শেখ হাসিনার আমেরিকা নাটক by শওকত মাহমুদ
দায়িত্বশীল সূত্র মতে তিনি বিদায়ের বহু আগে থেকেই অর্থাৎ ২০২২ সালেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে লিখিত চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তার মসৃণ বিদায়ের জন্য। তাতে সই করেছিলেন শেখ হাসিনা পরিবারের একজন সদস্য। এতে তিনি কীভাবে কাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এক বিমানে দিল্ল্লি হয়ে লন্ডন যাবেন আর বিদায়ের জন্য শর্তাবলী সবই ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু টালবাহানায় তিনি কালক্ষেপণ করে করে নির্বাচন সেরে ফেলেন। কিন্তু তার জন্য কল্পনারও অতীত আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিস্থিতির আকস্মিক অবনতি হলে শেখ হাসিনা দ্রুত ভারতে পালান। এই অরাজনৈতিক অভ্যুত্থানটি ছিল নজিরবিহীন এবং পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস এতে কোনো বিদেশি সংশ্রব ছিল না। বরং ভারত আগাগোড়াই চেষ্টা করেছে এ থেকে শেখ হাসিনার সরকারকে রক্ষার।
হযরত নূহ (আ:) যখন তার জাতির মানুষকে মহান আল্লাহর কথা বলতে যেতেন তখন ওইসব লোকেরা কাপড় দিয়ে কান ঢেকে নিতো। কারণ শয়তান তাদের বলেছিল তারা হযরত নূহের কথা না শুনলে গোনাহ হবে না। কবি বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘মুক্তধারা ’ নাটকে দুই গ্রামের মোড়লদের প্রতিযোগিতার এক কাহিনী এনেছেন।
মানুষ যাতে সত্য জানতে না পারে সে জন্য তাদের কান ঢাকা টুপি পরিয়ে দিয়েছিল। এটা দেখে এক ভিন্নমতাবলম্বী সংলাপ দিয়েছে এমন- ‘জগৎটা বাণীময় রে! যেখান দিয়ে শোনা বন্ধ করবি, সেখান দিয়ে মৃত্যুবাণ আসবে।’ মহান আল্লাহর স্মরণ থেকে যে সরে যায়, তার দৃষ্টির ওপর আল্লাহ পর্দা দিয়ে দেন। শেখ হাসিনা দম্ভের তাড়নায় সত্য জানতে চাননি, শুনতে চাননি। সে জন্য তার রাজনৈতিক মৃত্যুবাণ এসে যায়। তিনি শেষতক বিশ্বাস করেছেন চক্রান্তের খবর, ভাঙচুরের খবর, কিন্তু তার বাহিনীর যে গণহত্যা সেটা জেনেও না শোনার ভাণ করেছেন। এবং আরও খুনোখুনি কেন হচ্ছে না, তা নিয়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে- A truth is always a compound of two half-truths and you never reach it because there is always more to say.
তত্ত্বাবধায়ক তথা জাতীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপি’র নেতৃত্বে ২০২২ সালে আন্দোলনটা প্রায় গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিচ্ছিল। বিভাগীয় গণসমাবেশগুলো জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল এবং সরকারের পেটোয়া বাহিনী ১৯ জনকে হত্যা করে। আমেরিকানরা তখন বেশি সজাগ হয়ে ওঠে। এর আগে থেকে হাসিনা সরকারের অধীনে জালিয়াতির নির্বাচন ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তারা সজাগ ছিল। একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছিল তাদের প্রধান তাগাদা। মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে সমর্থন না দিলেও হাসিনার বিদায়ের পর যে একটা অন্তর্বর্তী সরকার হবে এটা আমেরিকানরা নিশ্চিত করেছিল।
২০২২-এর শেষদিকে প্রবল আন্দোলনের মুখে লন্ডনে ও দুবাইয়ে শেখ হাসিনার নির্দেশে সজীব ওয়াজেদ জয় ওই তিন সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসে। একটি লিখিত সমঝোতা মুসাবিদা করা হয়। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন। এর আগে তার বিদায় বক্তৃতা রেকর্ড করা হবে। বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগপত্র সই করে আসার পর তিনি সোজা এয়ারপোর্ট যাবেন। তার বিদেশ যাওয়াটা এ জন্য তার পদত্যাগের ঘোষণার পর রাজপথে বিরোধী দল মহাসমারোহে নামবে। ১৮৭ জন পারিবারিক সদস্য, রাজনৈতিক সঙ্গী ও ব্যবসায়ী নিয়ে তিনি দিল্লি হয়ে লন্ডন যাবেন। তবে তার সঙ্গে তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকীর যাওয়া নিয়ে যুক্তরাজ্য প্রশ্ন তোলে। শেখ হাসিনা যাবার আগে রাষ্ট্রপতিকে একটা জাতীয় সরকার গঠনের জন্য বলবেন, যাতে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব থাকে। অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস যেন কোনোভাবেই না থাকেন তার নিশ্চয়তা তিনি চেয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার চয়েস ছিল একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল। শেখ হাসিনার আরও শর্ত ছিল তিনি আবার দেশে ফিরবেন এবং নির্বাচনে অংশ নেবেন। এর মাঝে তার কোনো বিচার করা চলবে না এবং বিডিআর বিদ্রোহের বিচারের বিষয়ে তিনি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।
শেখ হাসিনাকে ২০২২ এর ৩০শে ডিসেম্বরের মধ্যে বিদায়ের দিন ঠিক করার জন্য বলা হয়। কিন্তু চতুর শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে নিপীড়ন চালিয়ে এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিরোধী আন্দোলনকে স্তিমিত করতে সক্ষম হন। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজস্ব লোক বসান। যাতে অন্তর্বর্তী সরকার হলেও তার লোকেরা ঠিকঠাক থাকে। আন্তর্জাতিক নানা ঘটনাও তাকে ফেভার করে। তখন তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। একই সঙ্গে বলে দেন, বিরোধী দল নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হলে তিনি ওই চুক্তি মানবেন। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল ২৮শে অক্টোবরের ব্যর্থতার পর শান্তিপূর্ণ নির্বাচন-বয়কটে গেলে আমেরিকা সরে যায়। ভারত আমেরিকাকে বোঝাতে সক্ষম হয়- এখন শেখ হাসিনার বিকল্প নাই।
বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত আমেরিকার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার অঙ্গীকার করলেও ভেতরে ভেতরে তারা চেয়েছে আমেরিকা যেন বাংলাদেশকে নিয়ে তেমন নাক না গলায়। শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের একটি জ্বালানি কোম্পানিকে বঙ্গোপসাগরের তেল-গ্যাস ব্লক দেয়ার নাটক সাজান। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা এ লক্ষ্যে বেইজিংয়ের কিছু কাগজপত্র সাজান। ভারত এতেও আপত্তি জানায়। বরং উল্টো কামান দাগতে থাকেন যে, তারা বঙ্গোপসাগর চায়। বাংলাদেশ বিষয়ে ওয়াকিবহাল একটি মার্কিন সূত্র মতে, ভারত বাংলাদেশকে সব সময় নিজের বাড়ির পেছনের উঠান মনে করে। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, কোয়াড এবং বার্মা অ্যাক্টের ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটা কেন্দ্র রাষ্ট্র মনে করে। ভারতও একমত। ততটুকুই যতটুকু চীনকে মোকাবিলা করা যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ থাকবে তাদের বলয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে সর্বশেষ সফরের সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের একটি গোপন বৈঠক হয়। তাতে উত্তপ্ত কথাবার্তা চলে। এক পর্যায়ে জ্যাক সুলিভান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা ওঠালে শেখ হাসিনা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জানান যে, বাংলাদেশে সকল রাজনীতি তার নিয়ন্ত্রণে। বিরোধী দলের আন্দোলন তিনি সামলাতে পারেন। এই বৈঠকের খবরটি ভারতীয় গণমাধ্যম প্রকাশ করে দেয়।
তুরস্কে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে মার্কিনিদের আলোচনায় পূর্বের চুক্তি অনুসরণের কথা আসে। ওই দু’জন একমত হলেও শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেছিলেন যে, ছাত্রদের কোটা বিরোধী আন্দোলন তিনি সামলে উঠবেন। সজীব ওয়াজেদ জয় তার মাতাকে শান্তিপূর্ণভাবে সরে আসার জন্য আগে থেকেই বলে আসছিল। তার ওপর মার্কিনিদের একটা বড় চাপ ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের একটি আদালতে তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের একটি মামলা করেছে এফবিআই। এ জন্য এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্র যান না। এবার শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ছাত্রদের সমস্যা মিটিয়ে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ অব্যাহত ছিল। সেনা নেতাসহ অনেকের সঙ্গেই তারা যোগাযোগ রাখছিলেন। হাসিনা চেয়েছিলেন একজন সাবেক জেনারেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিক। তিনি ভাষণ দেবেন এবং দ্রুত পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানাবেন। কিন্তু তা আর হতে পারেনি। আন্দোলনের ক্রম বেগবানতায় তার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আর বন্ধ হয়ে যায় পশ্চিমা দুয়ার।
No comments