নষ্ট হচ্ছে রেলের কোটি কোটি টাকার সম্পদ

রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হচ্ছে রেলের কোটি কোটি টাকার সম্পদ। ভাবখানা এমন- ‘সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল।’ বছরের পর বছর রেলের শত শত বগি পরিত্যক্ত অবস্থায় বিভিন্ন জংশনে এখানে সেখানে ফেলে রাখা হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে এগুলো পড়ে থাকায় চোরের দল মূল্যবান যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মাদকসেবী ও ভাসমান পতিতাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে এসব বগি। এগুলোকে ঘিরে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডও চলছে। প্রতি বছর রেল লোকসান দিলেও কোটি কোটি টাকার এই সম্পদ দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করে লোকসান কমানোর সুযোগ থাকলেও অদৃশ্য সুতোর টানে তা থেমে আছে। আস্তে আস্তে নষ্ট হচ্ছে এসব পরিত্যক্ত বগি ও মূল্যবান যন্ত্রাংশ। বগিগুলো বছরের পর বছর রেখে দেয়ায় জং ধরে নষ্ট হচ্ছে রেললাইনও। অনেক জায়গায় রেললাইন দেবে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলওয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী পুরনো সেল ডিপোতে ১০ বছর ধরে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে দামি যন্ত্রাংশ, বিপুলসংখ্যক পরিত্যক্ত যাত্রী-মালবাহী বগি। এক হিসেবে দেখা গেছে, পরিত্যক্ত এসব সম্পদের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। রেলের পূর্বাঞ্চলীয় যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রেলের পরিত্যক্ত বগিগুলো মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ না থাকায় পাহাড়তলী ওয়ার্কশপের ভেতরে রাখা অন্তত ৬০টি যাত্রী-মালবাহী বগি এবং যন্ত্রাংশ পড়ে আছে। তাছাড়া ওয়ার্কশপে নেয়ার উপযোগী আরও শতাধিক বগি আশপাশের বিভিন্ন ইয়ার্ডে রাখা আছে। এছাড়া ওয়ার্কশপের ভেতরে মার্শলিং ইয়ার্ডে পড়ে আছে আরও শতাধিক বগি। অরক্ষিত এসব পরিত্যক্ত কোচ থেকে প্রতিনিয়তই সিটসহ নাটবল্টু, চাকা, লোহার পাতগুলো কেটে নিয়ে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ চোরের দল। বগিগুলো রাখার ফলে লাইনগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পূর্বাঞ্চলীয় রেলের সরঞ্জাম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. ফরিদ আহম্মেদ সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেন যুগান্তরকে বলেন,
পাহাড়তলী ওয়ার্কশপসহ পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্টেশন ইয়ার্ডে থাকা পরিত্যক্ত বগির সংখ্যা প্রায় তিনশ’। কোনো রাখঢাক না করে খোলা আকাশের নিচে বছরের পর বছর ধরে রেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এবং সরঞ্জাম পড়ে থাকার প্রসঙ্গ টেনে এর দায় চাপান টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে ‘ঝামেলার’ ওপর। তিনি বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কিছুটা ঝামেলা রয়েছে, এছাড়া রেলের যন্ত্রাংশের মূল্য কমে যাওয়ায় টেন্ডার আহবানেও বিলম্ব হচ্ছে। তবে তিনি এ বছরই যন্ত্রাংশ বিক্রয়ের জন্য দরপত্র আহবান করা হবে বলে যুগান্তরকে জানান। যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পূর্বাঞ্চলে রেলওয়ের বিশাল এলাকা, বিভিন্ন ইয়ার্ডেও পড়ে আছে বগি-যন্ত্রাংশ। চুরি রোধ কিংবা নিরাপত্তার বিষয়টি কারখানা কর্তৃপক্ষের দায়। পাহাড়তলীর বাইরে আখাউড়া, লাকসাম, ভৈরববাজার, লাকসাম, তেজগাঁও, টঙ্গী জংশনসহ পূর্বাঞ্চলের ১২টি জংশনে অসংখ্য পরিত্যক্ত বগি সারি সারি দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। একদিকে যেমন রেল লাইন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ধ্বংস হচ্ছে বগিগুলোও। একই হাল রেলের পশ্চিমাঞ্চলেও। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাসহ নীলফামারী, পাকশী, পাবনা, লালমনিরহাট, নাটোর, জয়পুরহাট, রংপুর, খুলনাসহ জংশন রেলস্টেশনগুলোতে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে শত শত বগি ও বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশ। রেলের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মো. রমজান আলী পরিত্যক্ত বগি ও যন্ত্রাংশ নিয়ে নতুন সমস্যার কথা শোনালেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ওয়ার্কশপ তথা বিভিন্ন জংশন-স্টেশন ইয়ার্ডে পরিত্যক্ত বগি ও যন্ত্রাংশ এতটাই বেড়ে গেছে যার কারণে নতুন করে ক্রটি দেখা দেয়া বগি ও যন্ত্রাংশ মেরামতেও সমস্যায় পড়ছে হচ্ছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা এসব বগি কিংবা যন্ত্রাংশ যথাসময়ের বিক্রির উদ্যোগ নিলে রাজস্ব আহরণ বাড়ত। তবে বর্তমান সরকারের আমলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের টেন্ডারের মাধ্যমে এগুলো বিক্রির উদ্যোগ নেয়ার কথা তিনি জানান।
আখাউড়া রেলওয়ে জংশনেও একই হাল। সেখানকার ৭টি লাইনজুড়ে প্রায় দুই যুগ ধরে অর্ধশতাধিক পরিত্যক্ত বগি পড়ে আছে। এসব বগি একদিকে যেমন মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে চুরি হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ। লাইনগুলো দেবে যাওয়ায় অনেক বগি হেলে পড়েছে। এসব পরিত্যক্ত বগি ঘিরে গড়ে উঠেছে মাদকাসক্ত ও ভাসমান যৌনকর্মীদের আড্ডাস্থলে। একই অবস্থা ভৈরববাজার, তেজগাঁওয়ের রেলওয়ে স্টেশন জংশনেও। তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত বগি ঘিরে মাদক কেনা-বেচা বলতে গেলে ওপেন সিক্রেট। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের চট্টগ্রাম জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক মো. আশরাফুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মধ্য দিয়ে বগি কিংবা যন্ত্রাংশ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রাম বিভাগেই রেলের এ ধরনের কোটি কোটি টাকার সম্পদ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার কথা তিনি স্বীকার করেন। এ ধরনের পরিত্যক্ত বগি ও যন্ত্রাংশের পরিমাণ টাকার অংকে কত? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের হিসাব রাখার কাজ আমাদের নয়, এর দায়িত্ব হচ্ছে মেকানিক্যাল বিভাগের। আমরা যেটা বলতে পারি সেটা হচ্ছে- অনেক বগি ও যন্ত্রাংশ দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, এগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিক্রয় ও মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে। রেলের পশ্চিমাঞ্চলীয় সূত্র বলছে, কেবল ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন স্টেশন ইয়ার্ডে প্রায় ৩শ’ যাত্রী ও মালবাহী বগি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বগি ও কনটেইনার কিংবা ইঞ্জিন মেরামতের নির্দিষ্ট ওয়ার্কশপ (লোকোশেড) ময়মনসিংহের কেওয়াটখালীতে থাকলেও কয়েক দশক ধরে এটি বন্ধ রয়েছে। এটি এখন পরিত্যক্ত বগি ও যন্ত্রাংশের ‘ডাম্পিং স্টেশন’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দিনাজপুরের পার্বতীপুর রেল ইয়ার্ডেও ৪০টি যাত্রীবাহী বগি (এমজি-মিজার গেজ) অচল হয়ে পড়ে আছে বছরের পর বছর ধরে। জামায়াত-বিএনপির হামলায় আক্রান্ত ১০-১২টি যাত্রীবাহী কোচ মেরামতের অপেক্ষায় রয়েছে। মেরামত ও সংরক্ষণের অভাবে এগুলো নষ্ট হওয়ার পথে। রেলের পশ্চিমাঞ্চলীয় সরঞ্জাম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. বেলাল আহম্মেদ কোটি কোটি টাকা মূল্যের পরিত্যক্ত বগি ও যন্ত্রাংশ মরচে ধরে নষ্ট হওয়ার কথা স্বীকার করেন যুগান্তরের কাছে।
তিনি বলেন, শান্তাহার, ঈশ্বরদী, পার্বতীপুর, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন স্টেশন-জংশনে প্রায় ৪ শতাধিক যাত্রীবাহী বগি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। যার বর্তমান মূল্য কোটি কোটি টাকা। তিনি বলেন, এসব যন্ত্রাংশ দ্রুত বিক্রির ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অচিরেই দরপত্র আহবান করা হবে। পাবনার ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্টেশন ইয়ার্ডে ১৫০টি বগি বছরের পর বছর পড়ে আছে। রেলওয়ের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরিত্যক্ত এক একটি বগি ১ লাখ থেকে দেড় লাখ পর্যন্ত সহজেই বিক্রি করা সম্ভব। সে হিসাবে প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের বগি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ব্রডগেজ লাইনে খাদ্যশস্য, সবজি, পাথরসহ বিভিন্ন মালামাল পরিবহনে এসব বগি ব্যবহার করা হতো। জানতে চাইলে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগের যান্ত্রিক প্রকৌশলী বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, তেজগাঁও, টঙ্গী ও ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন ইয়ার্ডে বহু বগি ও যন্ত্রাংশ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, তেজগাঁও ইয়ার্ডেই পড়ে থাকা ১০টি বগি এক যুগ আগে দরপত্রের উদ্যোগ নেয়া হলেও অদৃশ্য সুতোর টানে তা আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে এসব বগির মূল্য অনেক কমে গেছে। বগিগুলো প্রায় ধ্বংসের প্রান্তে চলে গেছে। চুরি হয়ে যাচ্ছে বগির যন্ত্রাংশ।

No comments

Powered by Blogger.