সেই শিশুর ভাগ্য নির্ধারণ আজ

রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেলে যাওয়া অবুঝ শিশু ফাতেমার ‘বৈধ অভিভাবকত্ব’ আজ বুধবার নির্ধারিত হবে। ঢাকার শিশু আদালতের বিচারক মো. হাফিজুর রহমান তা নির্ধারণ করবেন। এর আগে ৯ আগস্ট অবুঝ শিশু ফাতেমার ‘বৈধ অভিভাবকত্ব’ নির্ধারিত হওয়ার কথা থাকলেও বিচারক অসুস্থ থাকায় তা পিছিয়ে আজ পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ঐদিনই শিশু ফাতেমার প্রকৃত বাবা-মাকে খুঁজে পায়নি উল্লেখ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক আবু সাঈদ। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, আদালতের নির্দেশে বিমানবন্দরের ওই দিনের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। এতে শিশুটির প্রকৃত বাবা-মাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। শিশুটির বাবা-মা দাবি করে কেউও লিগ্যাল নোটিশও দেয়নি। এছাড়া শিশুটি হারিয়ে গেছে মর্মে বিমানবন্দর থানায় কেউও জিডিও করেনি। গত ২৫ জুলাই ঢাকার শিশু আদালতের বিচারক মো. হাফিজুর রহমান ফাতেমার প্রকৃত বাবা-মাকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। সেদিন তিনি ৯ আগস্টের মধ্যে শিশুটির প্রকৃত বাবা-মাকে খুঁজে বের করার দিন নির্ধারণ করেন। প্রকৃত বাবা-মাকে খুঁজে না পাওয়া গেলে শিশুটিকে নিতে আগ্রহী কোনো দম্পতিকে বাছাই করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার কথা জানানো হয়। ওইদিন আট দম্পতি শিশুটিকে নিতে আদালতে আবেদন করেন। পরে আরও দুই দম্পতি আবেদন করেন। তাদের মধ্যে সেনা কর্মকর্তা,
পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা রয়েছেন। দম্পতিরা হলেন- ব্যবসায়ী আশিক ওয়াহিদ-শাহনাজ, পুলিশ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ-নিঝুম আক্তার, সেনাবাহিনীর তথ্যপ্রযুক্তি ফার্মের কর্মকর্তা মাজহারুল-লায়লা নুর, ব্যবসায়ী আলমগীর-অ্যাডভোকেট সেলিনা আক্তার, ব্যবসায়ী জামাল-শ্যামলী আক্তার, ব্যবসায়ী গোলাম সরওয়ার-দুলশাদ বেগম বিথি, ব্যবসায়ী শামসুল আলম চৌধুরী-শামিমা আক্তার চৌধুরী ও বিমানের কর্মকর্তা আ ক ম আতিকুর রহমান-মনালিসা দম্পতি। উল্লেখ্য, গত ৮ জুলাই জর্ডান থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে করে দেশে ফিরছিলেন জয়দেবপুরের স্বপ্না বেগম। একই বিমানে শিশুটিকে নিয়ে তার মাও ফিরছিলেন। স্বপ্না জর্ডানে গৃহকর্মী হিসেবে গিয়েছিলেন। অজ্ঞাতপরিচয় ওই নারীও একই কাজে সেখানে গিয়েছিলেন বলে জানতে পারেন স্বপ্না। স্বপ্না বিমানবন্দর পুলিশকে জানান, ওই নারীও জর্ডান থেকে একই ফ্লাইটে ফেরেন। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে কাস্টমস থেকে মালপত্র নিয়ে বের হয়ে বিমানবন্দরের ক্যানওপি পার্কিং এলাকায় স্বজনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন স্বপ্না। এ সময় বিমানে পরিচয় হওয়া শিশুটির মা তাকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আপা আমার শিশুটাকে একটু ধরেন। ভেতরে মালপত্র রয়েছে, নিয়ে আসছি। আগে কথা হওয়ায় সরল বিশ্বাসে শিশুটিকে কোলে তুলে নেন স্বপ্না। কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও সেই নারী আর ফেরেননি। পরে স্বপ্না আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যদের কাছে ঘটনাটি জানালে তারা শিশুসহ স্বপ্নাকে বিমানবন্দর থানায় পাঠায়। ওইদিনই বিমানবন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। এরপর শিশুটিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়।
ফাতেমা কাকে খোঁজে?
সাত মাস বয়সী ফাতেমা আছে ঢাকার তেজগাঁওয়ে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। ফাতেমার বয়স সাত মাস। তার কণ্ঠে কেবল আও, আও স্বর ফোটে। ক্ষুধা পেলে চিৎকার করে। খাবার না পেলে কান্নাকাটি করে। পেট ভরে গেলে খেলাধুলা করে। টিভিতে কার্টুন দেখে। হাসতে থাকে। মন খারাপ হলে চুপ করে থাকে। এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। কাকে যেন খুঁজে ফেরে? হ্যাঁ, ফাতেমা খোঁজে তার মাকে? যে মা তাকে ফেলে গেছে? যে মা দশ মাস দশ দিন পেটে ধরে তাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে। সেই মা কোথায়? পুলিশ খুঁজছে ফাতেমার মাকে। সব চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। তবে তার খোঁজ এখনো মেলেনি। অথচ ফাতেমাকে নিজের করে নেওয়ার জন্য ঢাকার একটি আদালতে আবেদন করেছেন এক নিঃসন্তান দম্পতি। ফাতেমা এখন আছে তেজগাঁও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। ৯ জুলাই জর্ডান থেকে ঢাকায় বিমানবন্দরে নামেন শিশুটির মা। তার সহযাত্রী ছিলেন স্বপ্না নামের এক নারী। বিমানবন্দরের এক নম্বর গেট দিয়ে তিনি বের হন। ব্যাগপত্র আনার কথা বলে ফাতেমাকে স্বপ্নার কোলে রেখে যান তিনি। সেই যে ফাতেমার মা গেলেন আর এলেন না। এদিক-ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করেন স্বপ্না। বিমানবন্দরের সামনে অপেক্ষা করেন প্রায় তিন ঘণ্টা। কিন্তু আর তাকে না পেয়ে ছোট্ট ফাতেমাকে নিয়ে যান নিজের বাসায়। স্বপ্না পরের দিন আসেন বিমানবন্দরের এপিবিএন পুলিশ কক্ষে। সেখানে দিয়ে যান ফাতেমাকে। পরে পুলিশ তাকে নিয়ে আসে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। ফাতেমার গায়ের রং উজ্জ্বল ফরসা। মাথার চুল কোঁকড়ানো। ফাতেমাকে নিরাপদ হেফাজতে রাখার আবেদনকারী পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ফাতেমার মাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে তাঁকে নিরাপদ হেফাজতে রাখার জন্য আবেদন করা হয়েছে। আদালতের আদেশে সে আছে সাপোর্ট সেন্টারে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সহকারী কমিশনার (এসি) জাকিয়া নুসরাত বলেন, ফাতেমা অনেক বুদ্ধিমান। সব সময় সে হাসিমুখে থাকে। তার চারটি দাঁত উঠেছে। মা, বাবা ডাকতে পারে না।
তবে ‘আও আও’ করে। খেলার সময় খুব খুশি থাকে। কার্টুন দেখে। নুসরাত আরও বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে ফাতেমাকে এখন সবাই চেনে। দুজন নারী তাকে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করে। তাদের কেউ তাকে ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয়। ফাতেমা বড় আদরে আছে এখানে। ফাতেমার মা কেন ফেলে রেখে চলে গেছেন? কিংবা কোথায় আছেন? সে সম্পর্কে এখনো কোনো কিছু জানতে পারেনি পুলিশ। তবে স্বপ্না নামের সেই নারীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এই নারী থাকেন জয়দেবপুরে। তিনি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। তিনি সুস্থ হলে ফাতেমার মায়ের ব্যাপারে আরও তথ্য সংগ্রহ করা যাবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এসি জাকিয়া নুসরাত বলছেন, ফাতেমার মাকে খুঁজে বের করতে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। স্বপ্না সুস্থ হলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। ফাতেমার খোঁজ না মিললেও তাকে জিম্মায় নেওয়ার জন্য ঢাকার শিশু আদালতে আবেদন করেছেন এক দম্পতি। পাঁচ বছর আগে তাদের বিয়ে হলেও কোনো সন্তান হয়নি। আদালতের পেশকার বলেন, বিমানবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফাতেমাকে নিজেদের জিম্মায় নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। পুলিশ বলছে, ফাতেমার মা কোন এয়ারলাইনসে এসেছেন, তা এখনো জানা যায়নি। পাওয়া যায়নি তাঁর কোনো পাসপোর্ট। অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলাতে না পারলেও পুলিশ কর্মকর্তা জাকিয়া নুসরাত বললেন, ফাতেমার মাকে খুঁজে বের করে তাকে তাঁর কোলে ফিরিয়ে দেওয়া হবে? যত দিন পর্যন্ত তাঁকে না পাওয়া যায়, তত দিন ফাতেমা আদর-যত্নে থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.