প্রধানমন্ত্রীর পূর্ব এশিয়া সফর-সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

আমরা মাঝে মধ্যেই যে পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতার তাগিদ দিয়ে থাকি, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিয়েতনাম ও লাওস সফরের মধ্য দিয়ে সেই পথে বেশ কয়েকটি মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে বলে প্রত্যাশা করা যায়। এই রাষ্ট্রীয় সফরের সময় সম্পন্ন 'আসেম'ভুক্তি অনুষ্ঠান বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও সুযোগকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইরেও সম্প্রসারিত করেছে।


রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে সহযোগিতা বিনির্মাণে গঠিত ৫২ জাতির এই ফোরামে আমাদের অন্তর্ভুক্তি সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ভিন্নমাত্রা যোগ করবে। লাওসের রাজধানীতে আয়োজিত সদস্যভুক্তি অনুষ্ঠানের ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর এই আশাবাদ যথার্থ যে, আসেমভুক্ত দেশগুলোর সম্পর্ক জোরদারের মধ্য দিয়ে ইউরোপে এশিয়ার বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। আমরা বিশ্বাস করি, এখন এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহারে নজর দেবেন সংশ্লিষ্টরা। ভিয়েতনামের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চারটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকও যেন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় আবদ্ধ হয়ে না থাকে, সেই তাগিদ আমরা দিতে চাই। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও রফতানিতে ভিয়েতনাম যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, বাংলাদেশ সেখান থেকে কেবল সহযোগিতা নয়, শিক্ষাও নিতে পারে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ কীভাবে কয়েক দশকের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন ও রফতানিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা অর্জন করতে পারে, ভিয়েতনাম তার এশীয় উদাহরণ। এসব খাতে বাংলাদেশও বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রয়োজন কেবল উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ও সুযোগ। মনে রাখা জরুরি, ভিয়েতনামের লড়াকু মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষও অবিস্মরণীয় ত্যাগ স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি। মুক্তিযুদ্ধে একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের অনন্য বিজয় ভিয়েতনামবাসীর লড়াইয়ে প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন কীভাবে ঢাকার রাজপথ ভিয়েতনামের সমর্থনে উচ্চকিত হতো, সেই স্মৃতি এখনও ফিকে হয়ে যায়নি। চার দশক পর আমরা অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে তাদের কাছ থেকে প্রেরণা অর্জন করতেই পারি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হ্যানয়ে তার কাউন্টারপার্টের দেওয়া নৈশভোজেও দুই দেশের ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক সাদৃশ্য স্মরণ করেছেন। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পাশাপাশি সহযোগিতার ক্ষেত্র বেসরকারি পর্যায়েও সম্প্রসারিত করা জরুরি। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই বহুপক্ষীয় বিশ্বে এর বিকল্পও নেই। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভিয়েতনাম সফরের সময় এফবিসিসিআই (ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ) এবং ভিসিসিআই (ভিয়েতনাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ) বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম বিজনেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠায় একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এটা প্রত্যাশিত, দুই দেশের প্রতিনিধি দলের বিভিন্ন বৈঠকের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক বাণিজ্য সহযোগিতার যে দিগন্ত স্পষ্ট হয়েছে, ভিয়েতনামের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা তা কাজে লাগাবেন। প্রধানমন্ত্রীও ব্যবসায়ীদের এক ফোরামে অভিন্ন বাণিজ্যের সুফল ও সমৃদ্ধির ভাগীদার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতার সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনার কথাও ভিয়েতনাম ও লাওসের ব্যবসায়ীরা বিবেচনা করবেন নিশ্চয়ই। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে ওই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক নৈকট্যও প্রণিধানযোগ্য। বৌদ্ধ রেনেসাঁর পীঠস্থান গাঙ্গেয়-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কাছে প্রাচীনকাল থেকেই আগ্রহের স্থল। সেই আগ্রহকে নতুনভাবে বিকশিত করার সুযোগ তৈরি হলো প্রধানমন্ত্রীর প্রায় সপ্তাহব্যাপী সফরটির মধ্য দিয়ে। সুযোগটি বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত পারস্পরিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধি।

No comments

Powered by Blogger.