আশ্রয় নেই, ত্রাণও নেই

‘এমন বান আগে দেহিনি। রাতেই হুড়মুড়ি ঘর তলাই গেল। তিন মাইয়া নিয়ে কোনো রহম রেলগাড়ির বগির মধ্যে উঠছি। এহনও সগলেই না খাইয়ে রইছে। এত কষ্টের মধ্যে থাকলেও কেউ খাউন দিতে আইলো না।’ বলছিলেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ডালবাড়ী গ্রামের পারভীন আক্তার (৪৫)। দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের একটি পরিত্যক্ত বগিতে পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছেন পারভীন। বানভাসি অন্যদের চেয়ে এ পরিবারের কষ্টটা একটু বেশি। পারভীনের স্বামী মনজুরুল ইসলাম আগে ইজিবাইক চালাতেন। অসুস্থ হয়ে অনেক দিন ধরে তিনি বেকার। ঘরে আছে তিন মেয়ে। এই পাঁচজনের সংসার চলে পারভীনের একার আয় দিয়ে। তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করে যৎসামান্য আয় করেন। কিন্তু বন্যা সেই পথও বন্ধ করে দিয়েছে। মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘বউ মানষের বাড়িতে কাজ কইরে যা আনে, এতে সংসার চলে। দিন আনি দিন খাই। ঘরে কোনো খাউন নাই। আমগরে সাহায্য না দিলে, মরণ ছাড়া উপায় নাই।’ দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে মোট ১৫-২০টি বানভাসি পরিবার। এ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের সামনেও হাঁটুপানি। উপজেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র থেকে খুব কাছে হলেও এখানে গতকাল পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পৌঁছায়নি। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই রেলস্টেশনে আশ্রয় নেওয়া মানুষের খবর আমার জানা ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত সেখানে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে।’ জামালপুরে যমুনা নদীর পানি উপচে পড়ায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে বন্যা শুরু হয়েছে। বন্যায় এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এ দুটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মানুষের দুর্ভোগ আর ত্রাণের জন্য হাহাকার চোখে পড়ে। সকালে নৌকায় ইসলামপুর উপজেলার বানিয়াবাড়ী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে শুধু পানির স্রোত বইছে। এ গ্রামে ছোট একটি উঁচু রাস্তার ওপরে ২৫টি পরিবার গবাদিপশুসহ আশ্রয় নিয়েছে। রাস্তার কিনারে ভিড়তেই ত্রাণের নৌকা মনে করে অনেকে এগিয়ে এলেন। মমেনা বেগম নামের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘দুই দিন হলো পাকশাক নাই। কয়টা টাকার চিড়া-মুড়ি নিয়ে কী চলে?
এত বড় বন্যা কেউ খুঁজ লয়লো না। গেদাগেদি (ছেলেমেয়ে) নিয়ে কুঠাই যামু। এই কষ্টের মধ্যে মরণ ছাড়া উপায় নাই।’ ইসলামপুরের পাথর্শী, বলিয়াহদ, পশ্চিম বলিয়াদহ, পূর্ব বলিয়াদহ, পূর্ব বামনা দেলিরপাড়, ছোট দেলিরপাড় জারুলতলা, ঘুনাপাড়, মাঝিপাড়া গ্রাম ঘুরে একই চিত্র পাওয়া যায়। সব বাড়িঘরে গলাসমান পানি। কোথায়ও এক টুকরো শুকনো জায়গা থাকলেই সেখানে মানুষের ভিড়। এর বাইরে গ্রামগুলো মানুষশূন্য। বাড়িছাড়া মানুষগুলো গুঠাইল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, পশ্চিম বামনা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, বেলগাছা-জারুলতলা রাস্তা, ইসলামপুর-গুঠাইল রাস্তার ওপর আশ্রয় নিয়েছে। পশ্চিম বামনা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে প্রায় ৩০০ পরিবার গবাদিপশু ও আসবাব নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। দুই দিন ধরে সেখানে থাকলেও কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি। মধ্যবয়সী পান ফুল বলেন, ‘ঘরবাড়ি সব বানে ভাসায় নিছে। দুই দিন খাউন ছাড়াই পড়ে আছি। আমগরে খুঁজ কেউ লয় না। এখান থেকে চেয়ারম্যানের বাড়ি কাছেই। কই, কেউ তো আহে নাই।’ ইসলামপুরের দেলিরপাড় গ্রামে গিয়েও দেখা যায় ত্রাণের জন্য মানুষের প্রাণপণ কাতরতা। নৌকা দেখেই ভেবে বুকসমান পানি ঠেলে এগিয়ে আসেন মধ্যবয়সী হালিমা খাতুন। কিন্তু ত্রাণের নৌকা নয়, জানতে পেরে হতাশ হন। হালিমার কাছে থাকা কলসিতে বিশুদ্ধ পানি। এই পানি তিনি এনেছেন এক কিলোমিটার দূর থেকে। জামালপুর জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ১২৮ মেট্রিক টন চাল ও ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ওই সব বরাদ্দের ত্রাণ দুর্গত এলাকায় বিতরণ শুরু করা হয়েছে। সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের মধ্যে এই ত্রাণসামগ্রী কি পর্যাপ্ত? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুর্গত এলাকার সব মানুষ ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার মতো নয়। যেসব মানুষ খুবই দরিদ্র তারাই ত্রাণসামগ্রী পাবে।’

No comments

Powered by Blogger.