শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় ভুল ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করা, গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে না দেয়া -রেডিফকে হর্ষ ভি প্যান্ত

শেখ হাসিনা বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে দেননি। তিনি বিরোধী দলকে কোনো সুযোগ দেননি। তার দলের আধিপত্যের অর্থই দাঁড়িয়েছিল এটা যে, প্রতিষ্ঠানগুলো একমুখী হয়ে উঠেছিল। তা সে ব্যুরোক্রেসি বা কোর্ট বা নিরাপত্তা রক্ষাকারী কোনো বাহিনী-  যাই হোক না কেন তিনি ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। ফলে আপনি দেখতে পাবেন এসব প্রতিষ্ঠানে তার প্রতিনিধি অথবা তার দলের লোকজন অতিমাত্রায় প্রতিনিধিত্ব করছেন। সম্ভবত এসবই হলো শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় ভুল। অনলাইন রেডিফ’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন হর্ষ ভি প্যান্ত। তিনি কিংস কলেজ লন্ডনের কিংস ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর এবং নয়াদিল্লিতে অবজারভার রিসার্স ফাউন্ডেশনে স্টাডিজ অ্যান্ড ফরেন পলিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সহ অনেক বিষয়ে তিনি রেডিফের প্রসন্ন ডি জোরে’র সঙ্গে কথা বলেছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- এ বছর জানুয়ারিতে টানা চতুর্থ বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তখনই কি শেখ হাসিনার পতনের দেয়াল লিখন ছিল? জবাবে হর্ষ ভি প্যান্ত বলেন- এটা বলা খুব কঠিন। গত নির্বাচনে যখন তিনি নির্বাচিত হলেন তখন প্রচুর বিরোধিতা হয়েছে। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। তবে এতে যে শেখ হাসিনার এমন নাটকীয় পতন হবে তা স্পষ্ট ছিল না। নির্বাচনের আগে তার ওপর প্রচুর চাপ ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি নির্বাচন করেন। আবার ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হন। বিরোধী দল যতটা উদ্বিগ্ন ছিল সে তুলনায় তৎপরতা কমই দেখা গেছে। সম্ভবত এ জন্য লোকজন ভেবেছিল তিনি আরেক দফা টিকে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন, যেমনটা আগেও তিনি করেছিলেন। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে অসন্তোষ ছিল। আরও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের জন্য ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু তিনি সম্ভবত তা বুঝতে পারেননি।

এ পর্যায়ে নতুন প্রশ্নে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- শেখ হাসিনার সময়কালে বাংলাদেশের নির্বাচন কি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছিল? রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে কি অবাধে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়েছিল?
জবাবে তিনি বলেন- না, তাদেরকে তা দেয়া হয়নি। তার ও বিরোধীদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। অবশ্যই প্রথমদিকে যে নির্বাচন হয়েছিল সেই নির্বাচন তুলনামূলকভাবে অবাধ ছিল। কিন্তু তিনি যখন ক্ষমতায় এলেন মাঝে মাঝে বিরোধীদের পক্ষ থেকে তিনি নিজেকে কোণঠাসা বোধ করতে থাকেন। তার ওপর হামলাও হয়েছে। এতে তিনি মনে করতে পারেন যে, তিনি একটি কোণে আটকে আছেন। ফলে যখন বিরোধীদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয় এলো তখন তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, যা অনেক বেশি কঠিন হয়েছে। এর অর্থ হলো তিনি মনে করেছেন তার দল আওয়ামী লীগের যে সুযোগ থাকার কথা প্রকৃতপক্ষে বিরোধীদের তা থাকতে পারে না। এটা নিশ্চিত করেছেন। যেভাবে নির্বাচনগুলো হয়েছে তাতেও সমস্যা আছে। এসব কারণেও লোকজন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিরোধীরাও কোনো না কোনো উপায়ে শেখ হাসিনার প্রতি খুব ক্ষুব্ধ ছিল। এই নির্বাচন নয়, এর আগের নির্বাচনে (২০১৮) ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। সেটাকে তিনি বিরোধীদের দমনের একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

প্রশ্ন: তার ১৫ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বড় ভুল কি ছিল, যার জন্য ভারতের এই প্রতিবেশী দেশে অরাজকতা হয়েছে? দেশটির বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করতে অরাজকতা কি উত্তম শব্দ হবে?
উত্তর: নির্দিষ্টভাবে এই মুহূর্তে বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনে অন্তর্বর্তী সরকার তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। এ সময়ে তারা কি কি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে তা জানতে হবে। ২০০৮ সাল থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে, যেখানে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা এখনো উপস্থিত থাকতে পারেন। তাহলে কীভাবে আপনি একটি নতুন প্রতিষ্ঠান মেরামত করবেন? আপনি কি আসলেই আওয়ামী লীগের সমর্থকদের চিহ্নিত করতে পারবেন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে দিতে পারবেন? আপনি কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে গড়ে তুলবেন? এটা হবে একটি বড় ইস্যু। এটাই সমস্যাকে জোরালো করে তুলেছে, যার সমাধান করতে সক্ষম হননি হাসিনা। তার বিষয়ে ভারত যেটা মনে করতো তাহলো তিনি খুবই ভালো এবং তার কোনো ভুলই নেই। সম্ভবত তার ভুল এটাই যে, ভারত তাকে বিরোধীদের যেসব সুযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে এসেছে, তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। তবে এটা জোর দিয়ে বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি যখন ১৫ বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন বাংলাদেশের অবস্থা ভালো ছিল না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল ঘোলাটে, মেরূকরণ করা। তখন উগ্রপন্থাও দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল ক্ষত-বিক্ষত। এখন ভুল নিয়ে কথা বলা সহজ। কিন্তু এটা স্বীকার করতে হবে তিনি বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিয়েছেন ১৫ বছরে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুততার সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে। এটা তার অবদান। তবে অনেক বিষয়ে তিনি জনগণকে সম্পৃক্ত না করে সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। সেই একই সমস্যা এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সমাধানে সক্ষম হয় কিনা তার জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে তার প্রেক্ষিতে মসৃণ রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর হবে?
উত্তর: এই মুহূর্তে পরিস্থিতি খুবই ঘোলাটে। তাত্ত্বিকভাবে এটা শুনতে ভালোই লাগে যে, নোবেলজয়ী সরকার চালাচ্ছেন অথবা সরকারের প্রধান। কিন্তু রাজনীতি ভিন্ন বিষয়। রাজনীতিতে সব অংশীদারের বিষয়ে আপনাকে নজর রাখতে হয়। কীভাবে ফাটল ধরা অংশগুলোকে একসঙ্গে জোড়া দেয়া যাবে আমি জানি না।

No comments

Powered by Blogger.