ফাটকাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে যা প্রয়োজন by মসিহ্ মালিক চৌধুরী



পুঁজিবাজারনির্ভর উন্নয়নের জন্য বা শিল্পায়নের জন্য বেশ কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন-অন্বেষণের অভিযাত্রায় চলমান থাকার যোগ্যতা, সততা ও বিনিয়োগবান্ধব অভিজ্ঞতা সর্বাগ্রে চলে আসে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারের শেয়ার ট্রেডিং লাভকে কর অব্যাহতি দিয়ে তাদের উন্নয়ন-অর্থায়নের অভিযাত্রা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। বর্তমানে তারা ঋণ প্রদানের ওপর সুদ আয়সহ অপারেশনাল আয়ের ওপর ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ কর দিয়ে থাকে। অন্যদিকে পুঁজিবাজার থেকে লব্ধ আয়ের ওপর প্রায় শূন্য শতাংশ কর পরিশোধ্য।
বেশ কিছুদিন আগে শেয়ারবাজার সর্বোচ্চ সূচকে পৌঁছে গিয়েছিল। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক পৌঁছেছিল আট হাজার ৯১৮ দশমিক ৫১তে। পরবর্তী সময়ে বাজারের যতটা না চাহিদা, তার চেয়ে বেশি শেয়ার বিক্রি হয়। বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয় এবং হঠাৎ সূচক পতন হতে শুরু করে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন, বাজার বাড়তেই থাকবে। বিনিয়োগকারীরা লোভে পড়ে যান। এটা যে শেয়ারবাজারের অন্তর্নিহিত নিয়মেই চলছে, তা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সম্ভবত অনুধাবন করেননি। শেয়ারের দাম বাড়ার কারণগুলোকে চাহিদা ও সরবরাহের ফারাক, অতিরিক্ত স্পেকুলেশন, শেয়ার জুয়াড়িদের মেনিপুলেশন, বুক বিল্ডিং ও ডাইরেক্ট লিস্টিং করে এসইসির বাজার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালনের শোচনীয় ব্যর্থতা শেয়ারবাজারকে এই অনিবার্য পতনের দিকে ধাবিত করেছে। পতন বা উল্লম্ফনের মুখ্য দায়ভার তাই এসইসির। সাধারণ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শোডাউন ও আন্দোলন করে মাঠে নেমেছিলেন। এতে এসইসির টনক নড়ে।
আমাদের শেয়ারবাজারের সাম্প্র্রতিক পতন বা উল্লম্ফনে নিয়ন্ত্রক বা রেগুলেটরের নিষ্ক্রিয়তা বা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা না করে শুধুই জোড়াতালি নীতি গ্রহণ করে তারা জ্বলন্ত আগুনে তেল ঢেলেছে। একটা কথা সত্যি, পতনোন্মুখ শেয়ারবাজারে শেয়ার ক্রয়ের চাপ তৈরি করার জন্য কোনো মধ্য বা স্বল্পমেয়াদি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ তারা নেয়নি। অথচ তাঁদের নামেই তদন্ত কমিশনের তদন্তের আওতা ও পরিধি স্বাক্ষরিত হলো। শুধু এক নির্বাহী পরিচালককে ওএসডি করা হলো। অথচ তদন্তের বিষয়বস্তুর মধ্যে এই কমিশন নিজেই একটি অংশ।
তদন্ত কমিশনের সদস্যরা সবাই ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ও বিদগ্ধজন। তাঁদের শেয়ারবাজারের তাত্ত্বিক জ্ঞান রয়েছে। তবে শেয়ার স্ক্যাম তাত্ত্বিক নিয়মে নয়, প্রায়োগিক বিষয় থেকে উৎসারিত হয়। তাই কমিটির মূল্য পতনের শিকার এবং এর ফলে সবচেয়ে লাভবান যাঁরা, তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসা করে অনেক কিছু জানতে হবে। লুজার বা গেইনারদের জনা কয়েককে জেরা করলে ভালো তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে বলে আমরা মনে করি। তার আগে বাজারের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক যাত্রা সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে হবে। সিডিবিএল তাঁদের জন্য শেয়ার ট্রেডিংয়ের তথ্যভান্ডার হিসেবে কাজ করতে পারে। বিভিন্ন শেয়ারের ট্রেডিং ভলিউম ও মূল্য সংবেদনশীল তথ্যসহ মৌলিক উপাদান, যার জন্য দর পরিবর্তন হতে পারে তা জানতে হবে, নিরীক্ষা করতে হবে। কমিটির তদন্তের জন্য সময় অনেক কম দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে একজন আইনজ্ঞ দেওয়া হয়েছে বিলম্বে।
পতনোন্মুখ শেয়ারবাজারে হঠাৎ ট্রেড বন্ধ করে এসইসি ঠিক করেছে কি না, সময়ই তা বলবে। অথচ মার্কেট ফোর্সেস নিজেই ট্রেডকে সচল রেখে সঠিক জায়গায় ইনডেক্স নিয়ে যেত। এ রকম হস্তক্ষেপ চাহিদা ও সরবরাহের চলমান গতিকে বিপথে নিয়ে যায়। কমিশন এটা না করলেই ভালো হতো। বরং তখন সরকারকে বা ব্যাংকগুলোকে শেয়ার কিনতে বললে বাজারের গতিপথ ভাটির দিকে চলত। রেগুলেটর সব সময় ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় চিন্তার মধ্যে কাজ করবে, এটাই সময়ের প্রত্যাশা। তবে ৫০ হাজার বা ৩০ হাজার কোটি টাকা চলে গেছে—এসব ইউটোপিয়ান হিসাব বলেই মনে হয়।
শেয়ার মূল্যের উল্লম্ফনের কারণগুলোকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা বা শ্রেণীভূত করা যেতে পারে। চাহিদা ও সরবরাহের আন্তপ্রক্রিয়ায় শেয়ারের দর নির্ধারিত হওয়ার কথা। তবে আমাদের শেয়ারবাজারে হঠাৎ উল্লম্ফনের ফলে সরবরাহের চেইন অব ব্যালান্স রক্ষা করতে পারেনি। অন্যান্য কারণের মধ্যে মূল কারণ তাই চাহিদা ও সরবরাহের বিস্তর ফারাক।
আবার ব্যাংকগুলো বছর শেষে লাভ আদায় করার জন্য শেয়ার বিক্রি করে তার সব সিআরআর, এসআরআর ইত্যাদি ঠিক রেখেছে অন্তত ৩১ ডিসেম্বর তারিখে। সব ব্যাংক পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রি করে বিক্রির চাপ সৃষ্টি করেছে। তারা অন্যদিকে মূল কার্যক্রম-উন্নয়ন অর্থায়নে নজর দেয়নি। আবার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রচুর পরিমাণ উদ্দীপনা পান বলে লাভ হিসেবে যত বেশি অর্জন করতে পারেন, তা-ই করেন। দেখা যায়, ছয় থেকে ১২ মাসের মূল বেতন ইনসেনটিভ হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতার বাজারে নিজের নিয়োগদাতা ব্যাংকে সবাই নিজেকে সর্বোত্তম অবস্থানে দেখতে চান। তাই ব্যাংকগুলোকে শেয়ার ব্যবসার (ট্রেডিং) লাভে কর অব্যাহতি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। বরং ব্যাংকগুলো যদি পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশ শুধু মধ্যমেয়াদি (তিন বছর) বিনিয়োগ করে, তাহলে লাভের কর হারের ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ অর্ধেক করা যেতে পারে। ফলে শেয়ার মূল্যেও উল্লম্ফন বন্ধ থাকবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডিপোজিটের ১০ শতাংশ কোনো ব্যাংক শেয়ারবাজারে খাটাতে পারে। ব্যাংকগুলো আলাদা, মার্চেন্ট ব্যাংক শাখা আলাদা কোম্পানি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু কোনো ব্যাংক যখন ডিপোজিটের ১০ শতাংশ নিজস্ব মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে, তখন কিন্তু ১০ শতাংশ সীমাবদ্ধতা কোনো কাজে আসে না। কারণ মার্চেন্ট ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন যদি ২০ কোটি টাকা হয়, তাহলে ওই ব্যাংকের ডিপোজিটের ১০ শতাংশ হতে পারে ৫০০ কোটি টাকা বা আরও বেশি। এতে শেয়ারবাজারের নিয়ম ও পেশাদারিতে তাঁদেরই নিয়ামক ভূমিকা থাকছে। শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধিতে এর ক্ষতিকর ভূমিকা কত ব্যাপক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানেই অতি মূল্যায়নের কারণ অন্তর্নিহিত।
উপরন্তু মার্চেন্ট ব্যাংক পোর্টফোলিও বিনিয়োগের জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়ে ব্যাংকের উচ্চমূল্য ধরে রেখেছে। একদিকে তাদের সুদের আয় হচ্ছে। আবার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য উচ্চমূল্যে শেয়ার ক্রয়ে তারা ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে তাদের নিয়ন্ত্রক কোম্পানি ব্যাংকের জন্য লাভ অর্জন করতে সম্পূর্ণ পেশাদারিতে বিনিয়োগ করছে। ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে তাদের ইন্ধন জোগানো স্বচ্ছ থাকছে না। আবার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুদে ধার দিচ্ছে বিনিয়োগ করার জন্য। নিজেদের ঋণগ্রহীতাদের তারা ঋণের গোলকধাঁধায় ফেলছে, আবার নিজেদের বিনিয়োগকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
অনেক কোম্পানির শেয়ার সিএসই ও ডিএসই লিস্টিং করার ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। পরবর্তী সময়ে এসইসি কিন্তু এই শেয়ার লিস্টিং করতে এগিয়ে আসে। অন্যদিকে লিস্টিংয়ের ব্যাপারে সৃষ্ট কমিটিতে যাঁরা ডিলার, ব্রোকার, ইস্যুয়ার বা আইপিও ম্যানেজার, তাঁদের থাকার যৌক্তিকতা ভেবে দেখার সময় এসেছে। সবকিছু নিয়ে আমরা যত শিগগির সিদ্ধান্ত নেব, ততই মঙ্গল।
মসিহ্ মালিক চৌধুরী: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও কোষাধ্যক্ষ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।

No comments

Powered by Blogger.