সংঘর্ষ হামলা গুলি: সিলেট, কুমিল্লা, জামালপুর রণক্ষেত্র, চট্টগ্রামে মন্ত্রীর বাসায় হামলা, গাজীপুরে নিহত ১
ওদিকে কুমিল্লায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতে ৯ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। এ ছাড়া সিলেটে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের ছোড়া সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও ছররা গুলিতে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এ সময় শিক্ষার্থীদের পাল্টা ইটপাটকেলে পুলিশের কয়েকজন আহত হন।
জামালপুরে শিক্ষার্থীদের নিপীড়নবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। এসময় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারশেল ছুড়ে পুলিশ। এতে ১০ শিক্ষার্থী আহত হন।
এদিকে রাতে চট্টগ্রামে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনে। একই সময়ে স্থানীয় এমপি মহিউদ্দিন বাচ্চুর কার্যালয়ে হামলা করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
কুমিল্লায় শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগের গুলি গুলিবিদ্ধ ৯, আহত অর্ধশত, এসিল্যান্ডের গাড়িতে আগুন
স্টাফ রিপোর্টার, কুমিল্লা থেকে জানান, কুমিল্লায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতে ৯ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক। শনিবার দুপুরে কুমিল্লা নগরীর পুলিশ লাইন ও রেসকোর্স এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। চান্দিনা এসিল্যান্ডের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। তবে চান্দিনা ইউএনও বলেছেন এটি দুর্বৃত্তরা পুড়িয়েছে, শিক্ষার্থীরা নয়।
সরজমিন দেখা যায়, দুপুর ১টায় কুমিল্লা নগরীর পুলিশ লাইনে অবস্থান নিয়েছিলেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ইটপাটকেল ছোড়ে। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করে। এতে অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ ও আহত হন। গুলিবিদ্ধরা হলেনÑ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কোটা আন্দোলনকারীর সমন্বয়ক জন্নাতুল মিলি (২০), রেসকোর্স এলাকার মনিরুল হকের ছেলে মাহাবুবুল হক (২০), রামমালা এলাকার জাকির হোসেনের ছেলে আরেফিন (২০), ঠাকুরপাড়া এলাকার শাহাদাতের ছেলে রাহাতুল হাসান মৃদুল (১৭), জুয়েলের ছেলে আরফান মজুমদার (১৬), দিলীপের ছেলে সৌরভ (২৫), আবদুল করীমের ছেলে মারুফ (১৬), ফরিদ উদ্দিনের ছেলে আসিফ (১৮), ইউসুফ মিয়ার ছেলে সুজন (১৮), তোফায়েলের ছেলে সানি (১৮)। আর আহতরা হলেনÑ কুমিল্লা নগরীর কাপ্তানবাজার এলাকার মিজানুর রহমানের ছেলে নাজমুল রহমান (২৭), টমসমব্রীজ এলাকার মহিন উদ্দিন মিয়ার ছেলে শাওন (৪২), বাগিচাগাঁও এলাকার জলিল মিয়ার ছেলে মিরাজ (১৭), ধর্মপুর এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে অপু (৩২), মুনাফের ছেলে সবুর (৩০), রানীর দীঘির পাড় এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে রাব্বি (১৬), মনোহরপুর এলাকার খোকনের মেয়ে আছিয়া (১৮), দৌলতপুর এলাকার জব্বারের ছেলে সফিক (৬০)সহ আরও অনেকে চিকিৎসাধীন আছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিলের ব্যানারে অনুষ্ঠিত এ গণমিছিলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এতে কুমিল্লা জিলা স্কুল, কুমিল্লা ইবনেতাইমিয়া স্কুল, কুমিল্লা হাই স্কুল, কুমিল্লা মডার্ন স্কুল, ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়।
জানা যায়, কুমিল্লা সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র সৌরভ চক্রবর্তী নিহত হয়েছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। তবে সৌরভ এখন কুমেকে চিকিৎসা শেষে ঢাকা চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি হতে যাচ্ছে বলে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা শেখ ফজলে রাব্বি নিশ্চিত করেছেন। গুলিবিদ্ধ মৃদুলের বাবা শাহাদাত বলেন, আমার ছেলেকে কতো মানা করলাম তাও গেল এ দেশের স্বার্থে। এখন আমার ছেলের একটি চোখে গুলি লেগেছে। কাল অপারেশন হবে, জানি না সে এ চোখে আর দেখতে পাবে কিনা। গুলিবিদ্ধ আরেক শিক্ষার্থী আসিফের বাবা ফরিদ বলেন, আমরা দেশের এ পরিস্থিতি আর দেখতে চাই না। ছেলেদের দাবিগুলো সরকার মানলে তো তারা আর রাস্তায় আসবে না। সরকারকে বলবো আর আমাদের সন্তানদের এভাবে রক্ত দিতে রাস্তায় নামাবেন না। দাবিগুলো মেনে নিন।
এ বিষয়ে কুমিল্লা পুলিশ সুপার সাইদুর ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৃত্যুর গুজব রটানো হচ্ছে। কুমিল্লায় কেউ মারা যায়নি। পুলিশ ছাত্রদের নিরাপত্তা দিয়েছে। ঘটনার সময় পুলিশ লাইনে আটকে পড়া প্রায় ২ শতাধিক শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নিরাপত্তা দিয়ে বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
শ্রীপুরে সংঘর্ষ, পুলিশের গাড়ি ও বক্সে আগুন
শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশকে কেন্দ্র করে গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশের রাবার বুলেটের আঘাতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী আহত হন। আহতদের উদ্ধার করে আশপাশের বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়। সংঘর্ষে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি ও বক্সে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা।
শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুইটা পর্যন্ত দফায় দফায় এ সংঘর্ষে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহসড়কের যান চলাচল। দুপুর ৩টা পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে নানা সেøাগান দিচ্ছেন। আটকেপড়া যাত্রীরা পড়েছেন ভোগান্তিতে।
সরজমিন ঘটনাস্থল থেকে দেখা যায়, বেলা ১১টার দিকে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের উড়াল সড়কের মুখ পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেয়। এ সময় পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাওনা চৌরাস্তা উড়াল সড়কের নিচে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। পুলিশ প্রথম থেকেই পিছু হটলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয়ার চেষ্টা করে এগিয়ে যান। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে আন্দোলনকারীরা ধাওয়া দিলে পিছু হটে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশকে ধাওয়া দিয়ে স্থানীয় একটি মার্কেটে অবরুদ্ধ করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশের ৩টি গাড়িতে ও ৩টি পুলিশ বক্সে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এর একপর্যায়ে পুলিশও পিছু হটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। নিরাপত্তায় সকাল থেকেই পুলিশের সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছিলেন শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোভন রাংসা।
মাওনা চৌরাস্তার বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ও শ্রীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের এখানে প্রায় ২৪ জন আহত রোগী এসেছিল, তাদের অধিকাংশই রাবার বুলেটে আহত। তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা ও ময়মনসিংহে প্রেরণ করা হয়েছে।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম বলেন, পুলিশ প্রথম থেকেই তাদের দাযিত্ব পালন করে গেছে, তারা কারও উপর চড়াও হয়নি, এরপর আন্দোলনকারীরা তাদের ধাওয়া করে পুলিশের গাড়িতে ও পুলিশ বক্সে আগুন দেয়।
No comments