জামদানিও কি হারিয়ে যাবে?

‘পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর’- বুদ্ধিবৃত্তিক ও মেধাসম্পদ সংরক্ষণ সংক্রান্ত একটি উচ্চতর গবেষণার কাজে শেষ পর্যায়ে এসে কবিগুরুর এ পঙ্ক্তি বারবারই মনে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের এ অংশটির নাম ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই)। জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন কোনো একটি দেশ বা বৃহত্তর অঞ্চলে (সেখানে কয়েকটি দেশ/মহাদেশও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে) ঐতিহ্যগতভাবে গড়ে ওঠার/প্রচলিত দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ডব্লিউটিও’র ট্রিপস চুক্তির ২২, ২৩ ও ২৪ নম্বর আর্টিকেলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা, পরিচিতি ও করণীয় বিধৃত হয়েছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল বা দেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সম্পদ সুরক্ষার জন্য জিআই রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে উদ্ভব এবং বংশ পরম্পরায় প্রচলিত ও বিকশিত সেসব পণ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আইনটি প্রণয়ন করতে বাংলাদেশ একটু সময় নিয়ে নেয়। জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন অ্যাক্ট বা আইনটি প্রণীত হয়েছে ২০১৩ সালে। এরই মধ্যে ভারত বাংলাদেশের মহামূল্যবান এবং ঐতিহ্যবাহী পণ্য জামদানি শাড়ি ওয়াইপো থেকে নিজেদের নামে জিআই রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশে, ২০০৯ সালে। আর তখন থেকেই গোটা উপমহাদেশে এ নিয়ে হইচই পড়ে যায়। ভারত যে কেবল জামদানির ক্ষেত্রে এ কাজটি করেছে তা-ই নয়, আমাদের নকশিকাঁথাও ভারতীয় পণ্য হিসেবে জিআই রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে। তাছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি, হিমসাগর ও লক্ষণভোগ আমও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। ছেলেবেলায় আমরা ফজলি আমকে মালদরে/মালদরিয়া বলতেও শুনেছি। অর্থাৎ এ জাতের আমটি পশ্চিমবঙ্গের মালদহেও উৎপন্ন হয়। তাই এখন অনুধাবন করছি জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন কত জটিল একটি বিষয়। আর সে কারণে বাসমতী চাল ভারত, না পাকিস্তানের কিংবা নিমগাছ ভারত উপমহাদেশের, না সারা বিশ্বের- এ বিতর্কের কোনো সুরাহা হবে না। তেমনি নাটোরের কাঁচাগোল্লা, পোড়াবাড়ির চমচম,
কুমিল্লার রসমলাই, মুক্তাগাছার মণ্ডা, সিলেটের চা এবং সুন্দরবনের মধু, বাঘ নিয়ে কিছুটা সহজে সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হলেও পদ্মার ইলিশের ক্ষেত্রে এটি আদৌ সহজ হবে না। তবে এ কথা ঠিক, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ বছর আগে প্রাচীন ভারতীয় অর্থশাস্ত্রবিদ কৌটিল্য (চাণক্য) তার অর্থশাস্ত্রে ঢাকাই মসলিন ও জামদানির কথা উল্লেখ করেছিলেন। ১৪ শতকের মরোক্কান মুসলিম পরিব্রাজক ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতেও সোনারগাঁয়ের জামদানি প্রস্তুতকারকদের কথা উল্লেখ আছে। এর চেয়ে প্রাচীন প্রমাণ আর কী হতে পারে? ভারত যে নামে পণ্যটির জিআই নিবন্ধন করেছে সেটি হচ্ছে ‘উপাধ্যায় জামদানি’। তাই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সালিশের মাধ্যমে নিজের পণ্য হিসেবে প্রমাণ করে জামদানির পুনঃনিবন্ধন করতে হয়েছিল। এ বিষয়ে অধিকাংশের অভিমত ছিল ‘ঢাকাই জামদানি’ নামে পণ্যটির জিআই নিবন্ধন করা যুক্তিযুক্ত হবে। কিন্তু ২০১৪ সালে সিপিডি ও বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সংলাপে বক্তারা এ প্রস্তাব গ্রহণে নারাজ ছিলেন। তারা একরকম খড়গহস্ত হয়ে বলেছিলেন, সরকারি এ প্রস্তাব আমরা মানি না, কারণ জামদানির উৎপত্তিস্থল যদি বাংলাদেশ হয়ে থাকে এবং ‘জামদানি’ নামেই সেটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় তাহলে এ নামেই জিআই নিবন্ধন করাতে হবে। কোনো খণ্ডিত বা সংযোজিত নামে নিবন্ধনের সুযোগ নেই। দেরিতে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন অ্যাক্ট প্রণয়নের কারণে পণ্যটি বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তারা সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. ইফতেখার ইকবাল তার দীর্ঘ গবেষণার সারবস্তু উপস্থাপন করে বলেছিলেন, এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে জামদানি বাংলাদেশের একটি পণ্য। সবচেয়ে উত্তম মানের জামদানি একমাত্র বাংলাদেশেই (সোনারগাঁ, ঢাকা) উৎপাদিত হতো। এর কারণ শীতলক্ষ্যা নদীর জল। শীতলক্ষ্যার জলে এর ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পেয়ে এটি এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী পণ্যে পরিণত হতো। কাজেই পণ্যটির জিআই নিবন্ধন করিয়ে ভারত যা করেছে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। বন্ধু হওয়ার সুবাদে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রার মো. সানোয়ার হোসেনকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করি এবং এ বিতর্কের সুরাহা করার পথনির্দেশনার অনুরোধ জানাই। তিনি বললেন, ঢাকাই জামদানি নামে এ পণ্যের জিআই নিবন্ধন হতে কোনোই অসুবিধা নেই। কারণ ভারতীয় পণ্য ও এটি গুণগতভাবে এবং মানের দিক থেকে আলাদা। কাজেই দু’নামে দুটি পণ্যের জিআই রেজিস্ট্রেশন হতেই পারে। আমাদের জামদানি ‘ঢাকাই জামদানি’ নামে নিবন্ধন পেলে কারও তাতে আপত্তি থাকা উচিত নয়। তবে আমরা ‘জামদানি’ নামেই চূড়ান্তভাবে এটির নিবন্ধনে আগ্রহী। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছিল, ‘জামদানি’ নামে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মাধ্যমে (নভেম্বর ২০১৬), যার আবেদনকারী কর্তৃপক্ষ ছিল বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা। এ বিতর্কের মধ্যেই আমাদের অনন্য সাধারণ পণ্যটির বর্তমান অবস্থা কী সেটিও সবাইকে ভাবতে হবে। এটি কি আগের অবস্থানে আছে, নাকি ক্ষয়িষ্ণু একটি পণ্য এখন? বর্তমান অবস্থা যা-ই হো,
এটিও একদিন মসলিনের মতো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনই একটি ইঙ্গিত দিলেন জামদানি তাঁতী ইসমাইল। স্ত্রীর শাড়ি কেনার সুবাদে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। আলাপের একপর্যায়ে জানালেন, একসময় ব্রিটিশরা আমাদের তাঁতীদের শৈল্পিক হাতগুলো কর্তন করেছিল, এখন আমরা নিজেরাই আমাদের হাত কাটছি। আর সে কারণেই মসলিনের মতো জামদানিও অদূর ভবিষ্যতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। কারণটি বলছি- এটি আমার বাপ-দাদার ব্যবসা এবং এটিই আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। আমি এটি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হলেও আমার উত্তরাধিকারীরা এ ব্যবসা করুক তা আমি চাই না এবং আমার মতো এমন অনেক তাঁতীই চায় না। উত্তরাধিকারীরা তো চায়-ই না। জামদানি শাড়ির বুনন শেখার জন্য দীর্ঘ দু’বছর সময় ব্যয় হয়। কিন্তু এ সময়টি এখন আর কেউ দিতে চাচ্ছে না। কেউ কেউ মনে করে এটি নিন্মমানের পেশা। তাছাড়া বিভিন্ন কাজের হাজারটি বিকল্প বের হয়ে গেছে। সবাই এখন নগদে বিশ্বাসী। একটা সময় ছিল যখন পৈতৃক পেশার প্রতি সম্মান জানিয়ে একজন তাঁতীর ছেলেমেয়েরা এ কাজটিই শিখত এবং তা বংশ পরম্পরায় চালিয়ে যেত। তখন অন্য কোনো পেশার বিকল্পও ছিল না। এখন রেডিমেড গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি আছে, কলকারখানা, নির্মাণ শিল্প ও পরিবহন খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় কেউই চাচ্ছে না বিনে পয়সায় ২ বছর শিক্ষানবিশ কাল অতিক্রম করে তারপর কোনো ওয়েভিং ফ্যাক্টরিতে কাজ নেবে। সে কারণে তাঁতীরা মনে করেন ২ বছরের এ প্রবেশনারি সময়ে সরকার ভর্তুকি দিলে তাদের উৎসাহটা অব্যাহত থাকতে পারে। জামদানি তাঁতী ইসমাইলকে বলা হল, এখন প্রত্যেক পেশাজীবী সচেতন হয়েছে। তারা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। আপনারা কেন সেই যোগাযোগ রাখছেন না, কেন আপনারা যাচ্ছেন না বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে, অথবা পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক কার্যালয়ে? তিনি বললেন, স্যার আমরা কোনো অফিস চিনি না,
কোনো অফিসারকেও চিনি না। বুঝলাম, সাধারণ তাঁতীরা খুবই সীমিত গণ্ডির মানুষ (যদিও ইসমাইল তাঁতী তা নন)। এমনই একটি ধারণা দিয়েছিলেন প্রখ্যাত লোক-গবেষক, লেখক ও সংগ্রাহক মোহাম্মদ সাইদুর তার ‘জামদানি’ বইয়ে : ‘তাঁতী সম্প্রদায় সাধারণত সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ স্থানীয় হাটের দিন সপ্তাহের যাবতীয় বাজার-সওদা করে থাকেন ... মান্ধাতা আমলের তাঁতশালা অর্থাৎ পরিকল্পনাহীনভাবে ভিজে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারময় জায়গায় তাঁতশালার কারণে অনেক তাঁতী বছরের পর বছর আলো-হাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকেন ...বাইরের চলমান পৃথিবীতে কী ঘটছে না ঘটছে, সমাজ সংসার কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তার কোনো খোঁজখবর রাখেন না ... যদিও বর্তমান সমাজের দ্রুত পরিবর্তনের ফলে এ অভিযোগ অনেক কমে এসেছে (বাংলা একাডেমি, জুন ১৯৯৩)। ইসমাইল তাঁতী এরপর আর ঢাকাই জামদানি হিসেবে বাংলাদেশের জামদানির জিআই নিবন্ধনে কোনো আপত্তি করেননি। বললেন, ভারত নিবন্ধন করেছে তাদের মতো করে। আমরা আমাদের জামদানির আঁতুড়ঘরের নাম যুক্ত করে দিয়ে নতুনভাবে নিবন্ধন করব, তাতে অগৌরবের কিছু নেই। বরং সেটিই গৌরবের। তবে তিনি সরকারি সহায়তার কথা আবারও উচ্চারণ করলেন। আশা করি, জামদানি শিল্পকে বাঁচানোর জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবাই এগিয়ে আসবেন। তাহলেই আমাদের জামদানি আন্তর্জাতিক পরিচয়ে নিজেকে মহিমান্বিত করে ইতিহাসের এক নতুন বাঁকে এসে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। আবার বাংলার জনপদগুলো মুখরিত হয়ে উঠবে তাঁতীদের কলধ্বনিতে, যারা সমস্বরে গাইতে থাকবে- ভালো কাপড় বুনতে জানি / চিরুন কোটা শালের বোটা ঢাকাই জামদানি!
গোলাম শফিক : কবি, গবেষক

No comments

Powered by Blogger.