ’ রাউন্ড গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠে সিলেট নগর। নগরের হাওয়াপাড়া, তাঁতিপাড়া, রিকাবীবাজার, দরগাহ মহল্লা, জিন্দাবাজার, মীরবক্সটুলা, আম্বরখানা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। এ কারণে বাসাবাড়িতে আটকে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দোকানপাটের শাটার বন্ধ রেখে ভেতরে ভয়ে কাঁপছিল আশ্রয় নেয়া সাধারণ লোকজন। বাইরে শুধু শব্দ আর শব্দ। সেই সঙ্গে চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে আসছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন; শত শত রাউন্ড গুলির শব্দ তারা বাসাবাড়িতে বসেই শুনেছেন। অনেকেরই দরোজা, জানালায় এসে ছররা গুলি লেগেছে। টিয়ারশেলের ঝাঁঝে বাসাবাড়িতে থাকা শিশু ও বৃদ্ধ লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। দিনের শুরুতে সিলেটের পরিস্থিতি শান্তই ছিল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী অভিভাবকদের গন্তব্যস্থল ছিল সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।  বেলা ১১টা থেকে শুরু হয় কর্মসূচি। নানা ব্যানারে লোকজন এসে শহীদ মিনারে জমায়েত হয়ে কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। দুপুরে সেখানে অভিভাবক ও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কর্মসূচি শুরু হয়। পুলিশের গুলি ও শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় তাদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। অভিভাবক ও শিক্ষকদের অবস্থান থাকতে থাকতেই সেখানে আসেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বেলা আড়াইটার মধ্যে হাজারো শিক্ষার্থী অবস্থান নেন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে।

এ সময় সেখানে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সহ- সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বিএনপি’র এক দল  কর্মী-সমর্থক আসেন। তারাও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এভাবে বিকাল পৌনে ৫টা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবে চলে কর্মসূচি পালন। এ সময় সাঁজোয়া যান নিয়ে পুলিশের একটি টিম চৌহাট্টা এলাকায় অবস্থান করছিল। একই সঙ্গে আরেকটি টিম নগরের জিন্দাবাজার এলাকায় অবস্থান করে। এ ছাড়া চৌহাট্টাকে ঘিরে চতুর্দিকে পুলিশের নিরাপত্তা ব্যুহ তৈরি করা হয়। ৫টার দিকে শুরু হয় সংঘাত। চৌহাট্টা ও শহীদ মিনার এলাকায় সড়কে থাকা শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে লাঠিচার্জ চালায় পুলিশ। এ সময় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড সহ ছররা গুলি শুরু করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শুরুতেই পুলিশের ছররা গুলি ও লাঠিচার্জে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারী আহত হন। এ সময় পুলিশের কয়েকজনকেও রক্তাক্ত অবস্থায় ওই এলাকায় দেখা যায়। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে নগরের হাওয়াপাড়া, তাঁতীপাড়া, জিন্দাবাজার, দরগাহ গেইট, রিকাবীবাজার, মীরবক্সটুলা এলাকায়। এতে করে কয়েকটি এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত পুলিশও কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে এসব এলাকায় শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে টিয়ারশেল, ফাঁকা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে। নগরের হাওয়াপাড়া এলাকার গুলজার টাওয়ারের কয়েকজন বাসিন্দা মানবজমিনকে জানিয়েছেন- টাওয়ারের বাইরে যেনো যুদ্ধ চলছিল। টাওয়ারের সামনে ও আশপাশ এলাকায় অবিরত গুলি ছোড়া হয়। ছররা গুলি এসে তাদের ঘরেও ঢুকে। এ সময় টিয়ারশেলের গন্ধে গোটা এলাকা ছেয়ে যায়। এতে করে মানুষজনও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা জানান- বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে তাঁতীপাড়ার একটি মসজিদের মাইক থেকে সাহায্য চেয়ে একজন মাইকিং করেছেন। বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হওয়ার কারণে তারা বের হতে পারেননি। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা চৌহাট্টা এলাকা থেকে এসে পাড়া- মহল্লায় আশ্রয় নেন। এ সময় পুলিশ এসে তাদের গলির ভেতরে ঢুকে গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে। গোলাগুলির প্রকম্পিত শব্দে ঘণ্টাখানেক তারা বাসাবাড়িতেই বন্দি ছিলেন।

নগরের জিন্দাবাজার এলাকায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিলে পুলিশও সেখানে টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় জিন্দাবাজার এলাকার ব্যবসায়ীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। বিকালে সিলেট নগরে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার কারণে নগরের সব দোকানপাট ও বিপণি বিতান বন্ধ করে দেয়া হয়। যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ী সহ স্থানীয়রা দোকানপাটের ভেতরেই বন্দি হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় সন্ধ্যার দিকে যখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছিলো তখন নগরের দরগাহ’র মূল গেইট থেকে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশ সদস্যরা গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু করলে তারা চলে যায়। এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা নগরের আম্বরখানা এলাকা পর্যন্ত গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। এদিকে সংঘর্ষের সময় সিলেটে পুলিশ, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, পথচারী সহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। সন্ধ্যায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অতিরিক্ত ডিআইজি) আজবাহার আলী শেখ জানিয়েছেন, তাদের কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ কয়েকজনকে আটক করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশ  চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি। গতকাল সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কর্মসূচিতে এসে যুক্ত হয়েছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিব। তিনি জানিয়েছেন- পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি কী ঘটেছে তারা পরবর্তীতে সেটি জানাবেন। এছাড়া; কেন্দ্রীয় ভাবে যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে সেটি পালনে তারা সিলেটে সক্রিয় থাকবেন বলে জানান। সিলেট জেলা বিএনপি’র সভাপতি আব্দুল কাইয়ূম চৌধুরী ও নগর বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তারা জানিয়েছেন, ছাত্র- জনতার এই বিক্ষোভ গুলি করে দমানো যাবে না। জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে। এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সিলেটে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ আসছিল। নগরের লোকজন ভয়ে-আতঙ্কে ঘরবন্দি অবস্থায় ছিলেন।

সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকায় ছাত্র-জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষের সময় সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বিএনপি’র পদত্যাগকারী সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা এডভোকেট শামসুজ্জামান জামান। মদিনা মার্কেটে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ: জামায়াত-শিবিরের ভাঙচুর ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে গতকাল সিলেট নগরীর মদিনা মার্কেটে শান্তি সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। স্থানীয় ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এ শান্তি সমাবেশ করা হয় বলে জানিয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বিজিত চৌধুরী। তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন; শান্তি সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও স্থানীয় লোকজন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহ ফরিদ, নাজনিন হোসেন, নগরের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন, ফয়জুল আনোয়ার আলাউর, আব্দুল খালিক, স্থানীয় কাউন্সিলর জগদীশ চন্দ্র দাস, জেলা যুবলীগ সভাপতি শামীম আহমদ ভিপি, নগর যুবলীগ সভাপতি আলম খান মুক্তি সহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে জেলা ও নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.