মাহে রমজানে শ্রমিকের প্রতি কর্তব্য by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

খেটেখাওয়া পরিশ্রমী মানুষ ও বিভিন্ন ধরনের শ্রমিকের পক্ষে রোজা রেখে পরিপূর্ণভাবে কাজকর্ম সম্পাদন যে কত কঠিন তা মালিক পক্ষের তিলে তিলে অনুভব করার সময় মাহে রমজান। যে শ্রমিক দৈহিক পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রুজি-রোজগার বা আয়-উপার্জন করে, তার জন্য রোজা অবস্থায় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়টি মালিকপক্ষকে উপলব্ধি করা দরকার। মাহে রমজানের দিনে অধীনস্থ কর্মচারীদের দায়িত্ব ও কাজকর্ম হালকা করে দেওয়া ইসলামের বিধান। অন্যথায় তারা কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে। রমজান মাসে তাদের ওপর কষ্টকর কাজের বোঝা চাপানো অনুুচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এ মাসে (রমজানে) যারা দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করে, অর্থাৎ তাদের কাজের বোঝা হালকা করে, আল্লাহ তাদের দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেন।’
ইসলাম ধনী-গরিব, মনিব-চাকর, মালিক-শ্রমিকের কোনো পার্থক্য করে না। ইসলাম আদল-ইনসাফ ও ন্যায়নীতির ধর্ম। গৃহের মালিক নিজে যা খাবে ও পরবে অধীনস্থ কাজের লোকদের তা-ই খাওয়াবে ও পরাবে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘হে লোক সকল! আল্লাহ তোমাদের ভাইদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব, যার অধীনে কোনো ভাই থাকে তাকে তা-ই খাওয়াবে যা সে নিজে খায়, তাকে তা-ই পরাবে যা সে নিজে পরে এবং তাকে সাধ্যের অধিক কাজ চাপিয়ে দিবে না। অগত্যা তাকে দিয়ে যদি কোনো কষ্টের কাজ করাতে হয় তাহলে তাকে সাহায্য করবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের জীবনে নবীজির এ আদেশ পুঙ্খানুপঙ্খভাবে পালন করেছেন এবং অন্যকেও পালনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কিন্তু বাস্তবে ঘাম ঝরানো শ্রমিকের প্রতি মালিক শ্রেণীকে সামান্যতম সহানুভূতি প্রদর্শন করতে দেখা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে যেন রমজান মাসে তাদের আরও রুদ্রমূর্তি হয়ে আবির্ভূত হতে দেখা যায়। রোজাদার শ্রমিকদের কাছ থেকে অন্য সময়ের মতোই কড়ায়-গণ্ডায় শ্রম আদায় করার জন্য কঠোরতা দেখালে, রোজা রাখার কারণে তপ্ত দুপুরে প্রচণ্ড খরতাপে যখন সে হাঁপিয়ে ওঠে এবং দায়িত্ব পালনে ত্রুটি হয় তখন তার প্রতি চাপ প্রয়োগ ও দুর্ব্যবহার করলে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের দিনগুলোতে মালিকপক্ষের ক্ষমা নয়, বরং কঠোর শাস্তিই নিশ্চিত হবে। অপর দিকে শ্রমিক যদি রোজা রাখা সত্ত্বেও সাধ্যমতো কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হয়, তাহলে সে সাধারণ কেউ রোজা রেখে যে সওয়াব পাবে তার দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। অধীনস্থ কর্মচারী, শ্রমিক ও খেটেখাওয়া লোকদের পুরস্কারের কথা রাসুলে করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘তিন ধরনের লোকের জন্য (প্রতিটি নেক কাজের) দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছে। তন্মধ্যে এক ব্যক্তি হচ্ছে ওই দাস যে আল্লাহর হক ও মনিবের হক উভয় আদায় করে।’ এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা কাজ করে তাদের জন্য কতই না চমত্কার প্রতিদান।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৬)
গৃহভৃত্য ও পরিচারিকারাও যে আল্লাহর বান্দা, রমজান মাসে যেন লোকেরা সে কথা ভুলে যায়। তাদের খাটুনির মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমরা মাহে রমজানে দাস-দাসীর কাজকর্ম শিথিল করে দাও। তারা যেন রমজান মাসের ইবাদত যথাযথভাবে করতে পারে।’ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবতার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তিনি ক্রীতদাসদের কষ্ট নিজে ভাগ করে নিতেন। বিপদে-আপদে তাদের পাশে দাঁড়াতেন। একবার এক গোলাম গম পিষছিল আর কাঁদছিল। নবীজি তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, ‘প্রতিদিন তাকে এক মণ গম পিষতে হয়। আজ শরীরটা খুব অসুস্থ, তাই পিষতে পারছি না। আমার মনিব বড়ই নিষ্ঠুর লোক। গম পিষতে পারছি না দেখলে হয়তো সে আমাকে মারবে, এই ভয়ে কাঁদছি।’ রাহমাতুল্লিল আলামিন গোলামটির পাশে বসে তার গমগুলো পিষে দিলেন এবং বললেন, ‘ভবিষ্যতে যখনই তোমার কষ্ট হবে আমাকে খবর দিবে। আমি এসে তোমার কাজ সম্পন্ন করে দিব।’
কোনো ক্রীতদাসের অসুস্থতার খবর শুনলে নবীজি ছুটে যেতেন এবং তার সেবা-শুশ্রুষা করতেন। একবার এক ধনী লোকের জনৈক গোলাম অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাকে দেখার কেউ ছিল না। মনিব ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। গোলামটি একটি অন্ধকার কুঠুরিতে শুয়ে কাতরাচ্ছিল। দয়াল নবীজি ওই বাড়ির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় অসুস্থ গোলামটির কাতরানির আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে তার মাথায় হাত বোলাতে থাকেন। এতে সে আরাম বোধ করতে লাগল। রাতে সে নবীজিকে চিনতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, তার মনিব তাকে সেবার জন্য পাঠিয়েছেন কি না। নবীজি বললেন, ‘তিনি স্বেচ্ছায়ই এসেছেন।’ পরদিন সকালে ওই ক্রীতদাস যখন দেখল যে নবীজি তার সেবা করছেন, তখন সে কেঁদে উঠল। ভাবতে লাগল, মানুষের জন্য মানুষের এত দয়া, এত ভালোবাসা? আমি একজন গোলাম, অথচ দোজাহানের বাদশাহ হয়েও নবীজি আমার সেবা করছেন? এই ছিল মহানবী (সা.)-এর সুমহান আদর্শ। রাসুলুল্লাহ (সা.) জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত দাস-দাসীদের কথা স্মরণ রেখেছিলেন। হজরত আলী (রা.) বলেছেন যে নবী করিম (সা.)-এর সর্বশেষ বাণী ছিল, ‘১ নামাজ-নামাজ, আর ২. যারা তোমাদের অধীনে তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ)
প্রকৃত রোজাদার মুমিন ব্যক্তি সদা আল্লাহর প্রতি দায়িত্বশীল এবং মানুষের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ থাকেন। শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থাকাই ঈমানদারের দায়িত্ব। তার ঘরে যেসব কাজের লোক রয়েছে তাদের প্রতিও তার অধিকার রয়েছে। দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে তাদের এ ন্যায্য অধিকার আদায় করতে হবে। কোনো রোজাদার ব্যক্তি এ ব্যাপারে শৈথিল্য দেখাতে পারেন না। মালিক শ্রেণীর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে অফিস-আদালতের মতো শ্রমিকের কর্মঘণ্টা কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। প্রয়োজনে তাদের জন্য সামান্য ভাতার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। যে রোজাদার ব্যক্তি তার অধীনস্থ কাজের লোকদের প্রতি সদ্ব্যবহার দেখাবে, আল্লাহ তার প্রতি অসীম দয়ার হাত প্রসারিত করবেন এবং তাকে বেহেশত দান করবেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে, আল্লাহ তার ওপর রহমতের ডানা প্রসারিত করবেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ১. দুর্বলের সঙ্গে নম্র ব্যবহার, ২. পিতামাতার সঙ্গে মমতা জড়ানো কোমল ব্যবহার এবং ৩. দাস-দাসীর প্রতি সদাচরণ।’ (তিরমিজি)
সাধারণত কাজের লোকদের মানুষ খুব কমই ক্ষমা করে থাকে। নিজের ছেলেমেয়ের হাত দিয়ে মূল্যবান জিনিসটি খোয়া গেলে টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করে না, আর ওই গৃহস্থালি কাজের ছেলেমেয়ের হাত দিয়ে সামান্য কিছু নষ্ট হলেই অমনি শুরু হয় বেদম প্রহার বা নির্যাতন। অসুখের কারণে কাজ না করতে পারলে তাদের বকুনিও শুনতে হয়। কাজের লোক বলে তাদের কামনা-বাসনা নেই, বিশ্রামের প্রয়োজন নেই, রোগ-ব্যাধি নেই—এমন ধারণা ইসলাম সম্মত নয়। নবী করিম (সা.) এ জাতীয় দুর্ব্যবহার থেকে উম্মতকে বিরত থাকার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। অধীনস্থ লোকদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে না বলেই সমাজে মালিক-শ্রমিক ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে, যা সভ্য সমাজের জন্য মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং মাহে রমজানসহ সর্বাবস্থায় কঠোরতা পরিহার করে রোজাদারদের আচার-ব্যবহারে ইসলামের সদাচরণ, ক্ষমা, উদারতা ও কোমলতার মহৎ গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।

No comments

Powered by Blogger.